Post Editorial

ইউজিসি খসড়া রেগুলেশন ২০২৫ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অশনি সংকেত

উত্তর সম্পাদকীয়​

শ্রুতিনাথ প্রহরাজ

সম্প্রতি জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়েছে ইউজিসি খসড়া রেগুলেশন ২০২৫। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে এটি নিছক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-প্রশাসকদের নিয়োগ ও পদোন্নতি সংক্রান্ত নিয়মাবলী। আসলে এই রেগুলেশন একতরফা কার্যকর করার মধ্য দিয়ে এদেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চায় বিজেপি সরকার। সেই কারণে রাজ্যগুলির সাথে মতবিনিময়ের কোনও সুযোগ দেয়নি তারা, যা সংবিধান বিরোধী পদক্ষেপ। বলা হয়েছে জনসমক্ষে প্রকাশিত এই আদেশনামা আগামী ৩০ দিন মতামত দেওয়ার জন্য খোলা থাকছে। তারপর এটিকে কার্যকর করার পথে এগোবে কেন্দ্রীয় সরকার।

এযাবৎকাল যত রেগুলেশন বেরিয়েছে তা হয়েছে ইউজিসি দপ্তর থেকে। মূলত ইউজিসি’র সচিব এবং চেয়ারম্যান এই দায়িত্ব পালন করতেন। এই প্রথম এধরনের একটি ইউজিসি আদেশনামা প্রকাশিত হলো কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর দ্বারা, সরাসরি শিক্ষা মন্ত্রক থেকে। এর থেকেই পরিষ্কার শিক্ষা পরিচালনায় ঠিক কোন মাত্রায় কেন্দ্রীকরণের পথে হাঁটতে চাইছে আরএসএস পরিচালিত বর্তমান বিজেপি সরকার। যদিও ইউজিসি’র মাথায় এখন সঙ্ঘ পরিবারের একান্ত ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তিকে বসানো হয়েছে, তবু হুমকির বিষয়টাকে সুনির্দিষ্ট করতে, বিশেষ করে সেই সব রাজ্যের ক্ষেত্রে যেখানে বিজেপি বিরোধী সরকার আছে, পরিকল্পনা মাফিক এই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে।

আরএসএস-বিজেপি যেমন বর্তমান সংবিধানকে বদলে মনুবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করতে চায়, একইভাবে সেই লক্ষ্যেই এদেশের বহুচর্চিত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বোঝাপড়াকে নস্যাৎ করে প্রশাসনিক কেন্দ্রিকরণের মাধ্যমে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। সংবিধানে কৃষি, সমবায় ইত্যাদি যেগুলি রাজ্যের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত সেখানে যেমন একতরফা হস্তক্ষেপ করছে, একই সাথে শিল্পশ্রম- শ্রম বিরোধ- ট্রেড ইউনিয়ন, বিদ্যুৎ ক্ষেত্র সহ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাক্ষেত্রের মতো সংবিধানের যুগ্ম তালিকা ভুক্ত বিষয় গুলিকেও একতরফা দখল নিতে চাইছে, রাজ্যগুলির মতামত কে মান্যতা না দিয়ে। ঠিক যেমন কৃষি ও কৃষক স্বার্থ বিরোধী কৃষি আইন, শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী শ্রমকোড চালু করার চেষ্টা করেছে, একইভাবে ২০২০ সালে রাজ্যগুলির মতামতকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে একতরফা নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি চালু করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের পরিপন্থী। হ্যাঁ, এটাই আরএসএস-বিজেপি’র দর্শন যা প্রতিহত করতে না পারলে এই দেশকে বাঁচানো মুশকিল।

সঙ্ঘ পরিবার চায় এদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের একচেটিয়া দখলদারি। এই লক্ষ্য নিয়ে গত দশ বছরে দেশের  ৫৬ টি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটি, আইআইএম সহ কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থাগুলির নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করেছে। সর্বত্র সঙ্ঘ প্রচারক বা সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাই এগুলি পরিচালনা করছেন। এবার লক্ষ্য, সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ৪৮১ টি রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় ও তার অধীনে থাকা কলেজগুলির দখলদারি সুনিশ্চিত করা, যেগুলি মূলত রাজ্য সরকারের শিক্ষা দপ্তরের পরিচালনাধীন। এই সুযোগে তারা কর্পোরেট ও উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের মিশেলে তৈরি করা শিক্ষার স্বার্থ বিরোধী নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি সর্বোত্র সমানভাবে কার্যকর করতে চায়। তাই ইউজিসি রেগুলেশনের ছত্রে ছত্রে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কে অগ্রাধিকার দিয়ে রাজ্যের ক্ষমতাকে সংকুচিত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিজেপি সরকার রাজ্যপাল পদগুলিকে রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার করছে। বিজেপি বিরোধী রাজ্যগুলিতে এ নিয়ে নিরন্তর নানা ইস্যুতে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। সেই রাজ্যপাল যেহেতু পদাধিকার বলে রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য, তাই সেই পদকে কাজে লাগিয়ে সঙ্ঘ পরিবার এই বিপজ্জনক খেলায় নেমেছে।

এই রেগুলেশন বা আদেশনামায় বিজেপি সরকার সরাসরি হুংকার দিয়ে বলেছে, রাজ্যগুলি এটি না মানলে সংশ্লিষ্ট রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় ও তার অধীনে থাকা কলেজগুলি ইউজিসি তালিকা থেকে বাদ পড়বে। আগামী দিনে তাদের যাবতীয় বরাদ্দ বন্ধ হবে শুধু তাই নয়, এই বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলির দেওয়া কোনও ডিগ্রির বৈধতা ইউজিসি দেবে না। শিক্ষা ও গবেষণা খাতে এমনিতেই গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ইউজিসি বরাদ্দ কমেছে। এবার তা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি। গত দশ বছরে ইউজিসি গ্র্যান্ট দেওয়া ও শিক্ষা ও গবেষণার প্রশ্নে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ার জায়গা থেকে ক্রমশ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় চলে এসেছে যা, বিশ্ববিদ্যালয় সহ সামগ্রিক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার রক্ষা করার প্রশ্নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দেওয়া ইউজি বা পিজি ডিগ্রির বৈধতা বাতিল হলে অগণিত ছাত্র-ছাত্রীর ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। এক কথায় সরাসরি পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে রাজ্য সরকারগুলির কপালে বন্দুক ঠেকাতে চাইছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। স্বাধীন ভারতে অতীতে কখনো এ ধরনের হুমকির মুখে পড়তে হয়নি রাজ্য সরকারগুলিকে। শিক্ষাক্ষেত্রে ঢালাও বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের পথ ধরে দেশজুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজগুলিকে নিয়ে এই প্রশ্নে বিজেপি’র বাড়তি মাথাব্যথা নেই কারণ তারা জানে, পুঁজির নিরাপত্তা ও মুনাফার ধারাবাহিকতার রক্ষার স্বার্থে এইসব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি কেন্দ্রীয় সরকার তথা বর্তমানের এই হিন্দুত্ববাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করবে না। ইতিমধ্যেই এরা উপাচার্য বা আচার্য নিয়োগের প্রশ্নে যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করছে। তাই টার্গেট এখন শুধুমাত্র রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় ও তার অধীন কলেজগুলি। এতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা জলাঞ্জলি গেলে যাক!

অতীতে নিয়ম ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনজনের কমিটি হবে যেখানে ইউজিসি’র একজন প্রতিনিধি, রাজ্য সরকার মনোনীত আচার্যের একজন প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট বা কোর্টের একজন প্রতিনিধি থাকবেন। নতুন রেগুলেশনে 'রাজ্য সরকার মনোনীত' কথাটাই তুলে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, আচার্য অর্থাৎ রাজ্যপাল ঠিক করবেন তার প্রতিনিধি কে হবেন, এবং তিনিই হবেন এই সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান। শুধু তাই নয়, এই কমিটির করা তিন বা পাঁচ জনের প্যানেল থেকে একজনকে বেছে নিয়ে উপাচার্য পদে নিযুক্ত করবেন রাজ্যপাল তথা আচার্য। অর্থাৎ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের মতামত দেওয়ার কোনও জায়গাই থাকবে না— এ জিনিস মেনে নেওয়া যায় না।

কে হতে পারবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য? অতীতে মূলত সর্বোচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাই নির্দিষ্ট শর্ত মেনে উপাচার্য পদে নিযুক্ত হতে পারতেন। এর ব্যতিক্রম একদম হয়নি তা নয়। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন সরাসরি শিক্ষা ও গবেষণার কাজে যুক্ত না থেকেও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। প্রখ্যাত রসায়ন বিজ্ঞানী ইয়েলাবর্তি নায়ুদাম্মা জওহরলাল নেহরু ও পরে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু এঁদের পাণ্ডিত্য ও শিক্ষাপ্রশাসক হিসেবে ভূমিকা নিয়ে কখনো প্রশ্ন ওঠেনি। বিজেপি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর আইএএস ও আইপিএস সহ সরকারি প্রশাসনের উচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তিদের উপাচার্য পদে নিয়োগের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। রাজ্যপাল তথা আচার্যের সৌজন্যে পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এধরনের এক ব্যক্তিকে উপাচার্য পদে নিয়োগ করা হয়েছিল, যা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। বর্তমান রেগুলেশনে বিজেপি সরকার আরো এককদম এগিয়ে সরকারি প্রশাসন, শিল্প সংস্থা সহ আরো অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের উপাচার্য পদে নিয়োগ করার কথা বলেছে যা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিমণ্ডলের সঙ্গে আদৌ সাজুজ্যপূর্ণ নয়। আসল লক্ষ্য অন্য। এই পথ ধরে সঙ্ঘ প্রচারক ও সঙ্ঘের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্য পদে নিযুক্ত করতে চায় বিজেপি সরকার, যাতে করে শিক্ষার সামগ্রিক ব্যবস্থায় হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডাকে নির্বিঘ্নে কার্যকর করা সম্ভব হয়।

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নে এই রেগুলেশনে বলা হয়েছে চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আর কোনও বিধি নিষেধ থাকছে না। ২০১৮র রেগুলেশনে ১৩ ধারায় বলা ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোট নিযুক্ত শিক্ষকের দশ শতাংশের বেশি চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ করা যাবে না। বাজার অর্থনীতির শর্ত মেনে শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দ আরো কমানোর লক্ষ্যে স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ কমিয়ে স্বল্প পারিশ্রমিকে চুক্তিভিত্তিক ও অস্থায়ী ভাবে নিযুক্ত শিক্ষকের সংখ্যা বাড়াতে চাইছে বিজেপি সরকার। আগামী দিনে দেশের শিক্ষিত মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা সরকারি ব্যয়ে পরিচালিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে স্থায়ীপদে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বঞ্চিত হবে।

নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির অংশ হিসেবে চার বছরের ডিগ্রি কোর্স হঠাৎ করে কলেজ গুলিতে চালু করার পর লেখাপড়ার কি হাল দাঁড়িয়েছে তা একটু খোঁজ নিলেই জানা যাবে। নিজের দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, অধিকাংশ এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থা হল 'ঢাল নেই তরোয়াল নেই, নিধিরাম সরদার'-এর মতো। ন্যাকের মূল্যায়নের জন্য খানিক সাজানো গোছানো হয় ঠিকই, আদতে বেশিরভাগ ডিগ্রি কলেজের প্রয়োজনীয় শিক্ষা পরিকাঠামো নেই। এই অবস্থায় বহুমুখী বিষয় পছন্দের সুযোগ সহ চার বছরের ডিগ্রি কোর্স চালু করে দেওয়ায় কলেজগুলি পড়েছে মহা ফাঁপরে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিরও প্রায় একই অবস্থা। বস্তুত ছাত্র-ছাত্রীরা জানেনা কি পড়ছে আর কেনইবা পড়ছে। শিক্ষক শিক্ষিকাদের হাল আরও খারাপ। অতীতের অভিজ্ঞতায় বিষয়ভিত্তিক পড়ানোর জন্য একটা প্রস্তুতির অভ্যাস ছিল এঁদের মধ্যে। এখন এঁরা বুঝতেই পারছেন না আগামীকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ঠিক কি পড়াতে হবে বা কিভাবে পড়ালে ভালো হয় ? ফলে প্রস্তুতির সুযোগই পাচ্ছেন না তাঁরা। শুধু নিষ্ঠার সঙ্গে চার মাস অন্তর পরীক্ষা নেওয়া আর খাতা দেখা—  এতেই কেটে যাচ্ছে অনেকটা সময়। ভবিষ্যতের সঞ্চয়ের খাতা শূন্য করে ছেলে মেয়েরা প্রতিটি সেমিস্টারে নম্বরের পর নম্বর জমিয়ে যাচ্ছে। যখন তা বুঝতে পারছে তখন আর পিছু হটার সুযোগ নেই। উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় এই বিপদ বর্তমান প্রজন্মের একটা বড় অংশের ছাত্র-ছাত্রীকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

এই বহুমুখী বিষয় পছন্দের ব্যবস্থাকে আরো কার্যকর করার লক্ষ্যে রেগুলেশনে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত নিয়মগুলিও তৈরি করা হয়োছে। যেমন ৩.২ ও ৩.৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনও একজন ছাত্র বা ছাত্রী যদি এমন কোনও বিষয়ে গবেষণা করে যা তার ইউজি বা পিজি পড়ার সময় ছিল না, সে ওই বিষয়ে শিক্ষকতা করবার উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে। এই সিদ্ধান্তে ছাত্র-ছাত্রীরা কতটা উপকৃত হবে তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে রেগুলেশনের ৩.৮ ধারায় ন’টি 'উল্লেখযোগ্য বিষয়' যোগ করে বলা হয়েছে, এরমধ্যে অন্তত চারটি বিষয়ে যোগ্যতা মান উত্তীর্ণ করতে পারলেই নতুন পদে নিয়োগ বা পদোন্নতির যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। বিষয়গুলির মধ্যে আছে উদ্ভাবনী শিক্ষাদান পদ্ধতিতে ভূমিকা, ভারতীয় ভাষায় ও ভারতীয় জ্ঞানব্যবস্থায় শিক্ষাদানে ভূমিকা, সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা, মেধাসত্ত্ব তৈরি ও নিবন্ধনের প্রশ্নে ভূমিকা, অনলাইন কোর্সের জন্য ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে ভূমিকা ইত্যাদি। আগেই বলেছি, অধিকাংশ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব করবার জন্য যে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো ও অর্থ দরকার, তা নেই। নিয়মমাফিক ক্লাসরুম আছে, হালে কিছু ক্লাসরুমকে আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতিতে ( অডিও-ভিসুয়াল) উন্নত করা সম্ভব হয়েছে। অর্থের অভাবে ল্যাবরেটরিগুলোর সময়োপযোগী উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। কাজ চালানোর মতো করে শিক্ষাদান চলছে। এই অবস্থায় শিক্ষক শিক্ষিকাদের নতুন পদে নিয়োগ ও পদোন্নতির জন্য 'উল্লেখযোগ্য বিষয়' হিসেবে যা চিহ্নিত করা হয়েছে তাকি আদৌ যুক্তিযুক্ত? নাকি এইভাবে পদোন্নতির দায়টুকুও এড়িয়ে যেতে চাইছে সরকার। এতে যদি বিরক্ত হয়ে মেধাবী শিক্ষক গবেষকগণ প্রতিষ্ঠান ছাড়তে চান, ওদের তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। কারণ, পূর্বের নিয়ম বদলে যথেচ্ছ সংখ্যায় অস্থায়ী বা চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে বাড়িতি কোনও পদোন্নতির দায় নেই।

যেহেতু বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে নেই, তাই সব মিলিয়ে এটুকু বলা যায় যে ইউজিসি’র এই খসড়া রেগুলেশন সামগ্রিকভাবে শিক্ষার স্বার্থ বিরোধী এবং দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নস্যাৎ করার লক্ষ্যে তৈরি। ইতিমধ্যে কেরালা সরকারের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি লিখে এই ভয়ংকর রেগুলেশন কার্যকর না করার অনুরোধ জানিয়েছেন। একইভাবে এই রেগুলেশনের তীব্র বিরোধিতা করে চিঠি দিয়েছেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় এমকে স্টালিন। রাজনৈতিক দল হিসেবে সিপিআই (এম) যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষার স্বার্থে এই রেগুলেশনকে প্রতিহত করার আবেদন জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। আরো একাধিক রাজনৈতিক দল তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সংগঠন গুলি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ও রাজ্যে রাজ্যে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। এখন প্রয়োজন হলো, শুধু উচ্চশিক্ষা নয়, সামগ্রিকভাবে শিক্ষার স্বার্থের সাথে যুক্ত সব অংশের মানুষকে একত্রিত করে এই রেগুলেশনকে ফেরত নিতে সরকারকে বাধ্য করা। নিজেদের মধ্যেকার বিরোধ ভুলে শিক্ষা বাঁচাতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রক্ষা করতে সর্বোপরি দেশ রক্ষা করতে এই রেগুলেশন এর বিরোধিতায় পথে নামা জরুরি যাতে ৩০ দিন নয়, এই সরকারের মেয়াদ কালে একে কার্যকর করার সুযোগ না পায়।

Comments :0

Login to leave a comment