MIGRANTS BENGAL

নিখোঁজ পরিযায়ীদের খোঁজে হন্যে অসহায় পরিবার

রাজ্য

ছবি প্রতীকি

জয়ন্ত সাহা, অপূর্ব মণ্ডল: মাথাভাঙা, বালুরঘাট 
 

 এ রাজ্যের সরকার তাঁদের কাজের কোনও ব্যবস্থা করেনি। পেটের টানে তাঁরা ভিন রাজ্যে কাজ করেন। তবুও উৎসবে সময়ে তাঁরা বাড়ি ফেরেন। কাজের জায়গায় ফিরে যান একেবারে ছট পুজোর পরে।
এবারেও ভিন রাজ্যের অনেকেই ফিরছেন, কেউবা আসবেন পুজোর দু’-একদিন আগে। শুধু ঘরে ফেরা হবে না সিকিমের লাচুং সহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করা ২৫জন পরিযায়ী শ্রমিকের। ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর তাঁদের কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ওঁদের নাম এখন নিখোঁজের তালিকায়। তাঁরা বাড়ি না ফেরায় শিতলকুচির গোসাইরহাট, লালবাজার, কোচবিহার-১ ব্লকের পানিশালার পরিবারে উৎসবের আগেই নেমে এসেছে অন্ধকার! একই ছবি বালুরঘাটেরও বিভিন্ন গ্রামের।
উৎসবের টানে দিল্লি থেকে ইতিমধ্যে চলে এসেছেন মেখলিগঞ্জের দেবী কলোনির অখিল সূত্রধর, অধীর সূত্রধর জগদীশ সূত্রধরেরা। তাঁদের বন্ধুরা কেউ আসাম, ভুটান আবার কেউ বাসঙ্গালেরের শ্রমিকের কাজ করেন। দেবী কলোনির জগদীশ সূত্রধর নিজেই জানালেন, ট্রেনে ফেরার পথেই সিকিমের ভয়াবহ বিপর্যয়ের কথা শুনে বুকটা কেঁপে উঠেছে। তবুও কি করবো গ্রামে তো কাজ নেই, উৎসবের রেশ কাটলেই ফিরে যেতে হবে ফের দিল্লির নয়ডায়।
দিল্লি থেকে ফিরেই বন্ধুদের সঙ্গে উৎসবের প্রস্তুতিতে মেতে উঠেছেন অধীর সূত্রধর। তাঁর বক্তব্য, একমাত্র এই উৎসবের সময়ে মালিক ও ঠিকাদারেরা ছুটি দেয়। অন্য সময়ে ছুটি নিলে কাজ চলে যাবার ভয় থাকে। তাই প্রতিবারই আসি। আমার বন্ধু রফিক,ওসমানেরা ঘরে আসে ঈদের সময়ে। উৎসবের সময়ে শুধু মাত্র কোচবিহার জেলাতেই ঘরে ফেরে কম বেশি দেড় লক্ষ মানুষ। আবার যারা ইঁটভাটায় কাজ করেন তাঁরা অনেকেই উৎসবের আগেই বর্ষা ফুরোতেই ভিন রাজ্যে চলে গেছেন। কেউবা যাবেন উৎসবের ঠিক পরেই। তবে এবারে উৎসবের আগে পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিবারের মধ্যে স্বজন হারানোর আশঙ্কা বেশি করে দানা বাঁধছে সিকিমের বিপর্যয়ের পরে।
নয়ারহাটের বাসিন্দা দীনবন্ধু রায়ের বয়স এখন ৭০-এর কোঠায়। দুই ছেলেই বৌমা, বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে রাজস্থানে কাজ করেন। বয়স্ক মানুষটার গলায় স্পষ্ট উদ্বেগ ফুটে উঠছে। তাঁর মন্তব্য,"ছেলেরা বাড়িতে যে কটা দিন থাকে সেই কটা দিন শান্তিতে থাকি। নইলে রাত জেগে ভাবি ওরা ভালো আছে তো, সুস্থ আছে তো!"
আসলে সিকিমের এক রাতের ভয়াবহ বিপর্যয় বদলে দিয়েছে কোচবিহারের গোসাইহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের ছোটধাপেরচাত্রা গ্রামের প্রসেজিৎ বর্মণ, বিষ্ণু বর্মণ, সহদেব বর্মণ, সুজন বর্মণদের মত ৭ পরিযায়ী শ্রমিকের পরিবারের স্বাভাবিক জীবন যাপনের চালচিত্রটাই। বাঙালীর জীবনের বড় উৎসব দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে অথচ ওঁদের পরিবারে উৎসবের আলো ঢোকার কোনও প্রশ্নই নেই।
ওরা ৭ জনই সিকিমের লাচুংয়ে কাজ করতে গিয়েছিল। গত ৩ অক্টোবরের বিপর্যয়ের পর ওঁদের সঙ্গে পরিবারের আর যোগাযোগ নেই। মোবাইল ফোনও সুইচ অব রয়েছে। পরিবারগুলির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, যে ঠিকাদারের সঙ্গে ওঁরা কাজে গিয়েছিল তার সাথেও আর যোগাযোগ করতে পারছে না ঠিকাদারের পরিবার। শিতলখুচির লালবাজার গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার উত্তম সরকার, রাজু বর্মণ, বিনয় বর্মণও নিখোঁজ সেদিন রাত থেকেই। 
ছোট ধাপেরচাত্রা গ্রামের প্রসেনজিত বর্মনের বাবা চিত্র বর্মণ বলেন, ছেলেটা কোথায় কিভাবে আছে জানি না। ও আদৌ বেঁচে আছে কিনা কিছুই বুঝতে পারছি না। মাস ছয়েক আগে সিকিমে কাজ করতে গিয়েছিল। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগের দিন রাতেও ফোনে বলেছিল, মহালয়ার পরেই মজুরির টাকা নিয়ে বাড়ি আসবে। কার জন্য কি কিনবে সেসবও আলোচনা করছিল ছেলেটা। কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল বুঝতেই পারছি না। আমাদের পরিবার থেকে উৎসব হারিয়ে গেছে। নগর লালবাজারের গৃহবধূ সাগরিকা বর্মনের বক্তব্য, ৩ অক্টোবর শেষবার ফোনে কথা হয়েছিল স্বামীর সঙ্গে। তারপর আর যোগাযোগ হয়নি ওর সাথে। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন গৃহবধূ। উৎসবের জন্য ক’দিন পরেই সব অফিসে ছুটি হয়ে যাবে। উৎকন্ঠায় থাকা ৭ পরিবারের সদস্যরা ছুটে বেড়াচ্ছেন থানা থেকে বিডিও অফিসে।
সুজন বর্মণের পরিবারের সদস্যদের আক্ষেপ একটাই ঘরের ছেলে আর ফিরবে কিনা বুঝতে পারছি না। প্রশাসন থেকে শুধু বলা হচ্ছে,"খোঁজ চলছে।"কেউই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না। এরকম অবস্থায় উৎসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায়?
বালুরঘাট থানার অন্তর্গত বিভিন্ন গ্রামের পরিযায়ী শ্রমিকের খোঁজ মিলছে না। ভ্যারেন্ডা শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রামের চার আদিবাসী শ্রমিকের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। দিশাহারা পরিবারগুলি। প্রায় দুই সপ্তাহ হয়ে  গেলেও কোনও হদিশ মেলেনি। পুলিশ প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েও নিঁখোজদের খোঁজ মেলেনি বলে ক্ষোভ পরিবার সহ গ্রামবাসীদের। জানা গিয়েছে, ওই গ্রামের নিঁখোজদের মধ্যে রয়েছেন জয়ন্ত মুর্ম, সুজয় টুডু, বিক্রম সোরেন এবং বিক্রমের বাবা বাদল সোরেন। শিলিগুড়ির এক ঠিকাদারের সঙ্গে এঁরা সিকিমে কাজে গিয়েছিলেন। কিন্ত সেখানে বিপর্যয়ের পর থেকে এই শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পরিবারের। পরিবারের সদস্য  সুজাতা বেসরা, মাতলা মুর্মু জানান, সিকিমের বিপর্যয়ের পর থেকেই গ্রামের পথ চেয়ে আছেন তারা। শ্রমিকদের  ফোনের কোন সংযোগ পাচ্ছে না।  ওই গ্রামের বাসিন্দারা আরো জানান পার্শ্ববর্তী গ্রাম  কুড়াইডাঙার ৩জন, নপাড়ার ১জন  এবং দরিয়াল গ্রামের ১ জন শ্রমিকেরও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁদের পরিবারও প্রশাসনের  সব মহলে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু এখনও প্রশাসন তারা বেঁচে আছে কিনা জানাতেই পারেনি।

Comments :0

Login to leave a comment