MAMATA RSS BENGAL

সঙ্ঘের মনপসন্দ বাংলাই গড়ে চলেছেন মমতা

রাজ্য

প্রসূন ভট্টাচার্য: কলকাতা 
বাবরি মসজিদ ভাঙার জন্য করসেবকরা যখন অযোধ্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ৩১ বছর আগে তখন কলকাতা থেকে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওকে সেনা নামিয়ে মসজিদ রক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সেকথা কানে তোলেননি। ৬ ডিসেম্বর ধ্বংস হয় বাবরি মসজিদ। এর দু’দিন আগে ৪ ডিসেম্বর কলকাতায় শহীদ মিনারে বামফ্রন্টের সমাবেশে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘‘রামের নামে মানুষ খুন চলতে পারে না। সাধুসন্তরা ধ্যান করুন, উপাসনা করুন, অসুবিধা নেই, কিন্তু দেশ চালাবেন এটা হতে পারে না। বাংলার সম্প্রীতির ঐতিহ্য দুষ্কৃতীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না, তা যে কোনও মূল্যে রক্ষা করতে হবে।’’ 
ঠিক সেইদিনই কলকাতার অন্যপ্রান্তে সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন মমতা ব্যানার্জি, তখন যুব কংগ্রেসের নেত্রী এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তিনি সেদিন অযোধ্যা নিয়ে সতর্কতামূলক একটি কথাও বলেননি। বরং বলেছিলেন, ‘সিপিএম ক্যাডার নামিয়ে এসব উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, ওসব কিছু হবে না।’ 
বাবরি মসজিদ ভাঙার কয়েকবছর পরে কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করেন মমতা ব্যানার্জি, সঙ্গী করেন বিজেপি’কে। তখন বিজেপি’কে বলেছিলেন, ‘ন্যাচারাল অ্যালি’। ২০০৩ সা‌লে ১৫ সেপ্টেম্বর নয়া‌দি‌ল্লি‌তে আর এসএসএ’র মুখপত্র ‘পাঞ্চজন্য’র ‘কমিউনিস্ট টেররিজম’ নামে সংকলন প্রকাশ অনুষ্ঠা‌নে মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন, ‘ক‌মিউনিস্ট‌দের বিরু‌দ্ধে আপনা‌দের লড়াই‌য়ে আমরা আছি। য‌দি আপনারা আমায় ১ শতাংশ সাহায্য ক‌রেন, আমরা ক‌মিউনিস্টদের সরা‌তে পার‌বো...আপনারাই হলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক।’ বি‌জেপি’র তৎকা‌লীন রাজ্যসভা সাংসদ বলবীর পুঞ্জ প্রত্যুত্তরে ব‌লেছিলেন, ‘আমা‌দের প্রিয় মমতাদি‌দি সাক্ষাৎ দুর্গা’। গুজরাট গণহত্যার পরেও সেই সম্পর্ক বহাল। তৃণমূলেরই প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসু তাঁর ‘অ্যান আউটসাইডার ইন পলিটিক্স’এ লিখেছেন, ‘গুজরাট দাঙ্গা আমার সামনে এক ব্যক্তিগত সঙ্কট তৈরি করে দেয়...কিন্তু আমার দলে আমি ছিলাম একা। এই প্রশ্নে মমতার দু’মুখো আচরণে আমি হতাশ ছিলাম...ওকে সবাই ধর্মনিরপেক্ষ ও মুসলিম দরদি বলেই জানত। কিন্তু গুজরাট সঙ্কটের তাৎপর্য ও কেন বুঝতে পারছিল না বা বুঝতে চাইছিল না, তা আমার কাছে ছিল রহস্য।’ 
রহস্য অনাবৃত হয়ে গিয়েছে তৃণমূল সরকারের আচরণে। দু’দশক ধরে বাংলার বুকে বিজেপি’র পথ প্রশস্ত করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেই রূপায়িত করছেন তিনি। সরকারের কর্মসূচিতে জনকল্যাণ, প্রশাসনিক দায়িত্ব, উন্নয়ন গুরুত্ব হারিয়েছে। বিজেপি’র এজেন্ডা’ই এখন তৃণমূল সরকারের তালিকায় অগ্রাধিকারে। ইমাম ভাতা, পুরোহিত ভাতা, দুর্গাপুজোয় অনুদান এখন সরকারি কোষাগার থেকে হচ্ছে। ধর্ম আর সরকারকে মিলেমিশে একাকার করে দেওয়ার এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতিই বাংলায় চাইছে বিজেপি। 
দেশের মধ্যে রেকর্ড সময় মুখ্যমন্ত্রী থাকা জ্যোতি বসুকে কখনও মন্দির উদ্বোধন করতে হয়নি। শহীদ মিনার ময়দান বর্ষায় জলে ডুবে থাকায় বামফ্রন্ট সরকার মুসলিমদের রেড রোডে নমাজ পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, কিন্তু জ্যোতি বসুকে কখনো নামাজ পাঠে হাজির হতে হয়নি। মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রীর সাংবিধানিক চেয়ারকে ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করেছেন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সমান উঁচু জগন্নাথ মন্দির দীঘায় করতে সরকারি তরফে উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। সরকারি অনুষ্ঠান থেকেই বলে বেড়াচ্ছেন, ৬ মাসের মধ্যে দীঘায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধন হবে। একইভাবে নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ইমাম মোয়াজ্জেমদের ডেকে ভাতা বাড়ানোর ঘোষণা করেছেন গত আগস্ট মাসে। কিন্তু সংখ্যালঘুদের স্কলারশিপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, মাদ্রাসা শিক্ষার বেহাল দশা ঘোচাতে কোনও পদক্ষেপ নেননি, ওয়াকফ সম্পত্তির চুরি ঠেকাতেও নয়। 
২৮ ডিসেম্বর দেগঙ্গায় মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ‘৪০০ কোটি টাকার বেশি খরচ করেছি তীর্থস্থানগুলির জন্য। অনুকূলচন্দ্রের সৎসঙ্গ আশ্রমের জন্য বিনা খরচে ৫ একর জমি দিয়েছি। তিন কোটি টাকা দিয়ে ওঙ্কারনাথ তোরণ তৈরি করে দিয়েছি। তারাপীঠ মন্দিরের জন্য খরচ করেছি, দক্ষিণেশ্বরে স্কাইওয়াক করে দিয়েছি, কালীঘাটেও করা হবে।’ মোদী-যোগীর সঙ্গে এই প্রতিযোগিতায় বিজেপি’র থেকে বেশি খুশি আর কে হবে? 
ভারতের সংবিধান যেভাবে নাগরিক অধিকারকে সরকারের ইচ্ছানিরপেক্ষ হিসাবে চিহ্নিত করেছে, মমতা ব্যানার্জি সেটা মানেন না। নাগরিকদের প্রাপ্যকে তিনি দাক্ষিণ্য হিসাবে দেখিয়ে নাগরিকদের কেবল ‘ভোট’ হিসাবে দেখেন। একদিকে তিনি বিজেপি’র রাজনীতি রূপায়ণ করছেন, অন্যদিকে সংখ্যালঘুরা তাঁকেই ‘ভোট’ দিতে বাধ্য বলে মনে করেন। এরজন্যই গত বিধানসভা নির্বাচনের পরে তিনি ‘সংখ্যালঘু তোষণ’র অভিযোগ সম্পর্কে সেই কুখ্যাত মন্তব্যটি করেছিলেন, ‘যে গোরু দুধ দেয় তার লাথিও খাবো।’ এমন মুখ্যমন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ রক্ষায় সোচ্চার হবেন কী করে!
 

Comments :0

Login to leave a comment