এবারের বাজেটে দেশের অর্থনীতির দরজাকে আরও উন্মুক্ত করার, বৃহৎ শিল্পসংস্থাগুলিকে নিয়মবিধি থেকে আরও ছাড় দেওয়ার ও রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়াকে আরও প্রসারিত করার ইঙ্গিত দেওয়া হলো মোদী সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষায়। শুক্রবার সংসদে পেশ করা এই সমীক্ষায় বলা হয়েছে, আগামী আর্থিক বর্ষ অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার থাকবে ৬.৩ থেকে ৬.৮ শতাংশের মধ্যে, যেখানে সরকারের ঘোষণা মতো ২০৪৭ সালের মধ্যে ‘বিকশিত ভারত’-এর লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে এখন এক বা দুই দশক ধরে গড়ে প্রতি বছর ৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি ঘটা দরকার অর্থনীতির। এই অবস্থায় অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা বাড়াতে এবং বৃদ্ধির হারকে টেনে তুলতে ‘তৃণমূল স্তরে বিনিয়ন্ত্রণ ও সংস্কার’ দরকার, প্রয়োজন ব্যক্তি ও সংগঠনের জন্য আরও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। স্বাভাবিকভাবেই এই বিনিয়ন্ত্রণ ও সংস্কারের বার্তাকে দু’হাত তুলে স্বাগত জানিয়েছে কর্পোরেট মহল। শুক্রবার প্রথমে লোকসভায় ও পরে রাজ্যসভায় ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের এই অর্থনৈতিক সমীক্ষা পেশ করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। শনিবার তিনি সংসদে পেশ করবেন ২০২৫-২৬ সালের বাজেট।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, চলতি আর্থিক বছরে (২০২৪-২৫) দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার হতে চলেছে ৬.৪ শতাংশ, যা চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। আগের বছরের (২০২৩-২৪) অর্থনৈতিক সমীক্ষায় এই হার ৬.৫ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে থাকবে বলে অনুমান করা হয়েছিল। স্পষ্টতই ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে অনুমিত বৃদ্ধির হারে পৌঁছানো যাচ্ছে না। স্বভাবতই এবারের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় আগামী অর্থবর্ষ অর্থাৎ ২০২৫-২৬ সালের জন্য যে বৃদ্ধির হারের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে, সেখানেও মোদী সরকার শেষ পর্যন্ত দেশের অর্থনীতিকে নিয়ে যেতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থাকছে। সমীক্ষায় পরস্পরবিরোধিতাও রয়েছে। একদিকে দাবি করা হয়েছে, দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির মৌলিক ভিত্তিগুলি শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে। আরেকদিকে সরকার নিজেই জানিয়েছে, পূর্বাভাসের থেকে বাস্তবের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার কম। অর্থনীতির মৌলিক ভিত্তি শক্তিশালী থাকলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে কেন, সমীক্ষায় তার ব্যাখ্যা নেই। ওদিকে ঘুরিয়ে বলা হয়েছে, বিনিয়োগের হার যথেষ্ট নয়। সমীক্ষায় জানানো হয়েছে, বর্তমানে তা জিডিপি’র ৩১ শতাংশ। এই হারকে অবশ্যই বাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে জিডিপি’র ৩৫ শতাংশে, না হলে ‘বিকশিত ভারত’-এর লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এক বা দুই দশক ধরে গড়ে প্রতি বছরে ৮ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে সুনিশ্চিত করা যাবে না।
আবার সমীক্ষার বেশ কিছু দাবি একেবারেই মিলছে না বাস্তবের সঙ্গে। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশে বেকারত্বের হার কমছে এবং মুদ্রাস্ফীতির হারও স্থিতিশীল রয়েছে। বাস্তবের অভিজ্ঞতা হলো এবং সিএমআইই সহ একাধিক সমীক্ষক সংস্থার রিপোর্টেও বলা হয়েছে, বেকারত্বের হার উর্ধ্বমুখী। বিশেষত, সংগঠিত ক্ষেত্রে ও স্থায়ী আয়ের চাকরির সুযোগ সঙ্কুচিত হওয়ায় জীবনধারনে নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা। পাশাপাশি প্রবল মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন পণ্যের চাহিদায় ভাটা পড়েছে। বিক্রি কমায় বিস্কুট, তেল, সাবান সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য তৈরির সংস্থাগুলিও বেশ কিছু সময় ধরে সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়, তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না বহু মানুষের আয়। ফলে কেনাকাটায় কাটছাঁট, চাহিদায় খরা। অবস্থা দেখে ভারতের শেয়ার বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে বিদেশি লগ্নিকারীরা। পড়ছে সূচক। ওদিকে ডলারের সাপেক্ষে কমতে কমতে প্রায় রোজই নজির গড়ে চলেছে টাকার দাম। তাতে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রতি সপ্তাহেই কমছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়।
চড়া মৃল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ নাজেহাল, অথচ সমীক্ষায় মুদ্রাস্ফীতি স্থিতিশীল বলে দায় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীর দাম কমানোর জন্য সরকারি তরফে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার, সেই বিষয়েই সমীক্ষা নীরব। উলটে সেই মরশুমের উপর ভরসার কথা বলা হয়েছে। সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে, খরিফ শস্য বাজারে আসবে বলে ২০২৪-২৫ অর্থাৎ চলতি আর্থিক বছরের শেষ ত্রৈমাসিকে (জানুয়ারি-মার্চ) খাদ্যসামগ্রীর দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে। সমীক্ষায় শ্রমের মজুরি বাড়ানোর বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) কারণে শ্রমের বাজারে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ভারতের মতো শ্রম-উদ্বৃত্ত দেশের পক্ষে শ্রমিকের জায়গায় এআই’র ব্যবহার মেনে নেওয়া সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলি এআই’র যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু করলে সরকার কিছু বিধিনিষেধ আরোপের দিকে যেতে পারে বলেও সমীক্ষায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। রেল নিয়েও সমীক্ষায় পরিকাঠামো সম্প্রসারণে সরকারি তরফে ঘাটতির কথা স্বীকার করতে হয়েছে। বলা হয়েছে, গত আর্থিক বছরের তুলনায় চলতি আর্থিক বছ রে রেল যোগাযোগের সম্প্রসারণ হয়েছে প্রায় দশ শতাংশ কম। ২০২৩-২৪ সালে যেখানে ২২৮২ কিলোমিটার রেললাইন পাতা হয়েছিল, সেখানে ২০২৪-২৫ সালে তা নেমে এসেছে ২০৩১ কিলোমিটারে। অথচ বেড়েছে ওয়াগন ও ট্রেনের ইঞ্জিন বা লোকোমোটিভের উৎপাদন, বেড়েছে বন্দে ভারত ট্রেনের সংখ্যা। এর অর্থ, রেলের বর্তমান পরিকাঠামোর উপরেই মাত্রাতিরিক্ত চাপ পড়ছে। বহু বিশেষজ্ঞ এই বিষয়টিকে ঘন ঘন রেল দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসাবে চিহ্নিতও করেছেন।
Comments :0