Joynagar murder

জয়নগারে আবার আটকানো হলো পার্টির নেতা, কর্মীদের, তিন দিন পার, তিন অপরাধে গ্রেপ্তার মাত্র ১

জেলা

 সোমবার ভোরে খুন হয়েছেন তৃণমূলের নেতা সইফুদ্দিন লস্কর। বুধবার রাত পর্যন্ত পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পেরেছে মাত্র ১জনকে। সেই সরিফুল শেখকেও পুলিশ পেয়েছে, কারণ, সইফুদ্দিনের বাহিনী তাকে বেধড়ক মেরেছিল। সে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। 
সোমবার ঘটনাস্থলেই তৃণমূলের বাহিনী আর একজনকে মেরে ফেলে পিটিয়ে। তার নাম সাহাবুদ্দিন লস্কর। সেটিও খুন। পুলিশ সেই ঘটনাতেও কাউকে গ্রেপ্তার করেনি।
সোমবারই আর একটি মারাত্মক অপরাধ হয়েছিল। সইফুদ্দিন খুনের পর এক তৃণমূল নেতা তথা পঞ্চায়েত সদস্যর নির্দেশে তৃণমূলের একদল দুষ্কৃতী প্রায় চার কিমি দূরে দলুয়াখাকিতে হামলা চালায়। অন্তত ২০টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। ৩০টি বাড়িতে লুট করে, ভাঙচুর চালায়। মহিলাদের মারে, শ্লীলতাহানি করে। শিশুদের ছুঁড়ে পুকুরে ফেলে দেয়। গ্রামছাড়া করে অনেককে। দলুয়াখাকিতে পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে সিপিআই(এম) প্রার্থীকে জোর করে তৃণমূল হারিয়ে দেয়, তাঁর বাড়িতেও হামলা হয়েছিল। ওই হামলা, ঘর জ্বালানোর ঘটনাতেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। তবে জয়নগর থানার এক আধিকারিক বুধবার জানিয়েছেন,‘‘যার নির্দেশে দলুয়াখাকিতে হামলা হয়েছিল, তিনি পঞ্চায়েত সদস্য। তাকে চিহ্নিত করা গেছে। কিন্তু গ্রেপ্তারের কোনও নির্দেশ আসেনি।’’
জয়নগরের ঘটনায় পুলিশ কিছুই করেনি। যা করেছে তৃণমূল। পুলিশ একটিই কাজ করেছিল, তা মঙ্গলবার। সেদিন দলুয়াখাকির ঘরছাড়া মহিলারা বাড়ি ফেরার চেষ্টা করলে পুলিশ মেরে তাদের আটকেছে। বুধবার দলুয়াখাকির মহিলারা ফিরতে পারলেও তাঁদের এগিয়ে দিতে যাওয়া সিপিআই(এম) নেতৃত্বকে আটকেছে পুলিশ।
বুধবার তখন বিকেল। তানজিরা লস্কর, আলিমা লস্কর, সাইনুল লস্কর, আসিদা লস্কর, জাহানারা লস্কর সহ গৃহহীন ২৫ জন মহিলা গ্রামে ফিরেছেন। মঙ্গলবার ভোরের আলো ফুটতেই গ্রাম ছেড়ে তাঁরা দক্ষিণ বারাশতে সিপিআই(এম) দপ্তরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ওই দিন বিকালে সিপিআই(এম) দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা নেতৃত্বর সঙ্গে তাঁরা গ্রামে ফিরতে গেলে পুলিশি বাধায় তাঁরা ফিরতে পারেননি। রাতে পার্টি নেতৃত্বের সঙ্গে জয়নগর থানায় আলোচনায় ঘরছাড়া মহিলাদের ঘরে ফেরানো, তাঁদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেন পুলিশ আধিকারিকরা। তা সত্ত্বেও বুধবারও জয়নগরের স্থানীয় পার্টি নেতৃত্বকে গ্রামে ঢুকতে বাধা দেয় পুলিশ। মহিলারা গ্রামে পৌঁছেছেন। পার্টির দেওয়া ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে ফিরলেন গ্রামে। গ্রামে ফিরতে পারলেও আতঙ্ক তাড়া করে ফিরছে এখনো গ্রামবাসী মহিলাদের। ঘটনার পর থেকে এখনো পুরুষ শূন্য গোটা গ্রাম। এখন পুলিশ পিকেট থাকলেও কোনও ভরসা করতে পারছেন না তাঁরা। তাঁদের কথায়, জয়নগর থানার এই  পুলিশের সামনেই তো  সেদিন প্রায় চার ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালিয়েছে তৃণমূলের সশস্ত্র বাহিনী। বাড়ির উনুন পর্যন্ত ভেঙে দিয়েছে। বাসনপত্র ভেঙে দিয়েছে। ছেলে মেয়েদের বইপত্র পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়েছে। ভস্মীভূত হয়েছে গ্রাম। এরপর আর কি এই পুলিশের উপর ভরসা করা যায়। এদিনও পার্টি নেতৃত্বকে ঢুকতে দিল না গ্রামে। 
বাড়ি পুড়ে ছাই হয়েছে। খোলা আকাশের নিচেই আমাদেরকে থাকতে হবে। বললেন মঞ্জিলা লস্কর। পরনের শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন, মাটির উনুনটাও ভেঙে দিয়েছে পাষন্ডরা। ঘরে কিছুই নেই। সব পুড়ে ছাই হয়েছে। দলুয়াখাকি গ্রামে হাহাকার আর কান্না। বাতাসে এখনো পোড়া গন্ধ। এখনো হুমকি। গ্রাম থেকে পুলিশ সরলেই ফের হামলার আশঙ্কা করছেন গ্রামের বাসিন্দারা। 
সিপিআই(এম) জয়নগর ১ এরিয়া কমিটির সম্পাদক আব্দুল ওদুদ মোল্লা পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন,‘‘পার্টি নেতা অলোক ভট্টাচার্য সহ আমরা গ্রাম ছাড়া মহিলাদের নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলাম। দলুয়াখাকি গ্রাম থেকে এদিন প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে রায়নগর চৌরাস্তার মোড়ে পুলিশ আমাদের পথ আটকে দিল। কয়েক জন মহিলা নেতৃত্বকে তাঁদের সঙ্গে পাঠানো হলো। তাঁদেরকেও গ্রাম থেকে প্রায় আধ কিমি দূরে আটকে দেয় পুলিশ। সেখান থেকেই মহিলারা নিজেরাই গ্রামে ফিরেছেন।’’
অন্যদিকে পুলিশের দাবি, সরিফুল জেরায় জানিয়েছে যে, সইফুদ্দিনকে খুনের সুপারি দিয়েছিল মন্দিরবাজারের টেকপাঁজা গ্রামের নাসির হালদার। পুরানো জিনিসের কারবারি নাসিরকে ভুয়ো কেসে ফাঁসিয়েছিল সইফুদ্দিন। তারই বদলা হিসাবে নাসির সইফুদ্দিনকে খুনের চক্রান্ত করেছিল বলে পুলিশকে জানিয়েছেন ধৃত সরিফুল। পুলিশ বুধবার টেকপাঁজায় নাসিরের বাড়িতে গেছিল। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। ধৃত সরিফুলকে মঙ্গলবার আদালতে তোলা হয়েছিল। তাকে ১৪দিন পুলিশ হেপাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি। 
সইফুদ্দিনকে খুনের জন্য পাঁচজন এসেছিল দু’টি মোটরবাইকে, সইফুদ্দিনের ঘনিষ্ঠরা পুলিশকে তাই জানিয়েছেন। একটি মোটরবাইকে ৩জন ছিল। আর একটিতে ২জন। সাহাবুদ্দিন এবং সরিফুল মোটরবাইক থেকে পড়ে যায়। সরিফুলের দাবি, খুনের জন্য গুলি চালিয়েছিল সাহাবুদ্দিন। কিন্তু বাকি ৩জনের পরিচয় পুলিশ এখনও জানতে পারেনি। খুনের মোটিভ সম্পর্কেও পুলিশ এখনও নিশ্চিত হয়নি। গত বারো বছরে সে দেদার সম্পত্তি করেছিল। পুলিশ জানত, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে দলের সভায় সইফুদ্দিনের স্ত্রী সেরিফা খাতুনকে আবার প্রধান করার বিরোধিতা করেছিলেন কয়েকজন। ২০১৮ থেকে ২০২৩ — বামনগাছির প্রধান ছিলেন সেরিফাই। কিন্তু কোনও আপত্তিরই তোয়াক্কা করেননি সইফুদ্দিন। যেহেতু পুলিশের সঙ্গে খুবই দহরম মহরম ছিল সইফুদ্দিনের এবং যেমন ইচ্ছা পুলিশ-কেসে ফাঁসিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল তার, দলের বিরোধী অংশও বিশেষ ঘাঁটাতে চায়নি তাকে। তাই সইফুদ্দিনের স্ত্রীই ফের প্রধান হয়। গ্রামবাসীদের একাংশের সন্দেহ, আবার স্ত্রীকে প্রধান করে পঞ্চায়েতের দখল নেওয়ার কারনে সইফুদ্দিনের উপর রাগ ছিল দলেরই একাংশের। তারা এই খুনের পিছনে থাকতে পারে।
তবে তৃণমূলের নেতৃত্বের নির্দেশ ছাড়া এই ঘটনার তদন্ত পুলিশ করবে না, এই বিষয়ে গ্রামবাসীদের বিশেষ সন্দেহ নেই।
মঙ্গলবার রাতেই দলুয়াখাকির ২৫ জন মহিলা সিপিআই(এম)নেতা সুজন চক্রবর্তী, শমীক লাহিড়ী, কান্তি গাঙ্গুলি, রাহুল ঘোষ, রতন বাগচী, প্রভাত চৌধুরী সহ স্থানীয় নেতৃত্বর উপস্থিতিতে থানায় এফআইআর করেছেন। তাঁদের দাবি, অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। সিপিআই(এম) দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক শমীক লাহিড়ী আগামী ২৭ নভেম্বর জয়নগর থানা অভিযানের ডাক দিয়েছেন। তৃণমূলের এই বর্বরোচিত হিংসা, আক্রমণের ঘটনার প্রতিবাদে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা জুড়ে ধিক্কার মিছিল, সভা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন তিনি।
 

Comments :0

Login to leave a comment