Prabhat Pattnaik on Lok Sabha Election

ফ্যাসিবাদ না গণতন্ত্র, ঠিক করবে এই ভোট

জাতীয়

 

 (অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়েকের সাক্ষাৎকার)



প্রশ্নঃ- ১।  কয়েকদিনের মধ্যেই দেশে অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন হতে চলেছে। বিগত নির্বাচনগুলির  তুলনায় এবারের নির্বাচনের বিশেষত্ব কী এবং কেন?


 

ঊত্তরঃ- ১। আসন্ন নির্বাচন দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর মধ্যে দিয়ে নির্ধারিত হবে দেশ তার গণতান্ত্রিক চরিত্র ধরে রাখবে নাকি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের দিকে যাবে। আজ আমাদের দেশের  ক্ষমতায় রয়েছে এক নয়া ফ্যাসিবাদী শক্তি যারা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে শ্বাসরোধ করছে; সোজা কথায়, দেশ ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের দিকে এগোচ্ছে কিন্তু এখনও ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠেনি। এই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের দিকে এগোনোর প্রবণতা থেমে যাবে এবং বিপরীত দিকে যাত্রা শুরু হবে কিনা তা আগামী নির্বাচনই ঠিক করবে।

আমি যখন ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের কথা বলছি তখন আমি শুধু স্বৈরাচারী  রাষ্ট্র বলতে চাইছি  না। আমি এমন একটি স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের কথা  বলতে চাইছি যেটি রাস্তার গুন্ডাদের নিপীড়নের সাথে রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচারকে একত্রিত করে; যেটি বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যালঘুদের সাথে "ভিন্ন" হিসাবে আচরণ করে এবং তাদের প্রতি ঘৃণা উসকে দেয়; যেটি একচেটিয়া পুঁজির সঙ্গে, বিশেষ করে একচেটিয়া পুঁজির নতুন স্তরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত; যেটি সামাজিক জীবনে অযৌক্তিকতাকে উৎসাহিত করে এবং নেতার ব্যক্তিপুজোকে উদ্ভাসিত করে - এক কথায়, যাকে আলবার্ট আইনস্টাইন এবং অন্যরা একসময় "নেতা রাষ্ট্র" বলে অভিহিত করেছিলেন। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির আদৌ অর্থ থাকবে কি না, নাকি একচেটিয়া পুঁজির প্রত্যক্ষ একনায়কতন্ত্র কায়েম হবে তা আগামী নির্বাচনই নির্ধারণ করবে। দেশ আজ যেভাবে কঠোর পছন্দ বেছে নেওয়ার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে এর আগে তা কখনো হয়নি।


 

প্রশ্নঃ- ২। পুঁজিবাদের সঙ্কট এবং ফ্যাসিবাদী ধারণার উত্থানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কীভাবে ভোটারদের সামনে তুলে ধরা করা যেতে পারে? 


 

উত্তরঃ- ২। প্রতিটি শাসনব্যবস্থারই নিজেকে ন্যায্য বলে তুলে ধরার জন্যে আখ্যান প্রয়োজন। এই সেদিন  পর্যন্ত নয়া -উদারনীতিবাদ "দ্রুত বৃদ্ধি"-র আখ্যান ব্যবহার করে বলছিলো এমনকি যে শ্রমজীবী জনগণের হাল-হকিকত নয়া -উদারনীতিবাদের কারণে সঙ্গীন হয়ে উঠছে, তারাও দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির "চুঁইয়ে পড়া" প্রভাব থেকে শেষমেষ উপকৃত হবে। সংকট ঘনীভূত হওয়ার সাথে সাথে এই আখ্যানটি তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। এমনকি যখন অর্থনৈতিক  বৃদ্ধি বেশি ছিল তখনও শ্রমজীবী মানুষ নয়া-উদারবাদী শাসনের অধীনে অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। উদ্ভুত সংকট তাদের তীব্রতর দুর্দশার মধ্যে ঠেলে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত "চুঁইয়ে পড়া" উন্নয়নের কোনও প্রতিশ্রুতি তাদের কাছে আদৌ বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি। তখনই একচেটিয়া বুর্জোয়ারা ফ্যাসিবাদী শক্তির  দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাদের সাথে জোট করে ফ্যাসিস্টদের বিকল্প আখ্যানের প্রচার শুরু করে যেখানে মুসলিমদের "ভিন্ন " করার উপর জোর দেওয়া হয় যা তাদের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করে এবং হিন্দু অস্মিতার গর্ব সামনে নিয়ে আসে।

অন্য ভাবে বললে, এই ভাবে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের ভাষ্য জীবনযাপনের বস্তুগত অবস্থাভিত্তিক ভাষ্যকে প্রতিস্থাপন করে। পরের ভাষ্যটা যে পুরোপুরি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে এমনটা নয়; সঙ্কটকে অস্বীকার করার জন্য বিপুল পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে, ভান করা হচ্ছে যে দ্রুত বৃদ্ধি এখনও অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু এই ভাষ্যকে গৌণ করে দিয়ে ব্যাপকভাবে জোর দেওয়া হয়েছে মুসলিম-বিরোধী জিগিরের ওপর। এটি উল্লেখযোগ্য যে বর্তমানে ক্রমবর্ধমান বিশাল বেকারত্বের মধ্যে সরকার অযোধ্যায় একটি মন্দির নির্মাণকে ঐতিহাসিক অর্জন হিসাবে তুলে ধরে এটিকে নিজেদের এক দশকের শ্রেষ্ঠ  কীর্তি বলে দাবি করছে।


 

প্রশ্নঃ- ৩।  যে কথাটি প্রায়শই ব্যবহৃত হয় তা হল কর্পোরেট সাম্প্রদায়িক আঁতাত। এই কর্পোরেট সাম্প্রদায়িক আঁতাতের বিকাশের কারণ কী?


 

উত্তরঃ- ৩। এই কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক আঁতাত সংকটের সেই পর্যায়ে উদ্ভূত যখন পুঁজিবাদের স্বাভাবিক আত্মসমর্থনমূলক আখ্যান আর পর্যাপ্ত থাকে না এবং তার হিন্দুত্বের আখ্যানের সাথে যুক্ত হওয়া একটি বাধ্যতায় পরিণত হয়। এখন একচেটিয়া পুঁজির শাসন চলছে, কিন্তু হিন্দুত্ব নামক একটি অতিরিক্ত ঠেকনায় ভর করে। পোলিশ অর্থনীতিবিদ মিশাল ক্যালেকি ফ্যাসিবাদকে বড় বুর্জোয়া এবং ফ্যাসিবাদী ভূইঁফোড়দের মধ্যে অংশীদারিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই ধরনের অংশীদারিত্ব বৃহৎ বুর্জোয়াদের জন্য তখনই প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে যখন সংকট তাদের স্বাভাবিক সাফাইগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা কেড়ে নেয়। ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলিকে কাকে "ভিন্ন" হিসাবে চিহ্নিত করবে তার পরিচয় দেশ থেকে দেশে এবং যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়। জার্মানিতে পূর্ববর্তী সময়ে ইহুদিরা "অন্যরকম" ছিল; এখন অন্যত্র অভিবাসীদের ভিন্ন  হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। ভারতে যদিও মুসলমানদের প্রাথমিকভাবে "ভিন্ন" বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু যেহেতু এই ক্ষেত্রে শত্রুতার লক্ষ্যগুলি সাধারণত একাধিক হয়, আমাদের দেশের টার্গেটের তালিকায় দলিত এবং খ্রিস্টানরাও রয়েছে। এবং অবশ্যই বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবীরা সর্বত্র সব দেশে এই শাসনের লক্ষ্যবস্তু। 

সুতরাং, কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক অক্ষ হল সেই বিশেষ রূপ যা ফ্যাসিবাদ আমাদের নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে - দেশভাগের দিনগুলি থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতার পরিপ্রেক্ষিতে- এদেশে গ্রহণ করেছে।


 

প্রশ্নঃ- ৪। আরএসএস-এর হিন্দু রাষ্ট্র কি এদেশের প্রায় আশি শতাংশ হিন্দু মানুষের জন্য সত্যিই উপকারী? শ্রমিক শ্রেণি এর বিরোধিতা করবে কেন?


 

উত্তরঃ- ৪। হিন্দু রাষ্ট্র কথাটি একটি অপপ্রয়োগ। এটার মানে  মোটেও হিন্দুদের শাসন নয়। বরং এর অর্থ হল এক শ্রেণীর লোকের দ্বারা একচেটিয়া পুঁজিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠা, যারা মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা জাগিয়ে "হিন্দুদের" এই শাসন সমর্থনে  প্ররোচিত করতে পারে। তারা একটি বক্তব্য উপস্থাপন করে যে, মধ্যযুগীয় ভারতে হিন্দুরা মুসলমানদের দ্বারা "নিপীড়িত" হয়েছিল এবং এই অন্যায় আজ হিন্দু রাষ্ট্রের মাধ্যমে সংশোধন করতে হবে।

কিন্তু এই ব্যাখ্যাটি অনৈতিহাসিক  এবং অযৌক্তিক। মধ্যযুগে যা ঘটেছিলো তা "হিন্দুদের" উপর "মুসলিমদের" নিপীড়ন নয়, তা হলো  স্থানীয় জমিদারদের উপর চাপিয়ে দেওয়া সম্রাট-নিয়ন্ত্রিত আমলাতন্ত্রের দ্বারা একটি কৃষিভিত্তিক সমাজে কৃষকদের ওপর চূড়ান্ত  উৎপীড়ন। এক্ষেত্রে অত্যাচারীদের কী  ধর্ম ছিল তা অমূলক: যেমন বাংলায় আজও বর্গীদের লুটেরা বলা হয় কারণ তারা কৃষকের ফসল লুঠ করতে এসেছিল; কিন্তু এই বর্গীরা মুসলমান ছিল না, তারা ছিল হিন্দু। একইভাবে, হিন্দু রাষ্ট্রের অধীনে অতীতের এই "অন্যায়"গুলির "সংশোধন" কোনভাবেই সাধারণ হিন্দুদের জীবনকে উন্নত করবে না; তাদের দুর্দশা বরং আরও বাড়বে কারণ এর আড়ালে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের অবাধ রাজত্বের সুযোগ তৈরী হবে। 

শ্রমিক শ্রেণীকে অবশ্যই এই হিন্দু রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে হবে কারণ এটি শ্রমিক শ্রেণীকে হিন্দু ও মুসলমানে বিভক্ত করে সংগ্রামী  ঐক্যকে নিরস্ত্র করবে, যার ফলে একচেটিয়া পুঁজির শাসন সহজতর হবে।


 

প্রশ্নঃ- ৫।  মোদি সরকার শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার মূল কারণ কী? এর চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে?


 

উত্তরঃ- ৫। মোদি সরকার শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে কারণ মোদি সরকার একচেটিয়া পুঁজির শাসনের প্রতিনিধিত্ব করে। সমস্ত আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজেই ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠী  আছে  কিন্তু তাদের উপস্থিতি প্রান্তিক উপাদান হিসাবে; একমাত্র একচেটিয়া পুঁজির প্রয়োজন হলেই তারা কেন্দ্রীয়  মঞ্চে আসে, এবং এটি শুধুমাত্র সংকটের সময় ঘটে। একচেটিয়া পুঁজি এদেরকে অর্থ দিয়ে এবং তাদের পেটোয়া  মিডিয়ার সমর্থন দিয়ে সহায়তা করে। নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন: হঠাৎ করে কীভাবে বিজেপি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা উদারবাদী বুর্জোয়াদের দল  কংগ্রেসকে ঢের পেছনে ফেলে রেখে  দেশের সবচেয়ে ধনী দল হয়ে উঠল? এটি ঘটেছে কারণ একচেটিয়া বুর্জোয়ারা এখন নয়া ফ্যাসিবাদী দল বিজেপির পিছনে তাদের সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছে।

মোদির 'সুখ্যাতির' প্রধান কারণ হল তিনি একদিকে একচেটিয়া পুঁজি এবং অন্যদিকে আরএসএসের মধ্যে সেতুবন্ধন ঘটিয়েছেন; প্রকৃতপক্ষে মোদিকে প্রধানমন্ত্রী করার ধারণাটি তাঁর গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সর্বপ্রথম একটি "বিনিয়োগকারীদের সম্মেলনে" উত্থাপিত হয়েছিল। মোদি যেহেতু একচেটিয়া পুঁজির, বিশেষত তার নয়া অংশের সৃষ্টি, শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি তার বিদ্বেষভাব খুবই স্বাভাবিক।


 

মোদির ক্ষমতায় উত্থান, বা তাকে ক্ষমতায় আনার জন্য একচেটিয়া পুঁজির প্রচেষ্টা সফল হত না যদি না নয়া-উদারনীতির মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণী দুর্বল হত। ফ্যাসিবাদের উদ্ভব ঘটে একটি সংকটের কারণে ; আবার  জার্মান দার্শনিক ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের ভাষায়  এটি ঘটে  প্রতিবিপ্লবের পিঠে চড়ে। বেঞ্জামিন অবশ্য জার্মানির কথা বলেছিলেন; কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এটা ঘটল নয়া -উদারনীতির ফলে  শ্রমিকশ্রেণীর দুর্বলতার কারণে , রাষ্ট্রায়ত্ত  ক্ষেত্রের  বেসরকারিকরণের মাধ্যমে, অর্থনীতিকে বহুজাতিক পুঁজির সামনে উন্মুক্ত করার মধ্যে দিয়ে এবং ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের দ্বারা। এই বিষয়গুলিই মোদির ক্ষমতায় আরোহণের পূর্ব শর্ত তৈরি করেছে।


 

প্রশ্নঃ- ৬। কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করার পরেও, কৃষকরা আন্দোলনের আরেকটি পর্যায়ের পথে - আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?


 

উত্তরঃ- ৬। নয়া উদারনীতিবাদের এজেন্ডা হলো কৃষির ওপর কর্পোরেট আধিপত্য কায়েম করা। এটি ডব্লিউটিও-র মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের গৃহীত এজেন্ডা, যা চায় কৃষিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হোক। এবং এটাই এখন ভারতীয় কর্পোরেট মহলেরও  এজেন্ডা যা ব্যাপকভাবে কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। এই ধরনের কর্পোরেট আধিপত্যের একটি উদ্দেশ্য হ'ল কৃষিকে খাদ্য শস্য উৎপাদন থেকে বেশি বেশি  দূরে সরিয়ে রেখে বিশ্ববাজারে চাহিদা আছে এরকম অন্যান্য ফসলের উৎপাদনের দিকে নিয়ে যাওয়া, অর্থাৎ কৃষিকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্ববাজারমুখী করে তোলা।


 

এর অবধারিত ফল হবে আমাদের খাদ্য সরবরাহের জন্য উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া যার অনিবার্য পরিণতি গণ বন্টন ব্যবস্থার অবসান ।

তাই কর্পোরেট এজেন্ডা শুধু কৃষকদের স্বার্থের বিরুদ্ধে নয়, খাদ্যশস্য গ্রহণকারী জনসাধারণেরও বিরুদ্ধে কারণ তারা তাদের খাদ্যের জন্য খোলা বাজারের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে বাধ্য হবে এবং কর্পোরেট লোভ ও জুলুমবাজির শিকার হবে। মোদি সরকার এই নয়া-উদারবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই কারণেই ওরা তিনটি কৃষি-আইন প্রণয়ন করেছে যা খাদ্যশস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকারী সহায়ক মূল্য ব্যবস্থাকে তুলে দেবে (এগুলি ইতিমধ্যেই অর্থকরী ফসল উৎপাদন থেকে সরানো হয়েছে)।

এটা বাস্তব যে দুর্বার কৃষক আন্দোলনের সামনে সরকার পিছু হটেছিল। কিন্তু যেহেতু এই সরকারের অস্তিত্ব সাম্রাজ্যবাদ এবং দেশীয় বৃহৎ ব্যবসার সমর্থনপুষ্ট এবং তাদের এজেন্ডার প্রতিই এই সরকার দায়বদ্ধ, তাই খাদ্যশস্যের সহায়ক মূল্যের জন্য কৃষকদের সংগ্রাম, যেটি আদতে খাদ্যশস্য উৎপাদন অব্যাহত রাখার সংগ্রাম, তা শেষতক জারি রাখতে হবে।


 

প্রশ্নঃ- ৭। জিএসটি, স্টিমুলাস প্যাকেজ  - এগুলি কি মানুষের উপকার করেছে? আপনার মতে নোটবন্দি  কাদের সুবিধার জন্য ছিল?

উত্তরঃ-৭। মোদি সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের সাধারণ প্রবণতা হল ক্ষুদ্র উৎপাদন ক্ষেত্রকে ধ্বংস করা এবং অর্থনীতিতে পুঁজির পুঞ্জীভবন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা। জিএসটি এবং নোটবন্দী, তাদের অন্যান্য প্রভাবগুলি ছাড়াও, ক্ষুদ্র উৎপাদন ক্ষেত্রকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। নোটবন্দীর কারণে এই ক্ষেত্রে উত্পাদিত পণ্যের চাহিদা কমেছে, যার ফলে এই ক্ষেত্রের উৎপাদক ঋণের ভারে জর্জরিত হয়েছে এবং ঋণের অদম্য বোঝা এই ক্ষেত্রকে পঙ্গু করে দিয়েছে। একইভাবে, জিএসটি মানে হলো বেনারসি শাড়ির মতো এমন সমস্ত পণ্যের উপর কর যা এতদিন পর্যন্ত করমুক্ত ছিল। আরো একটি বিষয় ঘটেছে। এই ক্ষেত্রের ওপর চেপেছে খুঁটিনাটি  হিসাব বজায় রাখার জন্য অতিরিক্ত ব্যয় যা এই ক্ষেত্রের লভ্যাংশের ওপর থাবা বসিয়েছে ।

নোটবন্দী এবং জিএসটি দুটোর কোনোটাই মোদির মৌলিক ভাবনা নয়।দুটোই সাধারণভাবে আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের  অনুমোদিত ব্যবস্থা।  

একইভাবে, উদ্দীপক(স্টিমুলাস ) প্যাকেজের নামে পুঁজিপতিদের কর ছাড় সামগ্রিক চাহিদা কমায় এবং সংকটকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এফআরবিএম আইনের সীমাবদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে, এই ধরনের ছাড়ের দায় মেটাতে  হয় অন্যত্র সরকারি খরচ কমানো হচ্ছে  নয়তো শ্রমজীবী মানুষের ওপর চড়া  কর চাপানো  হচ্ছে যার অনিবার্য পরিণতিতে তারা তাদের ব্যয় কমিয়ে দিচ্ছে। অপর দিকে পুঁজিপতিদের দেওয়া অর্থ কোনো সমতুল্য অতিরিক্ত ব্যয় তৈরি করে না এবং অবশ্যই কোনো অতিরিক্ত বিনিয়োগও ঘটেনা   (যেহেতু কর্পোরেটদের বিনিয়োগ বাজারের প্রত্যাশিত বৃদ্ধি বিবেচনার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় তা এই ধরনের কর ছাড়ের কারণে বাড়ে না)। তাই নিট ফল হল সামগ্রিক চাহিদা হ্রাস। সেই কারণে সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।

সংক্ষেপে মোদি সরকার একটি ফান্ড -ব্যাঙ্ক-অনুমোদিত নীতি অনুসরণ করছে যা মৌলিকভাবে অর্থনীতিতে সম্পদের ঘনত্ব বাড়ায় এবং সংকটকে আরও বাড়িয়ে তোলে।


 

প্রশ্নঃ- ৮। অতিমারী চলাকালীন এই সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কি কোনো অর্থে দেশের জন্য ভালো হয়েছে?


 

উত্তরঃ- ৮। মহামারীতে মোদী সরকারের কাজ বলতে ছিল লোকজনকে তাদের আয়ের ক্ষতির জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়ে একটি কঠোর লকডাউন আরোপ করা। লকডাউন চলাকালীন ঘর ভাড়া দিতে না পারার কারণে   ভাড়াটেদের যে আবাসস্থল থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছিল সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র প্রতিবিধান এই সরকার করেনি। এই দুই বিষয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য দেশ  অনেক বেশি সংবেদনশীলভাবে কাজ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার লকডাউনের সময় ভাড়াটে উচ্ছেদের উপর স্থগিতাদেশ আরোপ করেছিল এবং শ্রমিকদের তাদের আয়ের ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করেছিল।

ভারতে হাজার হাজার শ্রমজীবী ভিন রাজ্যে কোন আয় বা বাসস্থান না থাকায় তাদের নিজেদের গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল, যা সরকারের ঔদাসীন্যের মর্মান্তিক সাক্ষ্যবাহী। মনরেগা প্রকল্প সৌভাগ্যবশত এই বিপর্যয় মোকাবিলায় খানিকটা প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছিল, কারণ যারা শহর থেকে গ্রামে ফিরে এসেছিল তারা এই প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু কাজ পেতে সক্ষম হয়েছিল।

অতিমারী মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যে বৈপরীত্য আরো স্পষ্ট হয় যখন দেখি যে অতিমারী চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনগণের সহায়তায় বিভিন্ন প্রকল্পে জিডিপির মোট ১০ শতাংশ ব্যয় ঘটে যেখানে ভারতে তা ছিল মাত্র ২ শতাংশ। মহামারী চলাকালীন মোদী সরকারের নির্মমতা ছিল লজ্জাজনক; কিন্তু এই নির্মমতার মধ্যেও এটা পরিষ্কার যে সরকার নয়া উদারবাদের নীতিগুলিকে কঠোরভাবে মেনে চলেছিল, যার প্রধান ভিত্তি হলো সরকারি ব্যয় সংকোচন।


 

প্রশ্নঃ- ৯। ২০১৪-২০২৪ মোদির অর্থনৈতিক নীতিতে  দেশ কি আসলে এগিয়েছে  নাকি পিছিয়ে গেছে?


 

ঊত্তরঃ- ৯। অনেক ভাষ্যকার এটা ভেবে ভুল করেন যে গত দশকের অর্থনৈতিক নীতিগুলি মোদীর মস্তিষ্কপ্রসূত। কিন্তু দি এসব নীতি উদ্ভাবন করেননি; তিনি বেপরোয়া এবং আক্রমনাত্মকভাবে একটি নয়া -উদারবাদী এজেন্ডা অনুসরণ করে চলেছেন। নয়া -উদারনীতিবাদ এমন এক সংকটের সময়ে প্রবেশ করেছে নয়া-উদারনীতিবাদের কাছে যার কোনো সমাধান নেই। তাই এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে এই সঙ্কটের সময়ে মোদি সরকারের নব্য-উদারনীতিবাদের আগ্রাসী সাধনা সংকটকে ক্রমাগত আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

সাধারণ মানুষের জন্য মোদী আমলে পরিস্থিতি দিনকে দিন কীভাবে আরো খারাপ হয়েছে তা বোঝার জন্য একটি খুব সাধারণ সূচকের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। পরিকল্পনা কমিশন মূলত গ্রামীণ ভারতে মাথাপিছু ২২০০ ক্যালোরি এবং শহরাঞ্চলে ২১০০ ক্যালোরিকে দারিদ্র্যসীমা হিসাবে গ্রহণ করেছিল। ২০১১-১২ এবং ২০১৭-১৮-র মধ্যে এই বেঞ্চমার্কের নিচে নেমে আসা মোট জনসংখ্যার অনুপাতের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির কারণে ২০১৭-১৮ সালে ভোক্তা ব্যয়ের উপর সমীক্ষার ফলাফল সরকার চেপে গিয়েছিল ।পরবর্তী বছরগুলির ক্ষেত্রে আমাদের কাছে এনএসএস থেকে কোনও পুষ্টির তথ্য নেই তবে মহামারীর হিংস্র হস্তক্ষেপের কারণে এটি আশঙ্কা করা যেতেই পারে যে বিষয়টি আরও ঘোরালো হয়েছে; আর সরকারের যে নিজস্ব ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে প্রকাশিত হয়েছে তা  এই আশঙ্কাকে আরও জোরালো করে।


 

প্রশ্নঃ- ১০। এই নির্বাচনের পর যে সরকার গঠিত হবে তার কাছ থেকে শ্রমিক শ্রেণির কী ধরনের নীতি পরিবর্তনের দাবি করা উচিত?

ঊত্তরঃ- ১০। আমি মনে করি শ্রমজীবী জনগণকে অবশ্যই মোদি-পরবর্তী সরকারের কাছে ভারতে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য দাবি জানাতে হবে। এর অর্থ কোনোভাবেই শুধু ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কিছু ভাতা বা দরিদ্রদের জন্য মৌলিক ন্যূনতম মজুরি বোঝায় না কারণ এই জাতীয় সমস্ত স্কিম এক মুহূর্তের নোটিশে প্রত্যাহার করা যেতে পারে। এর পরিবর্তে যা প্রয়োজন তা হল সংবিধানের এমন একটি সংশোধনী যা একগুচ্ছ সর্বজনীন এবং ন্যায়সঙ্গত মৌলিক অর্থনৈতিক অধিকারকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করবে ।

আমি অবিলম্বে এই জাতীয় পাঁচটি অধিকারের পরামর্শ দেব: খাদ্যের অধিকার, যার মানে হলো মহামারীর আগে বিপিএল জনসংখ্যার মতো একই শর্তে প্রত্যেকের জন্যে খাবারের সংস্থান  করা ; কর্মসংস্থানের অধিকার, যা দিতে ব্যর্থ হলে সরকারকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অবশ্যত সম্পূর্ণ বিধিবদ্ধভাবে নির্দিষ্ট মজুরি প্রদান করতে হবে; সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ন্যূনতম উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে মানসম্পন্ন শিক্ষার অধিকার (শিক্ষা বিনামূল্যে হতে পারে তবে শুধুমাত্র তাদের জন্যে যাদের উচ্চ শিক্ষাযা র রুচি আছে); জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার মাধ্যমে সর্বজনীনভাবে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার অধিকার; এবং আজীবন সর্বজনীন অ-অনুদানমূলক বার্ধক্য পেনশন এবং প্রতিবন্ধকতাজনিত সুবিধা পাওয়ার অধিকার।

আমার হিসাব অনুযায়ী এই সমস্ত অধিকারের জন্য যা খরচ হবে তা এই ক্ষেত্রগুলিতে যা ব্যয় করা হচ্ছে তার ওপরে জিডিপির অতিরিক্ত ১০ শতাংশ এবং এই অর্থ  জনসংখ্যার শীর্ষ  ১ শতাংশের উপর মাত্র দুটি কর লাগু করে সংগ্রহ যেতে পারে: প্রথমটি  ২ শতাংশ সম্পদ কর; এবং দ্বিতীয়টি যে কোনো সম্পত্তির হস্তান্তরে সেই সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ মূল্যের একটি উত্তরাধিকার কর। 

এসব অধিকার অবাস্তব নয়। এগুলি প্রতিষ্ঠিত করা খুবই সম্ভব। শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। এবং যদি নব্য উদারপন্থী শাসনগুলি এই অধিকারগুলি অর্জনের পথে বাধা হয় তবে আমাদের অবিলম্বে নয়া  উদারনীতি থেকে প্রয়োজনীয় বিচ্ছিন্নতার পথ  গ্রহণ করতে হবে।

 

Comments :0

Login to leave a comment