Post Editorial

ভার্চুয়াল জগতের হাতছানি নয় বাস্তবের অভিজ্ঞতায় বুঝতে হবে অধিকার

উত্তর সম্পাদকীয়​

 
মণীন্দ্র চক্রবর্তী

অর্ধনগ্না একজন ধর্ষিতা তরুণী, রক্তাক্ত অবস্থায় সাহায্যের কাতর আর্তি নিয়ে একের পর এক বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লেও, কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে তো এলোই না। উলটে কেউ কেউ তাকে কটু কথাও শুনিয়ে দিলো। সোশাল মিডিয়ায় দেখা গেল, রক্তে ভেসে যাচ্ছে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা সেই তরুণীর পাজামা। তথাপি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সবাই। 
        দৃশ্য দুই: পরিকল্পনা করে সন্তানকে খুন করেছে মা এবং তার বান্ধবী। বেশ কিছুদিন বাদে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। আদালতে পেশ করার সময়ে কিংবা তার পরেও, ন্যূনতম অপরাধ বোধটুকুও ফুটে উঠলো না তাদের চেহারায়। 
       দৃশ্য তিন: বৃষ্টির রাতে প্লাস্টিকে মুড়ে মা-কে  ফেলে রেখে গেল মেয়ে। 
       দৃশ্য চার: সন্দেশখালিতে শাসকদলের পার্টি অফিসে পিঠে বানানোর জন্য এলাকার মা-বোনেদের গভীর রাতে ডেকে পাঠানো হতো।
       পাঁচ, ছয়, সাত করে অনায়াসেই একটি বিশাল তালিকা তৈরি করে ফেলা যায়, যেগুলো সম্পর্কে নাগরিক সমাজ ছিল প্রায় প্রতিক্রিয়াহীন। সমাজের এই নিস্পৃহতার সুযোগটিকে ব্যবহার করে, শাসকেরা অত্যন্ত সন্তর্পণে ব্যক্তি সত্তার চারপাশে এমন একটা অনুভূতিহীন নির্মম পৃথিবী গড়ে ফেলেছে, যেখানে প্রেম- ভালোবাসা, আবেগ-অনুভূতি এবং সামাজিক মূল্যবোধের কোনও স্থান নেই। 
       আবেগ বর্জিত এবং অনুভূতিহীন একটা পৃথিবী কতখানি কুৎসিত হতে পারে, প্রায় একশো বছর আগে তার একটা আভাস পাওয়া গিয়েছিল অ্যালডাস হাক্সলি'র রচনায়। বিবেক তথা মনুষ্যত্ব ধ্বংস করার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে, আগামীর পৃথিবীটা কিভাবে নরক হয়ে উঠবে, তার একটা বহুমাত্রিক ছবি এঁকেছিলেন তিনি তাঁর 'ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড' উপন্যাসে। কল্পবিজ্ঞানের সেই কাহিনি পাঠকদের হাজির করে এমন এক ভবিষ্যতে, যেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় হ্যাচারির ইনকিউবেটরে। 
        ১৯৩২ সালে প্রকাশিত উপন্যাসটির পটভূমি ছিল ২৫৪০ সাল। গোটা পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ তখন এমন কয়েকজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে, যারা বিশ্ব রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের ভ্রূণাবস্থাতেই পাঁচটি পৃথক সামাজিক শ্রেণিতে বিভক্ত করে নেয়। এবং সেই প্রক্রিয়া শুরু হয় সেন্ট্রাল লন্ডন হ্যাচারি অ্যান্ড কন্ডিশনিং সেন্টারের কৃত্রিম গর্ভে। যান্ত্রিকভাবে মানব উৎপাদনের সেই বিজ্ঞানসম্মত প্রকল্পে আলফা এবং বিটা শ্রেণিতে তাদেরকেই রাখা হয়, যারা ভবিষ্যতে 'ওয়ার্ল্ড স্টেট' বা 'বিশ্ব রাষ্ট্র'-র নেতা কিংবা বুদ্ধিজীবী হয়ে উঠবে। আর গামা, ডেলটা, এফসিলন শ্রেণির মানুষেরা হবে কলে- কারখানায় কাজ করা খেটে খাওয়া মজুর প্রকৃতির লোকজন। এই শ্রেণির ভ্রুণগুলোকে শক্তি ও বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে পূর্ববর্তী শ্রেণির থেকে কিছুটা দুর্বল করে তৈরি করা হয়। সবচেয়ে নিচের শ্রেণি এফসিলনকে অক্সিজেন বঞ্চিতকরণ ও রাসায়নিক ব্যবস্থার মাধ্যমে শুধুমাত্র শারীরিক পরিশ্রম করার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তোলা হয়।
          শুধু তাই নয়, বেড়ে ওঠার গোটা পর্বে শ্রেণির ভিত্তিতে শিশুগুলিকে পরিচর্যা এবং নির্দিষ্ট শ্রেণি অনুযায়ী তাদের মানসিকতা গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া চালানো হতো। যেমন, অধস্তন শ্রেণির শিশুদের বই ও ফুল ঘৃণা করতে শেখানো হতো। যাতে কোনোভাবেই তাদের মধ্যে সৌন্দর্যবোধ, আবেগ, ভালোবাসা এবং জ্ঞানপ্রীতির উন্মেষ না ঘটে। আবার উচ্চ শ্রেণির জন্য ছিল অন্যরকম শিক্ষাক্রম। গোটা প্রক্রিয়াটি চালানো হতো একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে। এমনকি, নিদ্রারত শিশুরাও যাতে নিজ নিজ শ্রেণির জন্য নির্দিষ্ট নীতিকথাগুলো শিখতে পারে তার জন্য সম্মোহনী ভাষা এবং পদ্ধতি প্রয়োগ করে ঘুমন্ত শিশুদের কানে ফিসফিসিয়ে শ্রেণি দায়িত্ব ও কর্তব্যপালন সহ বিভিন্ন উপদেশ দেওয়া হতো। পাশাপাশি, চরম আবহাওয়ায় মজুরেরা যাতে টিকে থাকতে পারে, তারজন্য আলাদা করে তাদের টিকাও দেওয়া হতো। শুধু তাই নয়, এই নিম্ন বর্গীয় মানুষগুলিকে পূর্ণমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তাদের উপর এক বিশেষ ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করা হতো। যার প্রভাবে কেউ কোনও ব্যথা বা দুঃখ-কষ্ট অনুভব করত না, বরং সবাই নিজেকে সুখী ভাবতো। 
      এর প্রায় বারো বছর বাদে, অনেকটা এই ধরনের একটি পৃথিবীর কথা লিখলেন জর্জ অরওয়েল। '১৯৮৪' নামক উপন্যাসে তিনি উল্লেখ করলেন এমন এক সমাজের কথা, যেখানে বাক্‌স্বাধীনতার কোনও স্থান নেই। শুধু তাই নয়, সেখানে মানুষের যাবতীয় কার্যকলাপ সরকার পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিটি বাড়ির ভিতরের দেওয়ালে একটি যান্ত্রিক পর্দা রয়েছে, যার মাধ্যমে রাষ্ট্র বাড়ির প্রতিটি সদস্যের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতে পারে।
        রাষ্ট্রের এই নজরদারি আজ আর কেবল কল্পকাহিনিতেই সীমাবদ্ধ নেই, প্রতিটি দেশেই তার অনুশীলন চলছে জোর কদমে। এবং শাসক সেটি পরিচালনা করছে সমাজের সর্বস্তরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার উদ্দেশ্য নিয়ে। তফাৎ কেবল প্রয়োগ এবং পদ্ধতির। অরওয়েলের বলেছিলেন— শাসক ভয় দেখিয়ে, বলপ্রয়োগ করে মানুষকে অনুগত করবে। নির্যাতন চালিয়ে সে বাধ্য করবে মানুষকে যে কোনও ধরনের কাজ করাতে। অন্যদিকে হাক্সলি লিখলেন—জোর জবরদস্তি, কিংবা নির্যাতন করে শাসক কাউকে বাধ্য করবে না। মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে আনন্দ দানের মধ্যে দিয়ে। যার ফলে, মানুষ নিজে থেকেই শাসকের পা চাটবে। আজকের প্রেক্ষিতে যদি বিচার করি, তাহলে দুটি অভিমতের কোনোটিকেই ফেলে দেওয়া যাবে না। সত্যিই তো শাসক আজ কাউকে জোর করে বাধ্য করে না। গ্রামসির ভাষায়— শাসক এমনভাবে সম্মতি নির্মাণ করে যে, স্বেচ্ছায় মানুষ সব কিছু মেনে নেয়। একান্তই যদি না মানে, তখন বলপ্রয়োগের রাস্তা তো খোলাই রইলো। 
          অরওয়েল দেখিয়েছিলেন, জ্ঞান চর্চার পথ রূদ্ধ করতে শাসকেরা বই-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে। হাক্সলি বললেন, তার কোনও প্রয়োজনই হবে না। কারণ, মানুষ আর বই পড়তে চাইবে না। অরওয়েল বললেন, শাসকেরা মানুষকে তথ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে। কিন্তু হাক্সলি বললেন, ব্যাপারটা হবে উলটো। এত বিপুল পরিমাণে তথ্য মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হবে যে, সেটা আত্মস্থ করার মতো ধৈর্য কিংবা মনোসংযোগ কোনোটিই তার আর অবশিষ্ট থাকবে না। ফলে নিজে থেকেই সে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। বস্তুত হচ্ছেও তাই। কোনও সরকারই বই-কে ঘৃণা করতে শেখায় না, তথাপি মানুষ আজ বই বিমুখ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, পড়ার আগ্রহ হারানো সেই মানুষগুলির সামনেই খুলে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন তথ্য সংবলিত বিশাল এক জ্ঞানভাণ্ডার। এবং সেই জ্ঞানভাণ্ডারের ব্যাপ্তি এত বিস্তৃত যে, সেটা আত্মস্থ করবার মতো ধৈর্য বা মনযোগ মানুষের আর থাকছে না। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, মানুষের এই ক্ষয়িষ্ণু মনযোগকেই একটি বিরলতম বিনিময়যোগ্য পণ্যের মান্যতা দিয়ে গোটা বিশ্বে গড়ে উঠেছে 'অ্যাটেনশন ইকনমি' বা মনোযোগের অর্থনীতি। যে অর্থনীতি মানুষের মনোযোগ বিক্রি করে বছরে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার— অর্থাৎ বছরে পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের ব্যবসা করার রাস্তা খুলে দিয়েছে কর্পোরেট সংস্থাগুলির কাছে। এবং সেই অঙ্কটা প্রত্যেক বছর বেড়ে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। কিন্তু কিভাবে? 
      একটা উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন। এই মুহূর্তে গোটা বিশ্বে ইউটিউব ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ২.৬ বিলিয়ন, মানে প্রায় ২৬০ কোটি। এরা প্রতিদিন গড়ে যদি একঘণ্টা করে ব্যবহার করেন, তাহলে বুঝতেই পারছেন কি বিপুল পরিমাণ সময় ওরা আমাদের থেকে কেড়ে নিচ্ছে। এর সাথে যুক্ত করুন ফেসবুক সহ অন্যান্য সমাজমাধ্যমে ব্যয় করা সময়ের পরিমাণ। এই বিপুল সময় ধরে মানুষ যখন এই ধরনের অ্যাপ্লিকেশনগুলিতে সক্রিয় থাকছেন, সেই সময়গুলিতে বিজ্ঞাপন বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করছে সংস্থাগুলি। আপনার মনে হতে পারে, আমার মনের চাহিদা মেটানোর জন্য ওরা তো বিনা পয়সায় আমাকে পরিষেবা দিচ্ছে, তার বদলে যদি ওরা দু'পয়সা রোজগার করে, তাতে ক্ষতি কি?
        ক্ষতিটা অন্য জায়গায়। পরিণতিতে দেখা যাচ্ছে, মানুষ আগের মতো একে অপরের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলে আর আনন্দ পাচ্ছেন না। কোথাও আবার মানুষ কথা বলার মতো লোকই খুঁজে পাচ্ছেন না। আসলে, এই অ্যাপগুলি ব্যবহার করে আমরা যখন সমাজমাধ্যমে সক্রিয় থাকছি, তখন অনেকের মাঝে বিচরণ করলেও, কার্যত সেই মুহূর্তগুলিতে আমরা এক নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছি। এক অদৃশ্য শক্তি আমাদের যাবতীয় মানবিক সত্তাগুলিকে পারিপার্শ্বিকতা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকেই আমরা তখন জনমানবহীন কোনও এক নাম না জানা দ্বীপের বাসিন্দা। যেখানে জাগতিক কোনও ঘটনাবলীর ক্ষমতা নেই যা আমাদের স্পর্শ করে। কিন্তু যেই মুহূর্তে সম্বিৎ ফিরছে, তখন আমরা অনুভব করছি, ভয়ঙ্কর এক হতাশা ঘিরে ধরছে আমাদের। নিজের মধ্যে জন্ম নেওয়া এই একাকীত্ব থেকে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা। কুরে কুরে খাচ্ছে আমাদের মূল্যবোধ— ধ্বংস হচ্ছে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, মানবিক গুণাবলী। 
       কিন্তু তাই বলে কি পুঁজিপতিরা তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেবে? মোটেই না, বরং কিভাবে আরও বেশি পরিমাণ সময় মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া যায়, তার জন্য তারা চেষ্টা করবে। এবং সেটাই তারা করছে। মুনাফা বৃদ্ধির জন্য গ্রাহককে আরও বেশি সময় ধরে যাতে স্ক্রিনে আটকে রাখা যায়, তারজন্য তারা আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করছে। তথাপি যে সময়টুকু আমরা অ্যাপগুলিতে কাটাচ্ছি, সেই দেয় সময়টা পুঁজিপতিদের কাছে যথেষ্ট নয়। তাই সেই স্ক্রিনগুলোতে প্রতিনিয়ত তারা নিত্যনতুন বিষয়বস্তু হাজির করছে, যাতে মানুষ সেখান থেকে চোখ না ফেরাতে পারে। এ ক্ষেত্রে তারা কতটা মরিয়া, সেটা নেটফ্লিক্সের কর্ণধারের ঘোষণাতেই স্পষ্ট। বছর খানেক আগে একটি ছোট্ট ঘোষণায় তিনি জানিয়েছিলেন— এখন ঘুম কেড়ে নিতে হবে আমাদের। অর্থাৎ আপনার বিশ্রামের সময়টাও ওরা কেড়ে নিতে চাইছে নিজেদের মুনাফার স্বার্থে। দেশের সরকার এই বিষয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে বলে এখন অবধি শোনা যায়নি। কারণ সরকারও চায় মানুষ ভার্চুয়াল জগতে আবদ্ধ হয়ে থাকুক, নিজেকে মজিয়ে রাখুক। কারণ, বাস্তবের মাটিতে পা দিলেই তো সে ভাত চাইবে, চাকরি চাইবে, গণতন্ত্র এবং সামাজিক নিরাপত্তা চাইবে। 
       প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের ঘুম কেড়ে নিয়ে যারা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে চাইছে, তাদের ঘুমের ব্যাঘাত যাতে না ঘটে তারজন্য আমরা আমাদের বিশ্রামের সময়টা তাদের হাতে তুলে দেব, নাকি যারা আমাদের ঘুম কাড়তে চাইছে, মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করে আমরা তাদের ঘুম কেড়ে নেব। সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাকেই।

Comments :0

Login to leave a comment