বেঁচে থাকবে প্রতিদিনের কাজে-আড্ডায়
শমীক লাহিড়ী
৮০’র শেষ আর ৯০’র দশকের শুরু। তখন সময়টা খুব ঝোড়ো। সদ্য যৌবনে পা দিয়ে হৃদয় জুড়ে গড়ে তোলা স্বপ্ন, এক গভীর সংশয়ের ঘুরপাকের ঘূর্ণিতে পড়ে গেছে।
কৈশোরের শেষ বেলা থেকে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখা আবেগ, যৌবনের শুরুতেই এমন ধাক্কা খাবে, অজ্ঞানতার অভাবে তা তখন বুঝিনি। অন্য অনেক বন্ধু- কমরেডরাও গভীর ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন। উত্তর হাতড়ে বেড়াচ্ছি সবাই।
এক নেতৃস্থানীয় কমরেড গণশক্তিতে প্রকাশিত বিটি রণদিভের লেখা একটা প্রবন্ধ এনে বললেন, কিছু উত্তর আছে এতে, সোভিয়েত ভাঙার কারণও কিছু আছে, পড়ো। পড়লাম বেশ কয়েকবার, বুঝলাম এটা মস্তিষ্ক দিয়ে বুঝতে হবে, যা তখনও ছিল খুবই অপরিণত।
কিছু বুঝলেও অস্থির মনটা শান্ত হচ্ছিল না কিছুতেই। এমন সময়ে সে মাসের যুবশক্তি পত্রিকা পেলাম।সম্পাদকীয়টা পড়ে প্রাণে একটা শান্তির ঠান্ডা বাতাস বইলো।
.....এটা ঠিক সমাজতন্ত্রের পতন হয়েছে। পিছু হঠেছে আপাতত। কিন্তু এটাই কি সব সত্য!?
সারাদিন হাড়ভাঙা খাটনির শেষে গাল ভাঙা শ্রমিকের মুখটাই কি সব? তার বেঁচে থাকার লড়াইটা কি দেখতে পাও! অফিস ফেরৎ ক্লান্ত অবসন্ন যুবতীর ক্লান্তিতে বুঁজে আসা চোখ দুটোই কি সব। ক্লান্তিতে আধ বোঁজা চোখে বেঁচে থাকার যে স্বপ্ন বোনে ঐ যুবতী, তা কি তুমি দেখতে পাও না!....
আসলে গালভাঙা মুখটা নয়, বেঁচে থাকার লড়াইটা, ক্লান্তিতে অবসন্ন আধ বোঁজা চোখটা নয়, ওর জীবনের স্বপ্নটা দেখো।........
সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়কে শুধু নয়, ৭০ বছরের সাফল্যটার দিকে তাকাও আর তার সাথেই খোঁজো, ৭দশক বাদে এই বিপর্যয় কেন!........
ইতিহাসকে টুকরো সাময়িক ঘটনা হিসাবে না দেখে, তাকে লম্বা সময়ের নিরিখে দেখতে হয়। আজ যে হারছে, তার ভিত্তিতে চুড়ান্ত জয়-পরাজয় খুঁজতে গেলে ভ্রান্তির চোরাগলিতে হারিয়ে যেতে হয়।......আজ যে হারছে কাল সে হার'কে হার মানিয়ে জিতবেই, যদি তা বিজ্ঞান হয়।.....
সেই সম্পাদকীয় তো আর কাছে নেই, তাই সব শব্দ, বাক্যও আর মনে নেই। কেবল বিষয়টাই মনে গেঁথে রয়ে গেছে।
মনে হ'লো এঁকেই জাপটে ধরা ভালো। সেই যে লেপ্টে গেলাম, আর কখন যে বিরাট বয়সের ব্যবধান পেরিয়ে মানব'দা বন্ধু হ'য়ে গিয়েছিল, সেটা বুঝতেই পারলাম না।
যুক্তি, শ্লেষ আর বিষয়ের গভীরে ডুবে থাকা কত লেখা, বিস্মিত হ'য়ে পড়া আর শিক্ষিত হওয়া, অভ্যাসে পরিণত হ'য়ে গিয়েছিল। নরম, নীচু স্বরে ক্ষুরধার রক্তের গতিবেগ বাড়িয়ে দেওয়া বক্তৃতা মোহিত হ'য়ে শোনা - এগুলোই আমাদের সময়ে বহু ছাত্র-যুব কর্মীদের যৌবনের চেতনার রঙে পাক ধরিয়েছিল।
মানব'দা মানেই দুরন্ত বুদ্ধিদীপ্ত মজা, হাসি ঠাট্টার মাঝেই রাজনীতি- সংগঠন।
মানব'দা মানেই তর্ক-বিতর্ক, নতুন নতুন প্রবন্ধ-লেখা- বইয়ের ঠিকানার সন্ধান পাওয়া।
কত কত মণি মুক্ত ছড়িয়ে আছে মানবদা'র লেখা, বক্তৃতা আর অবশ্যই আড্ডায়।
এত তাড়াতাড়ি সব স্মৃতি হ'য়ে যাবে কখনো ভাবিনি।
তবে মানব'দা তুমি ভাস্বরই থাকবে। পরের প্রজন্মের কাছে বেঁচে থাকবে হয়তো শুধু লেখায়, কিন্তু আমাদের প্রজন্মের কাছে তুমি থাকবে প্রতিদিনের কাজে আর আড্ডায়।
তোমাকে খুউব মিস করবো ভালো মন্দ খাওয়ার সময়েও।
অনেক অনেক ভালোবাসা রইলো মানবদা।
Comments :0