মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে আমার আলাপ বিয়ের পর হলেও ওনাকে আমি চিনি কলেজে পড়ার সময়। সেটা ১৯৬৫-’৬৬ সাল। উনি তখন কলেজের ছাত্র নেতা। ইউনিয়ন করতেন বলেই চিনতাম, মিছিলের মুখ হিসাবে। মাঝেমধ্যে বক্তৃতা দিতেন ক্লাসরুমে। আবার কফি হাউসে দেখতাম আড্ডা দিতেন। তখন চেনা বলতে ওই টুকুই। পরে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ের পর অন্তরঙ্গতা বাড়ল। তখন আবার জানলাম আমার ও বুদ্ধদেবের জন্মও একই সালে, একই মাসে।
আমরা যখন বেকবাগানে থাকতাম, তখন বুদ্ধদেবরা পাম অ্যাভিনিউতে চলে এসেছেন। সেই সময় তিনি যুক্ত হয়েছেন প্রথম বামফ্রন্ট সরকারে তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের মন্ত্রী হিসাবে। সেসময় আমাদের বন্ধুত্বটা গাঢ় হয়ে উঠল। আমাদের আসা-যাওয়া বাড়ল। উনি প্রায়ই আসতেন। খুবই ভালোবাসতেন শক্তিকে। দু’জনের পরস্পরের প্রতি একটা শ্রদ্ধা ছিল। ১৯৮৩ সালে, ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’কাব্যগ্রন্থের জন্য শক্তি যখন সাহিত্য অকাদেমি পায়, সকালবেলা সবার আগে বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন বুদ্ধদেব। এতটাই আন্তরিকতা। শক্তিও কেউ কোনও অনুরোধ করলে, সটান বুদ্ধদেবের কাছে চলে যেত। তবে, বেশিটা আলিমুদ্দিনে। ওঁর বাড়িতে কয়েকবার গেলেও, বুদ্ধদেব বারণ করে শক্তিকে বলেছিলেন, ‘আপনাকে যে বসতে দেব, ঘরে সেই জায়গা নেই। আপনি আলিমুদ্দিনে আসুন।’দুটো ঘরের একটায় ওনার বাবা-মা থাকতেন আর অন্যটায় ওনারা তিনজন। আমারদের বাড়ি এলে শুধু এককাপ লিকার চা, তাছাড়া আর কিছুই প্রায় খেতেন না, নানা রোগের বাহানা দিতেন।
শক্তি যখন কবিতা উৎসব শুরু করল, তখনও দেখেছি বুদ্ধদেবকে অলিখিত দায়িত্ব তুলে নিতে। সারা দেশের কবিরা জড়ো হলে, তাদের ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে তাদের আসা যাওয়া, থাকার জন্য সরকারি (বামফ্রন্ট সরকারের) গেস্ট হাউসগুলোয় থাকার ব্যবস্থা করা, সব দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আমরা যখন বেলেঘাটার বাড়িতে চলে গেলাম সেখানে বুদ্ধদেবের আসা কমলো। তবে, যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। শক্তি ওনার কাছে প্রায়ই যেত বলে অংশু শূর একবার বলেছিল, ‘শক্তিদা আপনি তো এর-ওর অসুবিধা নিয়ে প্রায়ই আসেন, কখনও নিজের কোনও প্রয়োজন নিয়ে কিছু বলেন না তো’, তাতে শক্তি বলেছিল, ‘ও আমার কী দরকার মেটাবে! আমার তো দরকার কবিতা লেখায়, সেখানে ও আর কী করবে?’
শক্তির মৃত্যুর পর যে সহযোগিতা পেয়েছি ওনার থেকে, তা সবসময় মনে থাকবে। শক্তির মৃত্যুদিনে যাবতীয় দায়দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি, সঙ্গে তুষার তালুকদার। শক্তির মৃত্যুর খবর শুনে আমি আগেই চলে গিয়েছিলাম শান্তিনিকেতনে। তারপর সেখান থেকে কলকাতা আসার পুরো দায়িত্ব থেকে শুরু করে শক্তিকে শেষ নমস্কার জানানোর সমস্ত ব্যাপারটাই দেখভাল করেছিলেন বুদ্ধদেব।
বুদ্ধদেবের উদ্যোগেই শক্তির মৃত্যুর পরপরই ‘শক্তি চট্টোপাধ্যায়’নামের একটি সংকলনগ্রন্থ প্রকাশিত হয় বসুমতী প্রকাশনা থেকে। শক্তি’র সমস্ত জরুরি কাব্যগ্রন্থ থেকে টুকরো টুকরো কবিতা ও ‘কুয়োতলা’উপন্যাস নিয়ে হওয়া সেই বইয়ের সম্পাদনার দায়িত্বভার প্রথমে তারাপদ রায়কে দিতে চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব। তারাপদ সে দায়ভার দেন সমীর সেনগুপ্তকে। শক্তি’র সই ব্যবহার করে পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায় অসামান্য এক প্রচ্ছদ করেন। পরবর্তীতে আমি শক্তি’র ‘পদ্যসমগ্র’যখন সম্পাদনা করার একটা তথ্য পেয়ে অবাক হয়েছিলাম। ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’কবিতাটা প্রথম পত্রিকায় ছাপেন বুদ্ধদেব। সেইসময় ‘কথা’নামের একটা পত্রিকা সম্পাদনা করার সূত্রে শক্তি’র থেকে এই কবিতা চেয়েছিলেন তিনি। তবে, বুদ্ধদেবকেও কবিতা পাওয়ার জন্য শক্তি’র পিছনে তিনি কম চক্কর কাটতে হয়নি! শক্তির মৃত্যুর পরও, বেলেঘাটার বাড়িতে বেশ কয়েকবার এসেছিলেন বুদ্ধদেব। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ও শক্তি’র জন্মদিনে ও আমাদের বাড়িতে এসেছেন, কবিতা পড়েছেন। আমার নাতি হওয়ার পরও এসেছেন। এতটাই পারিবারিক অন্তরঙ্গতা ছিল।
বুদ্ধদেব চলে গেলেন। আমার কাছেও এক বিরাট শূন্যতা। বেশ কয়েকবার তাঁর অসুস্থতার খবর পেয়েছিলাম। তখন মাঝে মাঝে ভাবতাম, যাই, একবার দেখা করে আসি। কিন্তু তখন চলক্ষম ছিলাম। এখন চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ায় শেষ দেখাটাও করতে পারলাম না।
Comments :0