জ্যোতি বসু
(২৪ জানুয়ারি, ১৯৯০ বিধানসভায় ভাষণ)
স্পিকার মহাশয়, যে সব সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছেন তার বিরুদ্ধে এবং যে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে ধন্যবাদ জ্ঞাপন সেটাকে সমর্থন করে দু’-একটা কথা বলতে চাই। যতটা আমি এখানে শুনলাম, যা নোট দেওয়া হয়েছে, বক্তব্যে যা বলেছেন বিশেষ করে বিরোধী দল থেকে তার অনেকগুলির জবাবের কোনও ব্যাপার নেই। কারণ রাজ্যপালের বক্তব্যের সঙ্গে সেটা প্রাসঙ্গিক নয়, কোনোরকম সম্পর্ক নেই। যেমন এখানে কিছু না পেয়ে চলে গেলেন রুমানিয়াতে। এটা বলেছেন কিনা জানি না, পানামা কেন আক্রমণ করলো আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ। এইসব এখানে আলোচনার বিষয় নয়। এখানে পাঞ্জাব, কাশ্মীর এইসব গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই বিষয়ে আমাদের গভর্নরের কিছু করার নেই। কাজেই যে সব কথা এখানে বলবার নয় সেগুলি বলা হয়েছে। সেই সবের মধ্যে আমি যাচ্ছি না। একটা কথা বার বার বলেছি, এখানে জবাব দেওয়ার সময়ও বলে দিই এই দিকে যাঁরা আছেন ওই দিকে যাঁরা আছেন তাঁদেরও — আমার বক্তব্য যে ধর্ম এবং রাজনীতিকে কখনও মেশাবেন না। এটা মেশালে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমাদের যে সংবিধান আছে তা হলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তার জন্য আমরা গর্বিত। এটা হওয়া উচিত। আমাদের পাশে অনেক প্রতিবেশী রাষ্ট্র আছে এখানটা সেখানকার মতো নয়। সেখানে কোনও একটা ধর্ম আছে, সেটা কোনও একটা ধর্মের রাষ্ট্র। এটা আমরা চাই না, এটাই আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। আমরা দেখেছি ভারতবর্ষের নির্বাচনে এই জিনিস থাকেনি। নানা সংস্থা আছে যারা ধর্ম এবং রাজনীতি মিলিয়েছেন এবং বিশেষ করে রাম জন্মভূমি এবং বাবরি মসজিদ নিয়ে। আমি অসংখ্য খোলা মিটিং-এ বলেছি যে ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ হতে পারে না, এটা সংরক্ষিত আছে, সেই অধিকার আমাদের সংবিধানে আছে যে, যে যার ধর্ম পালন করবেন। কিন্তু এটা মেশালে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সংবাদপত্রে আমরা দেখেছি, সেখানে কি হলো? রাম জন্মভূমি এবং বাবরি মসজিদ নিয়ে সেখানে মামলা আছে। কোর্টে অযোধ্যার স্থান নিয়ে মামলা আছে। সেই মামলা থাকা সত্ত্বেও অনুমতি দেওয়া হলো শিলান্যাস করতে সেখানে। কংগ্রেস সরকার অনুমতি দিলেন, কেন কোর্টকে জিজ্ঞাসা করলেন না? অ্যাডভোকেট জেনারেলকে জিজ্ঞাসা করে বললেন যে এখানে শিলান্যাস হবে। এটাতে আমাদের আপত্তি ছিল যে, জায়গা কি করে ঠিক হলো। রাম জন্মভূমিতে একটা মন্দির হতে পারে, রাম জন্মভূমিতে অনেক রামের মন্দির আছে, আরও একটা মন্দির হলে ক্ষতি কি আছে। আরও একটা মসজিদ হলে ক্ষতি কি আছে। আরও একটা মন্দির বা মসজিদ হলে কেউ কিছু বলতো না। কিন্তু একটা মসজিদ ধ্বংস করে আরও একটা রাম মন্দির করা এটা এখন কি করে হয়। এটাতো বিচারে আছে। এটাতে আমাদের আপত্তি আছে। যেহেতু এটা বিচারাধীন আছে সেখানে কি করে শিলান্যাস হয়ে গেল নির্দিষ্ট জায়গায়। বাইরে করলে কোনও কিছু বলার ছিল না। যাঁরা রামকে ভালোবাসেন রামকে পূজা করেছেন, কি আছে তাতে? সেইসব কথা আমি পরিষ্কার করে বলেছি। এখানে রামশিলা পূজার কথা ঘোষণা করা হলো। আমি সেখানে একই কথা বলেছিলাম, আপনারা যে কোনও জিনিসের পূজা করতে পারেন, আপনারা পূজা করুন, ক্ষতি কি? কেউ হয়তো রাগ করলেন বাংলা ভাষা জানি না বলে— বলেছি যে ইট পুজো। একটা দুটো মিটিং-এ এই কথা বলেছিলাম। তাতে নাকি আমি হিন্দুদের সেন্টিমেন্টে আঘাত করেছি। বলেছেন, শিলাপূজা কেন বললেন না? আমার থেকে ভালো বাংলা-টাংলা জানেন তাঁদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তাঁরা বললেন, দু’টি জিনিস তো এক নয়। শিলা আর ইট এক না। আপনি এই কথা বলে কিছু ভুল করেননি, এটা তাঁদের অনেকে বলেছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন যে, ওঁদের আঘাত লেগেছে। আমি বলেছিলাম আপনারা পূজা করুন, কিন্তু মিছিল ইত্যাদি করবেন না এবং অন্য ধর্মের প্রতি আঘাত করবেন না। এই কথা আমরা বারবার করেই বলেছি। আর সেজন্য বলেছি নিজের নিজের বাড়িতে আপনারা পূজা করুন। সৌভাগ্যবশত পশ্চিমবাংলায়, এটা আমাদের এদিককার কথা নয়, পূজা মণ্ডপে অনেকেই গিয়েছিলেন যে তাঁরা দেখেছেন। যখন এখানে দুর্গাপূজা হচ্ছে তখন ওঁদের অনেকে আমাকে বলেছিলেন যে তাঁরা এখানে শিলা পূজা করবেন। পূজা মণ্ডপের কর্তৃপক্ষ বললেন যে তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে পূজা করবেন। এটা তাঁরা বরাবরই করেন। তাঁরা আরও বলেন, এটা আমাদের জাতীয় উৎসবের মতো, এটা আমরা করবো। আমি শুনেছি অনেক জায়গায় ঐ শিলাপূজা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। শিলাপূজা যা হয়েছে তা খুব বেশি জায়গায় নয়, দু’-একটা জায়গায় হয়েছে। এটা পশ্চিমবাংলায় চেতনার পরিচায়ক। এটা এখানকার সবার চেতনার পরিচায়ক। কারণ, তা না হলে এটা হলো কী করে? এটা অন্য জায়গা হলে কি হতো? সে জন্য আমরা এরজন্য একটু গর্ব করবো না? এই কারণেই এই কথাটা একটু পরিষ্কার করে বললাম। আমরা পূজা করেছিলাম। দুটো জায়গায় কথা দিয়েও ওঁরা কথা রাখেননি। মালদহ এবং আসানসোলের একটা জায়গায় ওঁরা কথা রাখেননি। আমাদের সেজন্য পুলিশের হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। যাই হোক, ওঁরা বললেন, আমরা পূজা করেছি, এবারে আমাদের এই ইটগুলো নিয়ে যেতে হবে। আমরা বাধা দিতে পারি না। কেউ যদি লরিতে করে চাপিয়ে ইট নিয়ে যেতে চায় তাহলে আমরা বাধা দিতে পারি না। আমি বলেছিলাম আপনারা ইট নিয়ে যান। কিন্তু সেগুলো এমন জায়গা বা এমন এলাকা দিয়ে নিয়ে যেতে হবে যাতে কোনও গোলমালের আশঙ্কা না থাকে। অন্য সম্প্রদায়ের মনের উপরে যে কোনও আঘাত না লাগে সে জন্য সঙ্গে পুলিশ যাবে। পুলিশ সঙ্গে গিয়ে বিহার সীমান্তে ছেড়ে দেবে। এইজন্য বিহারের বর্ডার পর্যন্ত পাঠিয়েছিলাম। তারপর ওখান থেকে বিহার সরকারের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল। এখন এই যে মৌলবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে, এর বিপদ হিন্দুদের মধ্যে যেমন আছে তেমনি মুসলমানদের মধ্যেও আছে। সবাই মিলে এই মৌলবাদের বিরোধিতা করতে হবে। বিরোধী পক্ষে যাঁরা আছেন তাঁদের এবং আমাদের এর বিরোধিতা করতে হবে। এছাড়া আমাদের পথ নেই। এটা না করলে আমরা ভারতবর্ষকে বাঁচাবো কি করে? কাজেই এই জিনিসটা সকলে মিলে করতে হবে। বিপদটা এখন বাড়ছে। নির্বাচনের সময়ে মিটিং করতে গিয়ে বলেছিলাম যে কংগ্রেস হারবে। কিন্তু এখন যে আবহাওয়া সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করতে কতদিন লাগবে নির্বাচনের সময়ে এই কথাটা পরিষ্কার করে বলেছিলাম।
Comments :0