Panchayat Elections Result

তৃণমূলের মতো ভেঙেছে বিজেপি’র সাজানো ‘গড়’

রাজ্য

Panchayat Elections Result


বিজন বিশ্বাস: কৃষ্ণনগর


তফসিলি জাতির মানুষ ৩০%-র বেশি। হিন্দু প্রায় ৭৩%। সীমান্ত এলাকা অনেকটা। এখানে বাংলাদেশ করিমপুরের মতো অনেক জায়গায় বাড়ির পাশে — হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। সেই নদীয়া সম্পর্কে বিজেপি এবং তৃণমূলের বোঝাপড়া বলতে এটিই। মিডিয়াও এই জনবিন্যাসের অঙ্ককে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। তারই ভিত্তিতে এবং গত কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে নদীয়াকে ‘বিজেপি-র গড়’ বলে প্রচার যত্নে সাজানো হয়েছিল।
কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচন তা ভেঙে দিল। সেই লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে নতুন প্রজন্ম। কোথাও তাঁরা প্রার্থী হয়েছেন। কোথাও প্রচারের প্রধান মাধ্যম। সন্ত্রাস ভাঙতে তাঁরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন অভিজ্ঞদের সঙ্গে।
যেমন আইশমালি। বিশ বছর বাদে রানাঘাটের আইশমালি পঞ্চায়েতে সিপিআই(এম) জয়ী হয়েছে। তৃণমূল আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা করেছে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্লকের ২৫ আসনের ১২টি জিতেছে সিপিআই(এম)। তেহট্ট-২ ব্লকের পলাশীপাড়া পঞ্চায়েতের ৬৪ নম্বর বুথে ১৯৮৩ সালের পর এই প্রথম জয়ী হয়েছেন সিপিআই(এম) প্রার্থী অনুসূয়া মণ্ডল।


সন্ত্রাসকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গ্রামের ওই গৃহবধূ ৮৯ ভোটে জয়ী হয়েছেন। ধারাবাহিক সন্ত্রাস কবলিত কালিগঞ্জ ব্লকের মিরা-২ গ্রাম পঞ্চায়েতে ভোটের দিন নৃশংস আক্রমণ চালিয়েছিল শাসক দল। সব বুথ দখল করেছিল তৃণমূল। ব্যাপক সন্ত্রাসের জেরে অনেক সিপিআই(এম) কর্মী-সমর্থককে বাড়ি পর্যন্ত ছাড়তে হয়েছিল। কিন্তু ৫৬, ৫৭ ,৫৮ তিনটি বুথে পুনর্নির্বাচন হয়। তার পরেও সেখানে ৬টি আসন লাভ করেছে সিপিআই(এম)। পুলিশ প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে বুথ দখল করেও তৃণমূল পেয়েছে ১২টি আসন।  
গত নির্বাচনের দিকে তাকালে লক্ষ্য করা যায় জেলার উওরাংশে তৃণমূলের জয় বেশি হলেও দক্ষিণাংশের বিভিন্ন ব্লক তথা বিধানসভা এলাকায় বিজেপি’র প্রতি সমর্থন বেড়েছিল। কিন্তু এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে বিজেপি’র শক্তি বেশি বলে যে এলাকাগুলিকে চিহ্নিত করেছিল মিডিয়া, সেই চাকদহ, হরিণঘাটা, কল্যাণী কৃষ্ণগঞ্জ, রানাঘাটে বিজেপি’র প্রতি মানুষের সমর্থন কমেছে। 
তেমনি নদীয়ার উত্তরাংশের কালিগঞ্জ, করিমপুর ১ ও ২ তেহট্ট, নাকাশিপাড়া, কৃষ্ণনগর ১ ও ২ ব্লক সমূহে তৃণমূলের জনসমর্থন কমেছে। তৃণমূলের প্রতি মানুষের ক্ষোভের প্রতিফলন স্পষ্ট। সন্ত্রাসকে হাতিয়ার করে চাকদহ, কল্যাণী, তেহট্ট, রানাঘাট, কালিগঞ্জ সহ একাধিক জায়গায়  বিরোধীশূন্য ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালায় শাসক তৃণমূল। 
নির্বাচনের দিন ঘোষণা থেকে শুরু করে মনোনয়ন প্রত্যাহার পর্ব, এমনকি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্য, হাইকোর্টের নির্দেশে সারা রাজ্যের মতো এই জেলাতে আসা কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কার্যত ব্যবহার না করে শাসক দল সন্ত্রাসের সব রকমের পদ্ধতি প্রয়োগ করেছে।


তেহট্ট ১ ব্লকের শ্যামনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৫০ ও ১৫১ নং বুথ এলাকায় পুলিশের অনুমতি সাপেক্ষে সিপিআই(এম)-র প্রচার মিছিলে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালাতে দেখা গেছে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতী দলকে। ঘটনাস্থলে পুলিশ এলে তাঁদের লক্ষ্য করেও এলোপাথাড়ি ইট- পাটকেল ছোঁড়া হয়। আহত হন আইসি সহ একাধিক পুলিশ কর্মী। ঘটনার সব সত্যতা জানা সত্ত্বেও পুলিশ পার্টি নেতা, ওই কেন্দ্রের প্রার্থী সামাদ শেখ সহ ৫৮ জন ও তৎসহ আরও ২০০ জনকে যুক্ত করে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে মামলা দায়ের করে। ঘটনায় ৭ জন সিপিআই(এম) কর্মী, সমর্থক গ্রেপ্তারও হন। এমনই মিথ্যা মামলায় পরিকল্পিতভাবে, রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে, কৃষ্ণনগর কোতোয়ালি থানার অন্তর্গত ১৭৮ নং বুথের পার্টিসদস্য বাপি বিশ্বাস ও একযোগে বিজেপি’র বুথ সভাপতি ইন্দ্রনাথ বিশ্বাসকে অস্ত্র আইন ধারায় গ্রেপ্তার করেও ভোটের দিন তাঁদের জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়।   
তার পরও ঐ ১৫১ নং বুথের সিপিআই(এম) প্রার্থী সামাদ শেখ ৬৭ ভোটে জয়ী হয়েছেন। এই শ্যামনগর পঞ্চায়েতে গতবার সিপিআই(এম) জিতেছিল ১৬টির মধ্যে ৩টি আসনে। এবার জয়ী হয়েছে ৮টা আসনে। এবার মোট আসন ২০টি। তৃণমূল জিততে পেরেছে ৪টিতে। বাকি বিজেপি। শুধু শ্যামনগরই নয়, বেতাই-১, বেতাই-২, ছিটকা, নাটনা, পাথরঘাটা ১ ও ২-এর মতো  এমন পঞ্চায়েত এবং বুথের সংখ্যাচিত্রের অনেক উদাহরণ।


পুনর্নির্বাচনের দিনও ৪টে বুথ দখল করে ছাপ্পা চালায় তৃণমূলীরা। সিপিআই(এম) কর্মীরা ১১২ নং বুথকে রক্ষা করেন, মানুষের ভোট প্রয়োগের অধিকারকে সুরক্ষিত করে তারা। গণনা শেষে দেখা গেল সেই ১১২ নং সহ এই পঞ্চায়েতে সিপিআই(এম) ১০ টি বুথে জয়ী হয়েছে। সারা রাজ্যের মতো এই জেলাতেও প্রাণ হারিয়েছে ২ জন। চাপড়ার কল্যাণদহ গ্রামের ১৪৮ নং বুথের সামনে বেলা ১০ টার সময় খুন হন হামজার আলি হালসানা নামে এক বিক্ষুব্ধ তৃণমূলী। 
নির্বাচনের দিন ভোট শুরু হওয়ার আগেই সশস্ত্র তৃণমূল বাহিনীর নৃশংস আক্রমণের শিকার হয়ে রক্তাক্ত জখম হন কৃষ্ণনগর এক ব্লকের তৃণমূল পরিচালিত ভালুকা গ্রাম পঞ্চায়েতের আনন্দবাস এর ৬-৭ জন সিপিআই(এম) কর্মী সমর্থক এজেন্টরা। আক্রমণের হাত থেকে বাদ যাননি ৬০ বছরের  প্রবীণ সিপিআই(এম) প্রার্থীর শ্বশুর শুকুর আলি শেখ। পরবর্তীতে তিনি প্রাণ হারান। নাকাশিপাড়া থানার তেঁতুলবেড়িয়া তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের অস্ত্রের কোপে  রক্তাক্ত জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ২ জন। এই ব্লকেরই পেটো ডাঙ্গায় সাজ্জাদ মণ্ডল নামে সিপিআইএম কর্মী এক যুবককে গুলিবিদ্ধ করে তৃণমূলীরা।
এত সত্ত্বেও নির্বাচনের ফলাফলে যেখানে যেখানে মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন, সেখানে সেখানেই সিপিআই(এম)’র পক্ষে মানুষের সমর্থনের সংখ্যা বেড়েছে। ক্ষমতায় থাকা তৃণমূল যেমন মানুষের রায়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে শান্তিপুর, তেহট্ট-১ ব্লকের ক্ষমতা থেকে তেমনি বিজেপি-কে ক্ষমতাচ্যুত করার তালিকাও দীর্ঘ। জেলার ১৭ ব্লকের ৫৪৯টি পঞ্চায়েত সমিতির আসনের মধ্যে ৩৬৬টিতে তৃণমূল, ১২৩টি’তে বিজেপি, ৩৫টি আসনে সিপিআইএম, ৭টিতে কংগ্রেস ও ২০টিতে নির্দল প্রার্থী জয়ী হওয়াটাও এই সময়ে তাৎপর্যপূর্ণ।       

 

Comments :0

Login to leave a comment