CPI-M STATE CONFERENCE

শ্রমজীবীদের দিনযাপনের অংশীদার হই, আন্দোলন তাঁদের উদ্‌যাপন হবে

উত্তর সম্পাদকীয়​

মহম্মদ সেলিম

আমরা লাল সেলাম জানাই। হিন্দিভাষার প্রখ্যাত কবি সামশের বাহাদুর সিংয়ের একটি পংক্তি আছে,‘ইয়ে সালামি হ্যায় দোস্তোঁ কে লিয়ে/মগর মুঠ্‌ঠিয়া তনতি হ্যায় দুশমনো কে লিয়ে।’ অর্থাৎ সেলাম কমরেডদের জন্য। আবার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ওঠে শত্রুদের জন্য। মুষ্ঠিবদ্ধ হাত দিয়ে সেলাম জানাচ্ছি, শপথ নিচ্ছি। আবার শত্রু শিবিরে কাঁপনও ধরানোর চেষ্টা নিচ্ছি। অনেক সময় কে শত্রু তা চিহ্নিত করতে অসুবিধা হয়। আমাদের সামনে শত্রু সম্পর্কে ধারণা তালগোল পাকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এই তালগোল না পাকানোর প্রতিষেধক হচ্ছে মতাদর্শ। আমাদের পার্টি, সিপিআই(এম) চলে মতাদর্শের ভিত্তিতে। তা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। কিন্তু কেউ কেউ শুধু মতকেই মতাদর্শ মনে করেন। কিন্তু তা ঠিক নয়। মতাদর্শ মানে শুধু জ্ঞানগর্ভ আলোচনা নয়। তার মধ্যে তত্ত্ব নিশ্চয়ই আছে। মতাদর্শ নিশ্চিতভাবেই তত্ত্ব নির্ভর। তাই তথাকথিত শিক্ষিত না হলেও, পাণ্ডিত্যপূর্ণ শব্দাবলী উচ্চারণ না করলেও একজন খেতমজুর, শ্রমিক, যাঁদের এই বৈষম্যময় সমাজ পড়াশোনার যথাযথ সুযোগ দেয়নি, তিনি তাঁর জ্বালা যন্ত্রণা, জীবন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে মতাদর্শে বলীয়ান হতে পারেন। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা থেকেই নির্দিষ্ট মতে পৌঁছাতে পারেন, যা তাঁকে নির্দিষ্ট আদর্শে ধাবিত হন। মতাদর্শ তাই। তার মধ্যে আমাদের আদর্শবোধ, মূল্যবোধ, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, চলার পথ এই সব সম্পৃক্ত আছে। সেই মতাদর্শকে আমরা অনুশীলন করি। প্রয়োগের চেষ্টা করি।
মতাদর্শের সেই প্রয়োগ নির্ভর করে বাস্তব পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ট বিশ্লেষণের উপর। পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ এবং মতাদর্শের সেই প্রয়োগ নির্ভর করে আন্দোলনমুখী সংগঠনের উপর। সেই আন্দোলনের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি ভিত্তি থাকতে হবে। শ্রেণির সঙ্গে, শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে সংগঠনের একটি দৈনন্দিন আদানপ্রদানের সম্পর্ক, যোগাযোগ থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে সেই আন্দোলনে শ্রেণির দাবিদাওয়া থাকবে। থাকবে তাঁদেরই ভাষা, ভাষ্য। তাহলেই শ্রমজীবী মানুষ পার্টিকে আপন করে নিতে পারবে। শুধু আন্দোলনেই নয়, শ্রমজীবী মানুষের বিভিন্ন অংশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক জীবনের সঙ্গে আমাদের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আমরা যদি সেই মানুষের দিন গুজরান, দিনযাপনের অংশীদার হই, তাহলে তিনি আন্দোলনকে উদ্‌যাপন করবেন। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পার্টির উদ্যোগে গড়ে তোলা আন্দোলন হবে তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কমিউনিস্টদের কাছে কোনোদিনই এই কাজ সহজ ছিল না। আমাদের পূর্বসূরিরা এই কাজ করেছেন। তার জন্য তাঁরা অনেক আত্মত্যাগ করেছেন। পরিশ্রম করেছেন। আজও সেই কাজ কঠিন। তবে প্রতিটি নতুন যুগে নতুন সঙ্কট হাজির হয়। আজ শ্রমজীবী সহ সমাজের নানা ভাবে নিষ্পেষিত অংশের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ত হওয়ার বাধা অনেক। বাধার চরিত্র বদলেছে। এ’ এক নতুন চ্যালেঞ্জ। আজ সমাজের সব মানুষকে এক একটি দ্বীপে আটকে রাখার মতো ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে শাসকরা। করোনা মহামারীর সময় ধনীদের জন্য এমন একটি ব্যবস্থা হয়েছিল। তাদের ঘিরে একেকটি বুদবুদ তৈরি করা হয়েছিল। এখন প্রতিটি মানুষকে এমন একটি বুদবদে বন্দি রাখার পরিকল্পনা অনুসারে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, আমাদের দেশের শাসকরা কাজ করছে। অনেকে ভাবেন, বলেন যে, আমরা সভা করছি, মিছিল করছি, ব্রিগেডে বিরাট সভা করছি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল মিলছে না। পশ্চিমবঙ্গে শ্রেণি ভারসাম্যের ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। আসলে ওই বুদবুদ ভেদ করে আমাদের কথা সেই মানুষটির কাছে পৌঁছাচ্ছে না। আর কখনও যদি বা পৌঁছায়, তা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না, গেঁথে যাচ্ছে না। কারণ প্রতিনিয়ত শাসকদের নতুন নতুন প্রচার, নানা কৌশলে তাঁর কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সোশাল মিডিয়া সহ আরও নানা মাধ্যমে। সেই মানুষের কাছে আমাদের বারবার যেতে হবে, সাঁকো তৈরি করতে হবে। ‘কাস্তেটা শান দিও বন্ধু...’ দীনেশ দাসের সেই কবিতাটি আমাদের সুপরিচিত। আমাদের প্রচারের কাস্তেতে আরও শান দিতে হবে। শাণিত করা মানে সময়োপযোগী করা। সময়ের দাবি অনুসারে, নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আমাদের আরও সৃজনশীল হতে হবে।
উদার অর্থনীতির, বিশ্বায়নের ফলে আর্থিক বৈষম্য বাড়ছে। সম্পদ, জমি কেন্দ্রীভূত হচ্ছে মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন বিলিওনিয়রের হাতে। বিপরীতে অনেক মানুষ জমি হারাচ্ছেন। আর্থিকভাবে দুর্বল হচ্ছেন। বৈষম্য বাড়ছে। প্রতিটি দেশের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। আবার প্রতিটি দেশের মধ্যে এই বৈষম্য বাড়ছে। এই সম্পদ, জমির অধিকার নিয়ে বৈষম্য যখন বাড়ছে একইসঙ্গে সামাজিক বৈষম্যও বাড়ছে। আমাদের দেশে, উপমহাদেশে দুই ধরনের বৈষম্য বৃদ্ধির প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শ্রেণি আন্দোলন, শ্রেণি সংগ্রামের কথা যখন বলছি তখন এই সামাজিক বৈষম্য, শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। কমিউনিস্ট পার্টিকে সেই সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে হবে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টরা গৌরবোজ্বল ভূমিকা পালন করেছে। দেশে পূর্ণ স্বরাজের দাবি প্রথম তুলেছিলেন কমিউনিস্টরাই। স্বাধীনতার পরে দেশ গঠনের কাজে কমিউনিস্টরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্রর আদর্শ রক্ষায় বরাবর কমিউনিস্ট পার্টি লড়াই করেছে। আজও ভারতের সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র রক্ষার লক্ষ্যে, শাসকদের যাবতীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টরা সংগ্রাম করছে। তাই আক্রমণ বরাবর তাঁদের উপরই বেশি হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎ ভারত কেমন হবে তা অনেকটাই নির্ভর করছে কমিউনিস্টদের ভূমিকার উপর। দেশের গরিব গুর্বো মানুষের অবস্থা কী হবে তা নির্ভর করছে কমিউনিস্টদের ভূমিকার উপর। 
দেশে বর্তমানে কমিউনিস্টরা দুর্বল। শাসকদের চক্রান্তে কমিউনিস্টদের দুর্বল করা হয়েছে নানা কৌশলে। সেই লড়াইয়ে পার্টির অনেকে শহীদ হয়েছেন। অনেকে সাজানো মামলায় জেলে গেছেন। অনেকে ঘরছাড়া হয়েছেন। এখনও অনেকে ঘরছাড়া আছেন। পশ্চিমবঙ্গ ছিল ভারতের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রবর্তী ঘাঁটি। স্বাধীনতার আগে থেকেই জাতীয় রাজনীতিতে এই রাজ্যের কমিউনিস্টরা, বামপন্থী আন্দোলন ভারত গঠনে ভূমিকা পালন করেছেন। তাই বিশ্বায়নের যুগে এবং আরএসএস-বিজেপি’র মতাদর্শ অনুসারে ভারতকে ভেঙেচুরে দেওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টদের দুর্বল করার চক্রান্ত হয়েছিল। আজকের ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালে তা স্পষ্ট হয়। এই ভারত, এই পশ্চিমবঙ্গ তৈরিই করা যেত না যদি কমিউনিস্টদের চক্রান্ত করে দুর্বল করা হতো। তাই কমিউনিস্ট পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে দেশের গরিব, শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে। আর তা করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার পুনর্জাগরণ ছাড়া তা সম্ভব নয়। এটি আমাদের পার্টির সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। 
এই কাজে আমাদের অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আমাদের রাজ্য সাক্ষী কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বাস্তুহারা মানুষের সংগ্রামের, সামাজিক সম্প্রীতির লক্ষ্যে, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের জন্য, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য, বিবিধের মাঝে মিলনের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য, মানুষের আরও নানা অধিকারের জন্য লড়াইয়ে কমিউনিস্টরাই নেতৃত্ব দিয়েছেন। আজ সেই সবই আক্রান্ত। আর্থিক বৈষম্যের সঙ্গেই সামাজিক বৈষম্য বাড়ছে। সমতার ধারণা সবদিক থেকে লঙ্ঘিত হচ্ছে। প্রত্যেক দেশবাসীর একটি ভোট দেওয়ার অধিকার। প্রত্যেকের একটি ভোট মানে সবার সমান অধিকার। আজ সঙ্ঘ-বিজেপি বলছে এক দেশ-এক ভোট। এটি ওদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চক্রান্ত। আমরা বলছি, প্রত্যেক দেশবাসীর একটিই ভোট মানে সমতা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। তা কী হয়েছে? হয়নি। উলটে বৈষম্য আরও বাড়ছে। কয়েকজন বিলিওনিয়র আর বিপুল দেশবাসীর মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। রাজ্যগুলির মধ্যে বাড়ছে। আবার রাজ্যগুলির মধ্যেও বিভিন্ন অংশের মধ্যে বাড়ছে। আমাদের রাজ্যে কৃষির সাফল্যের ভিত্তিতে কাজের সুযোগ বৃদ্ধির জন্য আমরা শিল্পের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলাম। তৃণমূল, বিজেপি, জামাত, মাওবাদীরা সহ বিভিন্ন শক্তি তার বিরোধিতা করেছিল। আজ আমরা কী দেখছি? কৃষক ফসলের দাম পাচ্ছেন না, অথচ চাল, সবজির দাম বাড়ছে। আবার রাজ্যে প্রতিবছর কয়েক লক্ষ কোটি টাকার শিল্পের ঘোষণা করছে রাজ্যের সরকারে থাকা দল, কিন্তু কাজের খোঁজে যুব সহ অন্যান্য অংশের মানুষ অন্য রাজ্যে ছুটছেন। রাজ্যে ন্যূনতম মজুরি বাড়ছে না। বিড়ি শ্রমিকদের মতো অনেক শ্রমজীবীদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা হলেও তা মালিকরা দিচ্ছেন না। কারণ মালিকরা তৃণমূলের নেতা। রাজ্যে একটি অংশ তৈরি হয়েছে, যারা মূলত তৃণমূল, বিজেপি’র নেতা, মন্ত্রী, বিধায়ক— তাঁদের সম্পদ বেড়েছে। কিন্তু গরিব, শ্রমজীবী মানুষ অধিকার হারাচ্ছেন, তাঁদের আয় কমছে, তাঁরা জমি হারাচ্ছেন। এই আর্থিক বৈষম্য বৃদ্ধির সঙ্গেই রাজ্যে বেড়েছে সামাজিক বৈষম্য। যাকে ব্যবহার করে নিজেদের শক্তি বাড়াতে চাইছে আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি। এই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলিকে রাজ্যে মাথাচাড়া দিতে সাহায্য করেছে তৃণমূলের সরকার। কারণ— কমিউনিস্টরা দেশ রক্ষার জন্য বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রেখেছে। সেই লড়াইকে ধর্ম সহ অন্যান্য বিভাজনের অস্ত্রে ভাগ করার জন্য সঙ্ঘের সাহায্য দরকার। 
সমতার আদর্শের ভিত্তিতে মানুষকে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই কমিউনিস্টদের কাজ। আর দক্ষিণপন্থীদের কাজ সেই সমতার আদর্শকে ভাঙা, যেটুকু গণতান্ত্রিক অধিকার আছে তা কেড়ে নেওয়া। লড়াই হচ্ছে গণতন্ত্রকে আরও মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া, সম্প্রসারিত করা। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষের মর্যাদা, সাম্যের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হবে। তখন গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা দেখছি যখন আর্থিক, সামাজিক বৈষম্য বাড়ছে তখন মানুষের ওই একটি ভোটের যে অধিকার তাও কেড়ে নিচ্ছে শাসকরা। ভোট দিতে দিচ্ছে না। বুথ দখল করছে, মেরে মানুষকে ভোটকেন্দ্র থেকে হটিয়ে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, রাতে নিজেদের দলের প্রতীকের পাশে শিলমোহর লাগিয়ে হাজার হাজার ব্যালট ভোট বাক্সে ফেলার কাজও রাজ্যে হয়েছে। এই সবই হচ্ছে কারণ আর্থিক, সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সমতা, গণতন্ত্রের দাবিতে মানুষ সংগঠিত হতে চাইছেন, তা তারা বুঝেছে। 
মানুষের আর্থিক স্বাধীনতা, সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সমাজতন্ত্র। আমাদের পার্টি বলেছে তা একবারে, এক্ষুনি হবে না। ধাপে ধাপে সেদিকে এগতে হবে। সেই সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবে শ্রমিক শ্রেণি। তাকে সমবেত, সংগঠিত করা আমাদের কাজ। পাশাপাশি খেতমজুর, কৃষকের মতো সহযোগী অংশকেও সংগঠিত করা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাদের নানা সীমাবদ্ধতা, পিছুটান সত্ত্বেও মধ্যবিত্ত, পেটিবুর্জোয়াদের বিপ্লবে ভূমিকা আছে। তা আমাদের পার্টি কর্মসূচিতে বলা আছে। বিশ্বায়নের যুগে তারাও বিধ্বস্ত, সঙ্কুচিত। দক্ষিণপন্থীরা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার পথে গরিব, শ্রমজীবী সহ অন্যান্য অংশকেও ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছে ধর্মকে হাতিয়ার করে। এই পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট পার্টি ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র রক্ষার জন্য লড়াই করছে। ধর্মের নামে দেশভাগ হলেও আমরা বলেছি সবার উপরে মানুষ সত্য। নানাভাবে বিঘ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে শাসক শ্রেণির পক্ষ থেকে, তবু দেশ ধর্মনিরপেক্ষ হলো। কমিউনিস্টরা বরাবর বলেছে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা, রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন রাখার কথা। আর দেশের শাসক শ্রেণির দলগুলি বলে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের কথা। তাতে একটি সুযোগ থেকে গেছে সব ধর্মকে ব্যবহার করার। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছে যারা, তারা সেই সুযোগে ধর্মীয় উসকানি দিয়েছে ক্ষমতা যে কোনও মূল্যে ধরে রাখার জন্য। আমরা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনার দিকে নজর দিতে পারি। আমরা বলি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে রক্ষা করতে হবে। কারণ বাংলাদেশের মানুষ ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে তাঁদের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায়, গণতন্ত্রের দাবিতে গড়ে তোলা আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে পরিচালিত করেছিল। সেই লড়াইয়ে কমিউনিস্টরা, বামপন্থীরা দারুণ সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছিলেন। পরবর্তীকালেও সেখানে যখন শাসকরা নানাভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্রের উপর আঘাত হেনেছে, কমিউনিস্ট, বামপন্থীরা নানাভাবে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। যারা ধর্ম-ভিত্তিক রাজনীতি করতে চেয়েছিল, সেই রাজাকার, আইএসআই, জামাত কিংবা সঙ্ঘ পরিবার— বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ তাদের উপর বড়সড় আঘাত হেনেছিল। বাংলাদেশ যখন আক্রান্ত, তখন প্রগতিবাদীরা চাইবে ধর্মনিপরপেক্ষতার আদর্শের উপর দাঁড়িয়ে থাকা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। অন্যদিকে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সেই আদর্শকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিতে চাইবে সেখানকার সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি। সেখানে তারা বলছে, ’৭১ নয়, স্বাধীনতা এসেছে এখন। আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি বলছে ’৪৭-র আগস্টে নয়, দেশ স্বাধীন হয়েছে রামমন্দির উদ্বোধনের দিন। অর্থাৎ ১৯০ বছরের সংগ্রামের পথে যে ভারত চেতনার উন্মেষ হয়েছিল, ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তা ধূলিসাৎ করার চক্রান্ত হচ্ছে। বামপন্থী শক্তি, কমিউনিস্টরা যদি মজবুত না হয়, শ্রেণি চেতনা যদি না থাকে তাহলে আমরা দেখলাম কী হতে পারে। বাংলাদেশ তা আমাদের দেখালো। যারা অতীতমুখী তারা আমাদের সামনে বারবার দেশভাগের স্মৃতিকে তাদের সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা অনুসারে আমাদের সামনে নিয়ে আসবে। আমরা যারা ভবিষ্যৎমুখী, প্রগতির পক্ষে, আমরা স্বাধীনতা আন্দোলন, মুক্তিচেতনার আদর্শকে তুলে ধরবো। তাই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি থেকে দেশ, রাজ্যের শাসক দলের চেষ্টা চলবে কমিউনিস্টদের দুর্বল করার। 
এই লড়াই আসলে এই দুই মতাদর্শের। আমাদের রাজ্যে সেই লড়াই চলছে। আমরা লাগাতার আন্দোলন করছি। আবার এই সময়ের মধ্যেই আমরা দেখেছি আর জি কর হাসপাতালে ট্রেনি তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ, খুনের ঘটনার বিরুদ্ধে গণআন্দোলন। সমাজের নানা অংশের অনেক মানুষ তাতে অংশ নিয়েছিলেন। আমরাও সেই আন্দোলনে থেকেছি। বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ভাবে দেখেছি। কিন্তু এই আন্দোলনে স্পষ্ট হয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন অংশের গণতন্ত্র, অধিকারের স্পৃহা। যে কোনও আন্দোলন থেকে কমিউনিস্টরা ভবিষ্যতের রসদ সংগ্রহ করে। যেমন গ্রামে গ্রামে তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে আমরা দেখেছিলাম গ্রামীণ গরিব, শ্রমজীবী মানুষের আকাঙ্ক্ষার ছবি। ‘চোর ধরো জেল ভরো’ স্লোগানকে মানুষ গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের আন্দোলনে মূর্ত হয়েছিল প্রতিশোধস্পৃহা। আমাদের সমাজের এই সব বৈশিষ্ট্যকে বিশ্লেষণ করে, মানুষের সঙ্গে দৈনন্দিন যোগাযোগের ভিত্তিতে রাজ্যে শ্রেণি ভারসাম্যের পরিবর্তনের কাজ করতে হবে। ভবিষ্যতের সেই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার লক্ষ্যেই সিপিআই(এম)’র ২৭তম রাজ্য সম্মেলন হবে আগামী ২২ থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি ডানকুনিতে।

Comments :0

Login to leave a comment