সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
সত্যি কথা বলতে কি আজকে পশ্চিম বাংলায় সিনেমার বৌদ্ধিক পরিকাঠামো বলতে যা যা বোঝায় তার সিংহভাগ, সিংহভাগ কেন শতকরা ৮০ ভাগই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর অবদান। অবশ্যই আমি জানি এটা বামফ্রন্ট এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের অবদান। তবু, ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা থাকে একথা প্লেখানভ বলেছিলেন, তাই বুদ্ধদেবের ভূমিকাও অবিস্মরণীয়। এই যে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, এই যে নন্দন, এই যে রূপকলা কেন্দ্র, রূপায়ণ, এই যে জেলায় জেলায় চলচ্চিত্র উৎসব- সবকিছুই ওনার চিন্তার অনুসরণ করেই হয়েছে।
বুদ্ধদা ছাড়া কে এত চিন্তা করেছেন সিনেমা নিয়ে? আমরা আর কবে এমন মুখ্যমন্ত্রী পাব যিনি প্রোটোকলের তোয়াক্কা না করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের তৈরি ছোট ছোট ছবি দেখতে, আলোচনা করতে অর্থাৎ ভর দুপুরে ক্যাম্পাসে চলে আসবেন! আর যদি ব্যক্তির কথা হয় তাহলে তো তার প্রেম শুরু হয়েছিল বুদ্ধদার কলেজে পড়ার দিন থেকেই। উনি খুব গর্ব করে আমাকে বলতেন, ‘শোনো, তুমি ঋত্বিক ভক্ত হতে পারো। কিন্তু, কোমল গান্ধার যখন এলো, ফ্লপ করল। আমরা তো পূরবী সিনেমা হলে দেখতাম, পরপর পাঁচ দিন দেখানো হয়েছিল। প্রায় শূন্য প্রেক্ষাগৃহ, তাতে ৩-৪ জন দর্শক থাকতো রোজ। তাদের মধ্যে আমি একজন বুঝলে...’। সুবর্ণরেখা যখন মুক্তি পেল সেই সময় নন্দন পত্রিকার পক্ষ থেকে ওই সিনেমাটি নিয়ে ‘অবক্ষয়’জাতীয় কিছু তির্যক মন্তব্য ছিল। কিন্তু বুদ্ধদা অকুতোভয় একটি প্রতিবাদ পত্র লেখেন তা ছাপাও হয়। তাতে উল্ল্যেখ করা হয়, সুবর্ণরেখা চিরকালের জীবনধর্মী ছবি, এই সিনেমা আমাদের পাথেয়। ঋত্বিকের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা জীবনে ফুরোয়নি। যখন কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব হয়, আমরা যখন বাংলা ছবিগুলো সাজাচ্ছিলাম, সেই সময় নিজে ছবিগুলো পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ঋত্বিক আর সত্যজিতের জন্য যেন আলাদা জায়গা থাকে। এই দু’জন আমাদের ইতিহাসে সোনার দাগ।
কলকাতায় ফিল্ম সোসাইটিগুলো জনসাধারণের মধ্যে চলচ্চিত্রবোধ জাগিয়ে তুলেছিল। কিন্তু বুদ্ধদা মনে করতেন, তার বিস্তার দরকার। তাই ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শুরুর উদ্যোগ নেন। প্রথম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে ওনার নেতৃত্বেই এই পাঠক্রম শুরু হয়। তাছাড়াও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন একটা সংগঠিত চলচ্চিত্র উৎসব হলে আন্তর্জাতিক যে সমস্ত ছবি দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে, বিদেশের যে সমস্ত অতিথিরা আসবেন, আমাদের সঙ্গে তখন তাঁদের যা আলাপ-আলোচনা হবে তাতে আমাদের ছোট্ট পুকুরটা একটা সমুদ্রে পরিণত হবে। সেখান থেকেই ওনার কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ভাবনাও।
কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে কোন কোন বিদেশি অতিথি আসবেন তা তিনি নিজে পরামর্শ দিতেন। আজকে চলচ্চিত্র উৎসবে যাদের দেখা মেলে না। জাফর পানাহি, জানুসি, সোলানাস, লিতিন, মেসজারোস, পল কক্সদের মতো বড় বড় পরিচালকরা এসেছেন। এই যে ইতালিয়ান বা ফরাসি চিত্র পরিচালক বা লাতিন আমেরিকান বা ইরানের চিত্র পরিচালকদের সাথে আলাপচারিতা হতো, তাতে আমাদের মনের পরিসর অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তিনি কিন্তু আলোচনা চক্রে কখনও হস্তক্ষেপ করেননি। পাসোলিনি, ত্রুফো, গোদার রেকট্রোস্পেক্টিভ কিন্তু তার সময়েই হয়েছিল। চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানোর জন্য যে সিনেমাগুলো নির্ধারিত হতো, সেগুলো নন্দনের তিনতলার ঘরে বসে উনিও আগে দেখতেন।
কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব যখন নথিভুক্ত হয় তখন বেসরকারি সদস্য ছিলাম মাত্র আমরা দু'জন। সূর্য বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদা’র প্রেসিডেন্সি কলেজের সহপাঠী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক, আর আমি। বাকিরা সবাই সরকারি উচ্চপদস্থ আমলা। সেই সময় চলচ্চিত্র উৎসবের কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা সেই সময় প্রকাশিত বইগুলোর মান বলে দেয়। আন্দ্রেই তারকোভস্কি ও ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো একই বছর জন্মেছিলেন বলা মাত্র, তিনি আমাদের বললেন এদের নিয়ে প্রকাশনা করো। আমরা খুব কম দিনের মধ্যে তা বানালাম। হিরণ মিত্র অসাধারণ একটি প্রচ্ছদ করলেন। বুদ্ধদা নিজে লেখাগুলো দিনের পর দিন নিজে দেখেছেন। যখন তারকোভস্কির বই নিয়ে তার কাছে গেলাম, সেখানে জঁ-পল সার্ত্র ‘ইভান্স চাইল্ডহুড’নিয়ে যা লিখেছিলেন, সেটা উদ্ধৃত করেছি দেখে আমার হাত জড়িয়ে ধরলেন। তাতে মার্কসবাদের একটা দিকও স্পষ্ট ছিল। কারণ, ইতালিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি ওই ছবিটাকে সমালোচনা করেছিল। কিন্তু সার্ত্রের সমর্থন বুদ্ধদা’র কাছে ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ ।
একইভাবে যখন আলেকজান্ডার সোকুরভের লেনিন এল, তখন রক্ষণশীল মার্কসবাদীরা প্রচুর সমালোচনা করেছিলেন লেনিনের শেষ বয়স দেখানো হয়েছে এবং লেনিনের অশক্ত শরীর দেখানো হয়েছে বলে। বুদ্ধদা’কে দেখেছি তাতে বিচলিত না হতে। কারণ তাঁর কাছে শিল্পই বড় কথা ছিল। তিনি সারা জীবন মনে করে গেছেন লেনিনের পার্টি প্রোপাগান্ডা এবং পার্টি লিটারেচার নামক প্রবন্ধটি। যেখানে লেনিন স্পষ্টতই বলেছিলেন, অন্যান্য গণসংগঠনের ক্ষেত্রে যে দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া যায়, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তা নেওয়া যায় না। এই একমাত্র জায়গা যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের বিচারের সংখ্যালঘুর মতামত বাতিল করা যায় না। কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর মন্ত্রিত্বের সময়, উপমুখ্যমন্ত্রিত্বের সময় এমনকি মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ও অক্ষরে অক্ষরে সেই নীতি পালন করে গেছেন।
আমার সাথে তার প্রথম দেখা ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। সেই সময় থানায় এক মহিলা নির্যাতিতা হয়েছিলেন। আমরা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা, সেই সময় একটা পুস্তিকা বার করি। তিনি সেই পুস্তিকা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। আমার লেখাতে কাম্যুর উদ্ধৃতি ছিল। তা পড়ে তিনি অবাক হয়ে আমায় জানতে চেয়েছিলেন, ‘আপনি কাম্যু পড়েন?’ তাতে যেন তিনিও গর্বিত। পরে আমাকে ‘তুমি’বলা শুরু করেন। কাম্যু এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি প্রীতি বুদ্ধদা’র আজীবন ছিল।
শেষে বলতেই হয় আঁদ্রে মালরো নবতরঙ্গ আন্দোলনকে যতটা সাহস জুগিয়েছিলেন, উৎসাহ দিয়েছিলেন, বুদ্ধদা চলচ্চিত্র তৈরির জন্য নতুনদের তার চেয়ে কম উৎসাহ দেননি। তার আমলে যত তথ্যচিত্রের ভাণ্ডার খুলে যায়, যত তরুণ ক্যামেরা ধরেছে, আর কোনও মুখ্যমন্ত্রীর সময় তা হয়েছে কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। তিনি আজীবন সুবর্ণরেখার পানশালায় উপনিষদের উদ্বৃতিটুকু নীজের জীবনযাপনে অক্ষত রেখেছিলেন।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য চলে গেলেন, সত্যি সিনেমায় পর্দা কালো হয়ে গেল।
Comments :0