ডাঃ সুবর্ণ গোস্বামী
আজ বাংলার মেয়ে অভয়ার জন্মদিন। বেঁচে থাকলে আজ বত্রিশ বছর বয়স হতো তার। আজ থেকে ঠিক ছ'মাস আগে মধ্যরাতে ব্যস্ত মহানগরীতে টানা ছত্রিশ ঘণ্টার ডিউটিতে অবসন্ন মেয়েটি সহকর্মীদের সঙ্গে রাতের খাবার খেয়েছিল শেষবারের মতো। তারপর তাকে গলা টিপে, শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। সঙ্গে জোটে নৃশংস ধর্ষণ। আজ সেই অভিশপ্ত রাতের ছ'মাস পূর্তি।
স্বাধীনতা-উত্তর কালে অভূতপূর্ব গণজাগরণের সাক্ষী থেকেছে এরাজ্য গত ছ'মাসে। বিচারের দাবিতে রাজপথ থেকে আলপথে ইতিহাস রচনা করেছেন বাংলার মানুষ। অন্যদিকে বিচারের পথ রুদ্ধ করার পাশাপাশি প্রতিবাদী নাগরিকদের উপর প্রতিহিংসা নামিয়ে এনে চূড়ান্ত নির্লজ্জতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে শাসকও। সরকার সরাসরি অপরাধীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে এই ঘটনায়। ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কেই একমাত্র অপরাধী খাড়া করিয়ে বাকি অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টায় কোনও কসুর রাখেনি তারা। আরএসএস প্রধান প্রকাশ্যেই বলেছেন আরজি কর ইস্যুতে রাজ্য সরকার যা করছে তাতে সঙ্ঘের সমর্থন আছে। ফলে প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মুখে কুলুপ এঁটেছেন, এরাজ্যের বিরোধী দলনেতা প্রতিবাদী চিকিৎসক ও নাগরিকদের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন, কেন্দ্রের খাঁচায় পোরা তোতাপাখি সিবিআই বিনীত গোয়েলদের তদন্তের নাটকে শিলমোহর দিয়ে একা সঞ্জয়ের বিরুদ্ধেই চার্জশিট জমা দিয়েছে।
শিয়ালদহ আদালতের রায় অনেকগুলি প্রশ্ন তুলে দিয়েছে কলকাতা পুলিশ, রাজ্য প্রশাসন ও সিবিআই’র ভূমিকা নিয়ে। মূল খুন-ধর্ষণের অপরাধে একমাত্র সঞ্জয় রায়কেই দোষী সাব্যস্ত করে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও সিবিআই তদন্তে যে অজস্র ফাঁকফোকর রয়ে গেছে, তার উল্লেখ রয়েছে রায়ের ছত্রে ছত্রে। সঞ্জয় রায়কে একমাত্র অপরাধী ধরলে বহু প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়ে যায়। প্রথমত, কলকাতা পুলিশ এই সঞ্জয়কে গ্রেপ্তার করে ঘটনার পরের দিন মাঝরাতে। পরের দিন মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে সে-ই প্রধান আসামি এবং তাঁর দল ও সরকার তার ফাঁসি চায়। যদি তাই হয়, তাহলে কেন নির্যাতিতার মা-বাবাকে হাসপাতালে ডেকে এনে তিনঘণ্টা বসিয়ে রাখা হলো সন্তানের মৃতদেহ দেখতে না দিয়ে? কেন পুলিশ ঐ তিনঘণ্টায় হেলথ সিন্ডিকেটের পান্ডাদের দাপাদাপি করতে দিল চেস্ট ডিপার্টমেন্টের সেমিনার হলে? কেন তাদের ছবি ক্রপ করে তাদেরকে পুলিশের ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট বলে চালানোর চেষ্টা করল ডিসি সেন্ট্রাল? কেন নিয়ম ভেঙে রাতারাতি ময়নাতদন্ত করা হলো? পরিবার মৃতদেহ সংরক্ষিত করে রাখতে চাইলেও পুলিশ অতিতৎপরতায় দেহ সৎকার করে ফেলল? কেন ডিসি নর্থ মৃতার মায়ের হাতে মোটা টাকার বান্ডিল গুঁজে দিতে চাইলো? মৃতদেহ থেকে সংগৃহীত নমুনা কেন চারদিন পরে ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হলো? সঞ্জয় তো ১০ আগস্ট গ্রেপ্তার হয়েছে, তারপরেও ১৩ আগস্ট স্বাস্থ্য সচিব ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তার নির্দেশে আরজি করের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ কেন তড়িঘড়ি, সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে, চেস্ট ডিপার্টমেন্টের লাগোয়া শৌচাগারটি ভেঙে ফেললেন? কেন ১৪ আগস্ট রাতে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় রেখে জনা চল্লিশেক সশস্ত্র দুষ্কৃতীকে আরজি কর হাসপাতালে ঢোকানো হলো সেমিনার রুমে ভাঙচুর চালাতে? যদি সঞ্জয় রায়ই একমাত্র অপরাধী হয়, তাহলে কীভাবে সেন্ট্রাল ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির রিপোর্টে মৃতা চিকিৎসকের গোপনাঙ্গ থেকে সংগৃহীত নমুনাগুলি থেকে একাধিকজনের ডিএনএ পাওয়া গেল? সেগুলি কাদের ডিএনএ, তা আজও পরীক্ষা করা হলো না কেন? এই অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোই প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রকে ফাঁস করে দিয়েছে। ফলে অসম্পূর্ণ তদন্তের উপর ভিত্তি করে এই খণ্ডিত বিচার জনগণ মানতে নারাজ।
আদালতের রায়ের পরতে পরতে রয়েছে রাজ্য প্রশাসন, কলকাতা পুলিশ ও সিবিআই’র অপদার্থতা, ঔদাসীন্য ও আইন ভাঙার জ্বলন্ত প্রমাণ। কলকাতা পুলিশের দুই অফিসারের বিরুদ্ধে রয়েছে আইন ভেঙে কাজ করবার গুরুতর অভিযোগ। সঞ্জয় রায়কে গ্রেপ্তারের পরেই তার মোবাইল ফোনটি বেআইনিভাবে কবজা করেন এক মহিলা পুলিশ অফিসার। ঐ মোবাইল থেকে কল লগের মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লোপাটের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায়নি।
সঞ্জয়ের আইনজীবী ফাঁস করেছেন আরও বড় ষড়যন্ত্র। জাতীয় আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষ থেকে যে সিনিয়র উকিলকে দেওয়া হয় সঞ্জয়ের পক্ষে সওয়াল করবার জন্য, তিনি যে আসলে আদালতে সিবিআই’র সুরেই সুর মিলিয়েছেন তা সংবাদমাধ্যমে ফাঁস করে দিয়েছেন তাঁর জুনিয়র নিজেই। অর্থাৎ সঞ্জয়কেই একমাত্র অপরাধী সাবুদ করতে আদালতে একযোগে কাজ করেছে সিবিআই ও জাতীয় আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষ। রাজ্য ও কেন্দ্রের দুই শাসকের সেটিং আর গোপন থাকল না।
মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন মামলাটি তাঁর পুলিশের হাতে থাকলে তিনি ফাঁসির আদেশ করিয়ে দিতেন। বিচারব্যবস্থায় সরাসরি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের এর চেয়ে বড় দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে! কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে মামলাগুলির তদন্তভার রাজ্যের হাতে ছিল, সেগুলিতে কি অপরাধীদের ফাঁসির সাজা হয়েছে? কামদুনির ধর্ষকরা বেকসুর খালাস পেয়ে খুলে-আম ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাঁসখালি, মধ্যমগ্রাম, কালিয়াচক, রানাঘাট, বারাসত কোথায় অপরাধীর ফাঁসির আদেশ 'করিয়ে দিয়েছন' মুখ্যমন্ত্রী?
আদালতে যেদিন সঞ্জয় রায়ের যাবজ্জীবন আদেশ হয়েছে, তার পরের দিনই রাজ্য সরকার তার ফাঁসির আবেদন করে হাইকোর্টে গেছে। দু'দিন পরে সিবিআই-ও একই আবেদন করেছে হাইকোর্টে। হাইকোর্ট রাজ্য সরকারের এই আবেদন করার আইনি এক্তিয়ার নিয়েই প্রশ্ন তুলে তা খারিজ করে দিয়েছে। সঞ্জয়ের ফাঁসির জন্য প্রথম থেকেই রাজ্য সরকার তৎপর, সঙ্গে দোসর সিবিআই, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার। কারণ, তারা উভয়েই চায় সঞ্জয়কে ফাঁসিতে লটকে একজন প্রধান সাক্ষীকে নিকেশ করতে, যাতে প্রকৃত সত্য কোনোদিন সামনে না আসে, আসল অপরাধীরা যেন আড়ালেই থেকে যায়। আগামীদিনে কেন্দ্রে ও রাজ্যে নতুন কোন সরকার এলে তারা প্রকৃত সত্য মানুষের সামনে তুলে ধরতে ও সমস্ত অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে চাইলে সঞ্জয়ের সাক্ষ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। তাই জেলের ভিতরে হলেও সঞ্জয়ের বেঁচে থাকা খুবই জরুরি। কিন্তু তার বেঁচে থাকা যাদের কাছে উদ্বেগের ও ভয়ের, তারা চাইছে তড়িঘড়ি তাকে ফাঁসিতে লটকে নিকেশ করতে। কেউ কেউ আরও অধৈর্য হয়ে চাইছে তাকে এনকাউণ্টার করে মেরে ফেলতে। অপরাধীদের আড়াল করতে দুই শাসকের এই ষড়যন্ত্র নগ্ন হয়ে গেছে জনগণের সামনে। তাই নির্যাতিতার পরিবার, বৃহত্তর অভয়ার পরিবার এবং জনসাধারণও সঞ্জয়ের ফাঁসি চাইছে না।
সন্দীপ ঘোষের দুর্নীতির মামলায় চার্জ গঠন করতে গড়িমসি করছে সিবিআই ও ইডি। রাজ্য সরকারকে 'নো-অবজেকশন' দিতে বাধ্য করেছে আদালতের ধমক। এই মামলার তদন্তে উঠে আসছে শাসকঘনিষ্ঠ সন্দীপ ঘোষ ও তার স্যাঙাৎবাহিনী কীভাবে অবাধে জাল ওষুধের কারবার চালাতো রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলিতে। সম্প্রতি সন্দেহজনক গুণমানের স্যালাইন, ইঞ্জেকশনের বলি হয়েছে দুটি প্রাণ। আরও কত প্রাণনাশ হয়েছে তার হিসাব নেই।
এত কিছুর পরেও জনতার প্রতিবাদ আন্দোলনকে এতটুকুও দমানো যায়নি। সরকার যত দাঁত-নখ বের করেছে, সুবিচার ছিনিয়ে আনার লড়াইয়ের তেজ তত বেড়েছে। দু’জন চিকিৎসককে সমন পাঠালে কয়েক হাজার চিকিৎসক সোচ্চারে মিছিল করে লালবাজার অভিযান করেছেন, ন’জন প্রতিবাদীকে রাস্তায় 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস' স্লোগান তোলার 'অপরাধে' পুলিশ গ্রেপ্তার করলে পরের দিন দেড় লক্ষ মানুষ ধর্মতলায় দ্রোহের কার্নিভাল করেন, উত্তরবঙ্গে মন্ত্রীর দলবল প্রতিবাদীদের চারটে মোমবাতিতে জল ঢেলে দিলে দক্ষিণবঙ্গে হাজার হাজার মানুষ চল্লিশ কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে মশাল মিছিলে পা মেলান। শাসক যখন সারা রাজ্যের সমস্ত সমাজবিরোধীদের এক ছাতার তলায় সংগঠিত করছে, তখন জেলায় জেলায় গড়ে ওঠা স্থানীয় প্রতিবাদী নাগরিকদের মঞ্চগুলি চিকিৎসকদের যৌথ মঞ্চের সঙ্গে মিলে 'অভয়া মঞ্চ' তৈরি করে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন।
অভয়ার সুবিচার সহ এরাজ্যে ঘটে চলা সীমাহীন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, অবাধ নারীনিগ্রহ ও প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার, মানুষের উপর অত্যাচার, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক-কর্মচারীর নিরাপত্তাহীনতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে রসাতলে পাঠানো, প্রশাসনকে অপরাধী-বান্ধব ও দলদাস হিসাবে চালিত করা ও রাজ্যের প্রতিটি কোণায় হুমকির সংস্কৃতি, ভয় দেখানোর রাজনীতির বিরুদ্ধে শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত পেশাজীবী মানুষের ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই সুবিচার ছিনিয়ে আনার একমাত্র রাস্তা। অভয়ার জন্মদিনে আবার গণআন্দোলনের জোয়ারে ভাসতে চলেছে রাজ্যের প্রতিটি জেলা। আলিপুরদুয়ার থেকে ডায়মন্ডহারবার, কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার, বাংলার নিজের মেয়ের, ঘরের মেয়ের সুবিচার ছিনিয়ে আনার লড়াই জোরদার করতে জোট বাঁধছে ছাত্র-যুব-মহিলা। এই বসন্তে পলাশ নয়, ধর্ষিতা বোনের রক্তচোখ, ফাগুনের ফুল নয়, আগুনের ফুলকি হোক।
Comments :0