MPs suspended

একলপ্তে খাঁড়া ৭৮’র ঘাড়ে

জাতীয়

দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে গেল নরেন্দ্র মোদীদের আমলে। সোমবার রাজ্যসভা-লোকসভা মিলে সাসপেন্ড করা হলো ৭৮ জন বিরোধী সাংসদকে। এত জন সাংসদকে একদিনে সাসপেন্ড করার ঘটনা অতীতে ঘটেনি। বিরোধীদের দোষ, সংসদের নিরাপত্তা গাফিলতি নিয়ে তাঁরা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের বিবৃতি দাবি করেছিলেন! এমন এক ন্যায্য দাবিকে তোয়াক্কা না করে উলটে তাঁদের বিরুদ্ধেই ‘অসংসদীয়’ আচরণের অভিযোগ এনে সাসপেন্ড করে দেওয়া হলো সংখ্যাধিক্যের জোরে। গত সপ্তাহেই রাজ্যসভার একজনের সঙ্গে আরও ১৩ জন লোকসভার সাংসদকে একই কারণ দেখিয়ে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। অর্থাৎ মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে মোট ৯২ সাংসদকে সাসপেন্ড করা হলো। বিরোধীরা মনে করছে, সংসদ অধিবেশনের বাকি কয়েকদিনে বিনা বাধায় বিতর্কিত বিল পাশ করিয়ে নেওয়ার কৌশল থেকেই এতজন সাংসদকে এক লপ্তে সাসপেন্ড করে দেওয়ার কৌশল নেওয়া হলো। বিরোধীশূন্য সংসদই চলবে বাকি কয়েকদিন। সেকারণেই একে ‘চূড়ান্ত একনায়কতন্ত্র’ বলেও অভিযোগ করেছে বিরোধীরা। ‘গণতন্ত্রকে আবর্জনার ড্রামে’ ফেলা দেওয়া হলো বলেও ক্ষোভ দেখিয়েছেন তাঁরা।

১৩ ডিসেম্বর সংসদে হামলার ২২তম বার্ষিকীর দিন লোকসভায় অধিবেশন চলাকালীন দুই দর্শক আচমকাই সাংসদদের টেবিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যানিস্টার থেকে ধোঁয়া-বোমা ছড়াতে শুরু করেন। আলোড়ন পড়ে যায়, শেষে দুই সাংসদ তাঁদের পাকড়াও করে ফেলেন। তখন সংসদ ভবনের বাইরেও আরও দু’জন প্রতিবাদী স্লোগান দিতে দিতে ধোঁয়া-বোমা ছড়ান। জানা যায়, এই চারজনই মহীশূরের বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিমহার ‘প্রবেশ-পাস’ নিয়ে এসেছিলেন সংসদে। মোদীদের ঢাকঢোল পেটানো নতুন সংসদ ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যে এমন ‘ফস্কা গেরো’ তা সর্বসমক্ষে ধরা পড়ে যেতেই উলটো ছক কষতে শুরু করে দেয় বিজেপি। বিরোধীরা অবশ্য প্রথম থেকেই এই বড় ধরনের নিরাপত্তা গাফিলতি নিয়ে সংসদে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী মোদীরও বিবৃতি দাবি করেন। তাঁরা জানান, মন্ত্রী আগে বিবৃতি দিন, তার পর এনিয়ে বিশদে আলোচনা করা হবে সংসদে। এরই সঙ্গে ওই দর্শকদের পাশ যিনি দিয়েছিলেন সেই বিজেপি সাংসদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তাঁরা।

কিন্তু বিরোধীদের দাবিকে গুরুত্ব না দিয়ে শাহ সংসদের বাইরে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সংসদে দুই দর্শকের বিক্ষোভ নিয়ে বিবৃতি দেন। আর প্রধানমন্ত্রী মোদী একটি হিন্দি দৈনিকে সাক্ষাৎকারে সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে দায় এড়ানো প্রতিক্রিয়া দিলেও সংসদে একটি বাক্যও খরচ করেননি। বিরোধীরা বৃহস্পতিবারও লোকসভা-রাজ্যসভায় শাহের বিবৃতির দাবিতে সরব হয়েছিলেন। তখন দুই কক্ষ মিলে ১৪ সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয় সেই ‘অসংসদীয়’ আচরণের অজুহাত দেখিয়ে। তবে সরকারপক্ষের এই ‘মুখ বন্ধ’ করে দেওয়ার উদ্যোগে ভয় না পেয়ে নিজেদের দাবিতে অনড় অবস্থান নেন বিরোধীরা। তাঁরা স্পষ্টই বলেন, আগে সংসদের নিরাপত্তা গাফিলতি নিয়ে শাহকে বিবৃতি দিতে হবে। নাহলে সংসদে তাঁরা ওই দাবির সপক্ষে বিক্ষোভ দেখাবেন।

সরকারপক্ষ যদিও বিরোধীদের দাবিকে উপেক্ষা করে সংসদ ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে সংসদের সচিবালয়ের বলে দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আর শাহ নন, এবিষয়ে সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী বিবৃতি দিয়েছেন বলেও যুক্তি দেখানো হয়। উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত হন লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লা। আর প্রধানমন্ত্রী তো বিষয়টি ‘গুরুতর’, এই সময়ে ‘রাজনীতি করা উচিত নয়’, ‘অধ্যক্ষ সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছেন’, ‘এর পিছনে কাদের মাথা আছে খুঁজে বের করতে হবে’ গোছের মন্তব্য করে গোটা বিষয়টিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।

এদিন সংসদের অধিবেশন শুরু হতেই বিরোধীরা অধিবেশন কক্ষের অভ্যন্তরে শাহের বিবৃতির দাবিতে সরব হন। এরফলে সরকার এবং বিরোধীপক্ষের সাংসদদের তীব্র বাদানুবাদ চলে। শেষে দুই কক্ষের অধিবেশনই মুলতবি হয়ে যায় এদিনের মতো। এরই মাঝে অবশ্য লোকসভার ৩০ জনকে গোটা শীতকালীন অধিবেশনের জন্য সাসপেন্ড করা হয়। বাকি তিন কংগ্রেস সাংসদের সাসপেনশন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে স্বাধিকার রক্ষা কমিটির রিপোর্টের নিরিখে। এই তিনজন হলেন কে জয়কুমার, বিজয় বসন্ত এবং আবদুল খালেক। এঁরা অধ্যক্ষের আসনের কাছে গিয়ে বিক্ষোভ দেখান। সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী দু’টি পৃথক বিবৃতিতে ৩০ এবং তিন সাংসদকে সাসপেন্ড করার জন্য প্রস্তাব আনেন। এদিন লোকসভায় যাঁরা সাসপেন্ড হয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কংগ্রেসের অধীর চৌধুরি, গৌরব গগৈ, কে সুরেশ, কে মুরলীধরন সহ ৮ জন তৃণমূলের কল্যাণ ব্যানার্জি, সৌগত রায়, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, শতাব্দী রায় সহ ৯ জন, টি আর বালু, এ রাজা, দয়ানিধি মারান সহ ডিএমকে’র ১০ জনের পাশাপাশি জনতা দল (ইউ), আরএসপি এবং আইইউএমএল’র একজন করে সাংসদ।

একইভাবে রাজ্যসভাতেও সাসপেন্ড করা হয় ৪৫ জন সাংসদকে। এর মধ্যে ৩৪ জনকে শীতকালীন অধিবেশনের বাকি দিনগুলির জন্য এবং ১১ জনকে সেই স্বাধিকার রক্ষা কমিটির রিপোর্টের নিরিখে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। রাজ্যসভায় সাসপেন্ড হয়েছেন সিপিআই(এম)’র ভি শিবদাসন, জন ব্রিটাস এবং এ এ রহিমের সঙ্গে সিপিআই’র বিনয় বিশ্বম এবং সন্দোশ কুমার। এর মধ্যে ব্রিটাস, রহিম, বিশ্বম এবং সন্দোশের বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে স্বাধিকার রক্ষা কমিটির ওপর। এছাড়াও এদিন জয়রাম রমেশ, প্রমোদ তিওয়ারি, কে সি বেণুগোপাল, রণদীপ সিং সূরযেওয়ালা সহ কংগ্রেসের ১২ জন সুখেন্দু শেখর রায় সহ তৃণমূলের ৭ জন, কানিমোঝি সহ ডিএমকে’র ৪ জন, আরজেডি’র মনোজ ঝা সহ দু’জন ছাড়াও আরও কয়েকজন রয়েছেন। এদিন রাজ্যসভায় সাংসদদের সাসপেন্ড করার প্রস্তাব আনেন পীযূষ গোয়েল।

তবে সাসপেন্ড হলেও দমে যেতে রাজি নন বিরোধীরা। আগে যাঁরা সাসপেন্ড হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এদিন সংসদের প্রবেশদ্বারে দাবির সপক্ষে প্লাকার্ড হাতে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। মুখে তাঁরা সরকার বিরোধী স্লোগানও দিচ্ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সিপিআই(এম)’র এস ভেঙ্কটাসনও রয়েছেন। এরই জের টেনে এদিন সাসপেন্ড হয়ে যাওয়ার পর কংগ্রেসের গৌরব গগৈ জানিয়ে দিলেন যে তাঁরা এভাবেই আগামীদিনে সংসদ চত্বরে বিক্ষোভ দেখাবেন, শাহের বিবৃতির দাবিতে সরব হবেন। কোনোভাবেই সরকার তাঁদের মুখ বন্ধ করে দিতে পারবে না। সিপিআই(এম) সাংসদ এলামারাম করিমও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ধর্মনিরপেক্ষ গণাতান্ত্রিক দলগুলির ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ চলবে, কেউ দমাতে পারবে না।

Comments :0

Login to leave a comment