নিরঞ্জন সিহি
বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে এই রাজ্যে এখন যিনি প্রধান হিসাবে সরকার পরিচালনা করছেন তিনি বলতেন এবং বারে বারে আন্দোলনও করেছেন বামফ্রন্ট সরকারকে দায়ী করে বন্যাকে ‘ম্যান-মেড’ বলে । এবং প্রায়শঃই বলতেন ইচ্ছাকৃতভাবে বন্যা করা হয়েছে। ঐ বন্যার দায় বামফ্রন্ট সরকারের। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে কুৎসা করে গেছেন লাগাতার। আশ্চর্যের বিষয় ২০১১ সালে সরকার পরিবর্তন হওয়ার পরও তিনি একই কথা বলে যাচ্ছেন। এবার বন্যা যখন হলো— ডিভিসি ও কংসাবতী ব্যারেজ থেকে জল ছাড়ার ফলে দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। তখনও তিনি বলছেন ম্যান-মেড বন্যা। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো যে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী এই বন্যাকে নিয়ে মিডিয়ার সামনে যে প্রলাপ বকে যাচ্ছেন। প্রশ্ন হলো ওনার মুখ্যমন্ত্রীত্বের সময় উনি কেন এই ’ম্যান-মেড’কে মোকাবিলা করতে পারলেন না। আসলে নিজের ব্যার্থতা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজে দায় মুক্ত হতে চাইছেন। অভিজ্ঞতায় যতটুকু জেনেছি তাতে অবশ্যই কেন্দ্রেরও দায় আছে। আবার রাজ্যেকেও দায়িত্ব নিতে হয়। বন্যায় দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির কয়েক হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। যেমন- ধান, ফুল, সবজি, পানের বরোজের ক্ষতি সহ মাছের ভেড়ি এবং ব্যক্তি মালিকানার পুকুরগুলি থেকে হাজার হাজার টাকার মাছ বেরিয়ে গেছে। এই ক্ষতিপূরণের দায় কার ? শুধু কি কিছু ত্রাণ দিয়ে সরকার তার দায় এড়াতে পারেন? তাও যে ত্রাণ এখন দুর্গতদের কাছে ঠিকমত পৌঁছায় না। মুখ্যমন্ত্রী ব্যারেজ, নদী, নালা বুঝে উঠতেই পারছেন না বলে অন্তত তার বিবৃতিতে প্রকাশ পাচ্ছে।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলেও বন্যা মোকাবিলা হয়েছে। তাতে প্রশাসনের এই অপদার্থতার রূপ দেখা যায়নি। আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর অভয়া কাণ্ডের পর দিশাহারা হয়েছেন বলে মনে হয়। তাই এই বন্যা নিয়ে যা বলে যাচ্ছেন তা হয়তো সেই রেশ কাটিয়ে উঠতে না পারার ফল। তিনি যা বলছেন সেটা তার অজ্ঞতারই পরিচয়। যদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এই অবস্থা হয় তাহলে রাজ্যবাসীর কি হাল হতে পারে তা রাজ্যবাসীকে ভাবাতে অবশ্যই ভাবতে হবে। এবারে দক্ষিণবঙ্গে যে জলাধারগুলি হতে জল ছাড়া হয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারেরই চরম ব্যর্থতার প্রকাশ পায়। ডিভিসি ব্যারেজ ও দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন নিয়ন্ত্রিত হয় কেন্দ্রের তদারকিতে। ডিভিসি’র জন্য উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি থাকে। সেই তদারকি কমিটিতে এই রাজ্যের দু’জন উচ্চপর্যায়ের ইঞ্জিনিয়াররাও থাকেন। যখন নিম্নচাপের জন্য বৃষ্টি শুরু হলো তখন থেকেই ডিভিসি ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ ৫০ হাজার করে কিউসেক জল ছেড়ে রাখতে পারতো। এই ডিভিসি ড্যামে বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের সমগ্র জল আসে। ডিভিসি’র বাঁধ পশ্চিমবাংলায় অবস্থিত। কেন কেন্দ্রীয় সরকার ধীরে ধীরে জল ছাড়লো না ? রাজ্যের যে দু’জন অফিসার উচ্চপর্যায়ের কমিটিতে আছেন তারাও মুখ্যমন্ত্রীকে কেন রিপোর্ট করলেন না ? এবং মুখ্যমন্ত্রীও কেন হস্তক্ষেপ করলেন না ? ফলে দুই সরকারের দায়বর্তায়। ডিভিসি’র সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করলে কি পরে আর পশ্চিমবাংলায় বন্যা হবে না ? বা ডিভিসি কি জল ছাড়বে না ? ব্যারেজ কানায় কানায় পূর্ণ হতে আজকে যে সাড়ে তিন লক্ষ কিউসেক জল ছাড়ল, এখন একসাথে এই জল বের করে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় আছে কি? আপার ক্যাচমেন্ট-এ ৩ লক্ষ ৫০ হাজার কিউসেক জল ছাড়ে এবং লোয়ার ক্যাচমেন্ট-এ অথবা ব্যারেজের নিচু জায়গা (লোয়ার ক্যাবিনেট)-গুলিতে কমপক্ষে যদি ৫০ হাজার কিউসেক জল ড্রেনেজ হয় তাহলে সর্বমোট ৪ লক্ষ হাজার কিউসেক জল ড্যামের নিচে নদীগুলি থেকে এই জল ধারণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তার পরিণতিতে বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমানের একাংশ, হুগলী, হাওড়া ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে তার কিছু জল গঙ্গা নদীতে এবং কিছু জল পূর্ব মেদিনীপুরের রূপনারায়ণের উপর দিয়ে সমুদ্রে যায়। এই জেলাগুলির যে প্রভূত ক্ষতি হলো তার দায় কেন্দ্র ও রাজ্যের উপর বর্তায়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শুধুমাত্র ডিভিসির ওপর দায় চাপিয়ে ও মানুষের কাছে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য রেখে অসত্য কথা পরিবেশন করে দায়মুক্ত হওয়া যায় না।
ডিভিসি’র উচ্চপর্যায়ের কমিটিতে দু’জন উচ্চপর্যায়ের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন তাদেরকে এই কমিটি থেকে জোর করে পদত্যাগপত্র দিতে বাধ্য করিয়েছেন। এতে কি আগামী দিনে বন্যা হবে না ? বা পদত্যাগ করিয়ে সমাধান হয়ে যাবে ? এবার আসি কংসাবতী ড্যাম এই বিষয়টি রাজ্যের নিয়ন্ত্রিত ড্যাম। তাহলে কংসাবতী ব্যারেজ থেকে যে জল ছাড়লেন যখন ৪৩৪ ফিট জল আছে এবং নিম্নচাপের বৃষ্টিও হচ্ছে। ড্যামের আপার ক্যাচমেন্টে তখনতো এই ৪৩৪ ফিটকে ৪৩০ ফিটে আনার জন্য ১০/১২ হাজার কিউসেক করে জল ছেড়ে দিতে পারতেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তার নিয়ন্ত্রিত যে ড্যাম সেখানে তিনি তো সেই ব্যবস্থা করলেন না। তার ফল স্বরূপ দেখা যাচ্ছে ড্যামে যখন ৪৩৮ ফিট জল ভরে গেছে তখন ৩০ হাজার কিউসেক করে জল ছাড়লেন। আগাম কোনও ঘোষণা ছাড়াই। এই ৩০ হাজারের সাথে সাথে নিচু এলাকার বা লোয়ার ক্যাচমেন্টে আরও ১৫/২০ হাজার কিউসেক জল এসে কংসাবতী নদীতে পড়ছে। তখন কংসাবতীর ৫০ হাজার কিউসেক জল নদী দিয়ে পাশ করাটা খুবই কঠিন এবং পরের দিন কংসাবতী ড্যাম থেকে ৪৫ হাজার কিউসেক করে জল ছাড়তে বাধ্য হয়। কারণ তখনও ড্যামে ৪৩৮ ফিট জল দাঁড়িয়ে আছে। কংসাবতী ড্যামে ৪৩৬ ফিট জল ধারণ করার ক্ষমতা আছে। এবং কংসাবতী নদীতে যদি আপার ক্যাশমেন্ট থেকে ৪৫ হাজার এবং লোয়ার ক্যাশমেন্ট থেকে যদি ২০/২৫ হাজার কিউসেক জল আসে, তখন কোনোভাবেই কংসাবতী নদীকে রক্ষা করা যাবে না। তার ফলশ্রুতিতে কংসাবতী নদীর বাঁধের ডান দিক ও বাম দিক একাধিক জায়গায় বাঁধ ভেঙে পশ্চিম এবং পূর্ব মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায় ধান, ফুল, সবজি, মাছ কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, এর দায় কে নেবে ? এই বিষয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী কি কিছু বলবেন ? এরজন্য কি দায় মাথায় নেবেন মুখ্যমন্ত্রী?
যেদিন ডিভিসি’র জল এবং কংসাবতীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে সেইদিন মুখ্যমন্ত্রী হুগলী জেলার পুরশুড়াতে গেলেন। ওখানে যাওয়ার ফলে ডিএম, এসপি এবং তার অধীনস্ত হাজার হাজার পুলিশ সবাই মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। লাভের চেয়ে বেশি ক্ষতি করলেন। আর্ত মানুষের পাশে থেকে বন্যাকবলিত এলাকা থেকে নিরাপদ স্থানে মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটালেন। ওখান থেকে ঐদিন রাত্রিতে মেদিনীপুর সার্কিট হাউসে রাত্রিযাপন করলেন। প্রশাসনিক ব্যবস্থায় থাকলেন। তার পরের দিন সকালে যখন পূর্ব মেদিনীপুরে এলেন তখন হাজার হাজার মানুষ ন্যাশনাল হাইওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। ৫/৬ শত পুলিশ বন্যা দুর্গতদের উদ্ধারের কাজ বন্ধ রেখে রাস্তার দু’পাশে ৫০০ মিটার করে কাছি দিয়ে ঘিরে রাখলেন। মুখ্যমন্ত্রী গাড়ি থেকে নেমে মাইক নিয়ে ৫/১০ মিনিট বক্তব্য রাখলেন। তাতে বললেন আপনাদের এই বন্যার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার দায়ী। ডিভিসি’র জলে আপনারা প্লাবিত হয়েছেন। সম্পূর্ণ অসত্য কথা পরিবেশন করে গেলেন। কারণ পূর্ব মেদিনীপুরে ডিভিসি’র ১ কিউসেক জলও প্রবেশ করে না। তাই ১৩ বছরের মুখ্যমন্ত্রী তার রাজ্যে কোন ড্যামের জল কোথায় আসে তা ভৌগোলিক মানচিত্রটা তিনি এখনও বুঝে উঠতে পারেন নি৷ সেচ দপ্তরে ভালো ভালো ইঞ্জিনিয়ার এবং অফিসার আছেন। আসলে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী সবজান্তা হয়ে গেলে রাজ্যের মানুষের হাল খারাপ তো হবেই।
বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন বন্যা হয়েছে এবং বন্যা মোকাবিলাও করা হয়েছে। একটা সময় আমি পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতি ছিলাম। তখন আমরা আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বন্যা হতে পারে ভেবেই সেইজন্য জুন মাসে আগাম সমস্ত দপ্তরের আধিকারিকদের নিয়ে সভাধিপতি ও ডিএম প্রস্তুতি সভা হতো। যেমন জেলার সর্বোচ্চ পূর্ত দপ্তরের আধিকারিক, বিদ্যুৎ দপ্তরের আধিকারিক, সেচ দপ্তরের আধিকারিক, পিএইচই দপ্তরের আধিকারিক, কৃষি দপ্তরের আধিকারিক, বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের আধিকারিক এবং পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা আধিকারিকদের নিয়ে প্রাক্ প্রস্তুতি সভা করা হতো। জুলাই মাসের শেষে পুনরায় রিভিউ সভা করে সেই সভায় বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য সমস্ত দপ্তর প্রস্তুত আছে কিনা খোঁজ নেওয়া এবং যদি কোনও ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকে তাহলে তাকে ধরিয়ে দেওয়া। এরপর মহকুমা ও ব্লক পর্যায়ে একইরকম সভা করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হতো। হঠাৎ করে প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে দু’দিনে যদি ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় ডিভিসি, কংসাবতী সুবর্ণরেখায় তাহলে ড্যামে জল ভর্তি হলে তবে ড্যাম কর্তৃপক্ষ জল ছাড়তে বাধ্য হবে। বন্যা মোকাবিলার প্রাক প্রস্তুতি না থাকলে কোনোভাবে বন্যা মোকাবিলা করা যাবে না।
এখন এই সরকারের আমলে এসব উঠে গেছে। তার ফলশ্রুতি হিসাবে মানুষের যে দুর্ভোগ হওয়া উচিত ছিল না, কিন্তু সেই দুর্ভোগ পেতে হলো। মুখ্যমন্ত্রীর উচিত কোন কোন ড্যাম থেকে কোন কোন এলাকায় জল আসে এবং কোন কোন ড্যামের জল কোন কোন নদী দিয়ে প্রবাহিত হয় তা জেনে নেওয়া । তা নাহলে এখানে ডিভিসি’র ১ কিউসেক জল আসেনি সেখানে দাঁড়িয়ে যদি মুখ্যমন্ত্রী ভাষণ দেন ডিভিসি’র জলে আপনাদের সর্বনাশ হয়েছে, ডিভিসি’র সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করে দিলাম। তাতে কোন লাভ হবে না।
Post Editorial
প্রাক প্রস্তুতি নেই,বন্যা মোকাবিলা হবে কি করে
×
Comments :0