MINORITIES and POLITICS

সংখ্যালঘুরা কি দাবার বোড়ে

উত্তর সম্পাদকীয়​


সেখ সাইদুল হক

সঙ্ঘ পরিবারের আদর্শে লালিত মোদী ও অমিত শাহ-র নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নতুন ভারত গড়ার নামে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, সমতা ও সামাজিক ন্যায় এবং অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি বিষয়ে সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি ধ্বংস করতে চাইছে। দেশের সংবিধান বদলে দিতে প্রচেষ্টা নিয়েছে। সঙ্ঘের নির্দেশ মেনে বিজেপি চাইছে নানা ছলাকলার ও প্রলোভনের মাধ্যমে এবং মেরুকরণের রাজনীতি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে এবং ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে জিতে পুনরায় ক্ষমতায় এসে ২০২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের শতবর্ষে এই দেশকে ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরুষতান্ত্রিক একদলীয় হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্ররূপে ঘোষণা করতে। সেই লক্ষ্য পূরণেই ২০১৪ সালের মোদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পরপরই সঙ্ঘ পরিবারের এজেন্ডা অনুযায়ী শুরু হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর পরিকল্পিত আক্রমণ। আক্রমনের শিকার তফসিল জাতি ও উপজাতি জনগণ। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল করে রাজ্যকে ভেঙে কাশ্মীরি জনগণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন করে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং সেই সাথে দলিত ও উপজাতি জনগোষ্ঠীকে আক্রমণের নিশানা বানানো হয়েছে। এখন নানা শর্ত জুড়ে বিধি বানানো হয়েছে। সন্ত্রাসবাদী তৈরির আখড়া বলে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেবার প্রচেষ্টা নেওয়া শুরু হয়েছে। দিল্লির সাম্প্রদায়িক হিংসার তদন্তের নামে সংখ্যালঘুদের নিশানা করা হয়েছে। বর্তমানে মোদী সরকার শিক্ষায় গৌরিকীকরণের মধ্য দিয়ে দেশের ধর্ম নিরপেক্ষ ইতিহাস চেতনাকে ভাঙতে চাইছে। ইলেক্টোরাল বন্ডের নামে কর্পোরেটদের কাছ থকে মোটা অংকের উপঢৌকন গ্রহণ করে মোদী সরকার কর্পোরেটদের স্বার্থে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে। অপরদিকে দেশপ্রেমের নামে উগ্র জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে চাইছে। অর্থাৎ হিটলারের উত্তরসূরিরা কর্পোরেট তোষণ ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মিশেল তৈরি করে ফ্যাসিবাদী পথে দেশ চালাতে চাইছে।
আমাদের রাজ্য:
আমাদের রাজ্যেও বর্তমান শাসকদল যে বিভেদ বিভাজনের রাজনীতি করছে তাতে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিগুলি উৎসাহিত হচ্ছে এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সংখ্যালঘু উন্নয়নের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতাকেই এই সরকার মদতপুষ্ট করছে। আরএসএস-এর শাখা বাড়ছে। রাজ্যে গত কয়েক বছর বেশ কয়েক জায়গায় সাম্প্রদায়িক হিংসার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। রামনবমীর দিন দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মোদী ও মমতার ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি রাজ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার যে ঐতিহ্য আছে তাকে ভেঙে ফেলতে চাইছে। সংখ্যালঘুদের প্রকৃত উন্নয়ন অপেক্ষা বর্তমান রাজ্য সরকার সংখ্যালঘু যুবকদের একটা অংশকে বিপথে পরিচালিত করে একটি লুম্পেন বাহিনী গড়ে তুলেছে। এরা তোলাবাজি করবে এবং শাসক দলের হয়ে ভোট করবে। রাজ্যের শাসকদলের এই রাজনীতি আখেরে সংখ্যালঘুদেরই ক্ষতি করছে। তাঁদেরকে দাবার বোড়ে বানানো হচ্ছে। তোলাবাজির বখরা নিয়ে মারপিট হচ্ছে।
সংখ্যালঘু প্রশ্নে বাম সরকার :
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও নিরাপত্তা প্রশ্নে বাম জামানার সাফল্যগুলিকে যেমন প্রচারে আনতে হবে তেমনি তৃণমূলী জামানায় সংখ্যালঘুদের বঞ্চনার ও নিরাপত্তার অভাবের কথাও তুলে ধরতে হবে। বাম সরকারের সময়কালে রাজ্যে ১১লক্ষ ২৭ হাজার একরের বেশি খাস জমি ভূমিহীন গরিব কৃষকদের মধ্যে বণ্টিত হয়েছে। প্রাপকদের মধ্যে ১৮ শতাংশ গরিব সংখ্যালঘু । বর্গাদারদের উল্লেখযোগ্য অংশ হলো সংখ্যালঘু। ১৯৭৮ সালে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের জন্য নির্দিষ্ট কোনও সংরক্ষণ না থাকলেও পঞ্চায়েত, পৌরসভার নির্বাচিত প্রতিনিধি ও পদাধিকারীদের ১৫ শতাংশের বেশি ছিল সংখ্যালঘু মানুষ। বাম সরকারের আমলেই ১৯৯৬ সালে রাজ্যে সংখ্যালঘু কমিশন ও ২০০৬ সালে মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুক্ত করে সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তর নামে পৃথক মন্ত্রক তৈরি হয়। বাম আমলেই তৈরি হয় সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগম। সংখ্যালঘু যুবক-যুবতীদের স্বনির্ভর করে তোলার কাজ শুরু হয়। কর্মরত সংখ্যালঘু মহিলা ও ছাত্রীদের জন্য হস্টেল তৈরির কাজ শুরু হয় বামফ্রন্ট সরকারের সময়ই। রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের রিপোর্টকে ভিত্তি করে অনগ্রসরতার নিরিখে চাকরির ক্ষেত্রে বাম সরকার সংখ্যালঘুদের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণ চালু করে। উর্দু অ্যা কাডেমি গঠন করা হয় বাম আমলেই। বাম জামানায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ছিল সুনিশ্চিত, বাম সরকারের দৃঢ় ভূমিকায় ও বাম গণতান্ত্রিক জনগণের প্রহরায়। বাম জামানার উল্লেখযোগ্য সাফল্য হলো মাদ্রাসা শিক্ষার বিস্তার(২৩৮ থেকে ৬০৫টি) এবং মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ ও মাদ্রাসা শিক্ষার ডিগ্রিকে মাধ্যমিকের সমমান দেওয়া। মাদ্রাসা শিক্ষা ছিল সারা দেশের মডেল। মাদ্রাসা শিক্ষাকে দেওয়া হয়েছিল সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা। বাম সরকারের আর একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য হলো আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় গঠন।
তৃণমূল জমানায়:
অপর দিকে তৃণমূল জামানায় গত ১২ বছরে মাদ্রাসা বেড়েছে মাত্র ৯টি।  মাদ্রাসার সংখ্যা হয়েছে ৬১৪টি। এর মধ্যে ২১টি এখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অভাবে পুরোপুরি বন্ধ। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এখন বঞ্চনার শিকার এবং এখন ধ্বংসের মুখে। একে রক্ষা করার আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন আনিস খান। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন ১০,০০০ হাজার আন রেজিস্ট্রার্ড মাদ্রাসাকে অনুমোদন দেবেন। দিয়েছেন মাত্র ২৩৫টিকে। তাও আর্থিক অনুদানবিহীন। সেই মাদ্রাসার শিক্ষকরা, ছাত্র-ছাত্রীরা সরকারের কোনও সাহায্য পান না। শিক্ষক শিক্ষিকারা অনুদানের আন্দোলন করলে পুলিশি জুলুম নেমে আসে। বহু মাদ্রাসা শিক্ষক শিক্ষাকর্মী অভাবে ধুঁকছে। বাম জমানায় স্বচ্ছতার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের জন্য তৈরি হয়েছিল মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন। আর এই সরকার তা তুলে দিতে চেয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা সত্ত্বেও গত দশ বছরে সংখ্যালঘু উন্নয়নে বিশেষ তহবিল তৈরি করা হয়নি। মাদ্রাসা শিক্ষকদের জন্য বিশেষ বেতন কাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী ২০১২ তে বলেছিলেন ৫৯টি মার্কেটিং হাব হবে যেখানে ৫৬ হাজার সংখ্যালঘু মানুষেরা কাজ পাবে। পরে বললেন ১৮৩টি হবে। তাতে সংখ্যালঘু যুবক-যুবতীরা স্টল পাবে। কিন্তু সে কাজ হয়নি। বাম জামানার ১০ শতাংশ সংখ্যালঘু সংরক্ষণের এ ও বি ক্যাটেগরিকে মিশিয়ে দিয়ে কার্যত সংখ্যালঘুদের সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে তৃণমূল সরকার। শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে যে বিপুল পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে তাতে অন্যান্য অংশের মানুষের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। তৃণমূল জামানায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য,কর্মসংস্থানে, পরিকাঠামো উন্নয়নে সংখ্যালঘুরা পিছিয়ে আছে। ঘোষণা সত্ত্বেও সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ হাসপাতাল, নার্সিং কলেজ, ট্রেনিং সেন্টার আজও হয়নি। ফুরফুরা শরীফে রেল লাইন হয়নি। সব ভুয়ো প্রতিশ্রুতি। তৃণমূল জামানায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত। সরকার প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার পথ নেওয়ায় রাজ্যে সঙ্ঘ পরিবার শাখা বাড়িয়েছে। দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কয়েক জায়গায় দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে। দলের সুপ্রিমো সংখ্যালঘু ভোটের জন্য যেমন হিজাব পরে খোদা হাফেজ বলেছেন তেমনি সংখ্যাগুরু অংশকে সন্তুষ্ট রাখতে দীঘায় সরকারি অর্থে জগন্নাথ মন্দির বানাচ্ছেন, দুর্গা পূজা কমিটিকে অর্থ দিচ্ছেন এবং কলকাতায় গঙ্গা আরতি ও দুর্গা কার্নিভালের ব্যবস্থা করেছেন।
এই সরকারের আমলে বাগাড়ম্বর ছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, পরিকাঠামোয় প্রকৃত অর্থে সংখ্যালঘু উন্নয়ন হয়নি। বলা হচ্ছে ইমাম, মোয়াজ্জিমদের ভাতা চালু করেছেন। ওয়াকফ টাকায় এটা দেওয়া হচ্ছে। বাম সরকার ওয়াকফ বোর্ডের আওতায় ১ কোটি টাকার একটি করপাস ফান্ড গড়ে ছিল যা দিয়ে ওয়াকফ মসজিদের ইমাম, মোয়াজিমদের সন্তানদের স্টাইপেন্ড, ফেলোসিপ দেওয়া হতো। তবে এটা মনে রাখতে হবে ইমাম, মোয়াজ্জেম ভাতা কখনও সংখ্যালঘু উন্নয়নের মাপকাঠি হতে পারে না। 
মানুষের ঐক্য গঠন:
দেশ ও রাজ্য এখন প্রকৃত অর্থে বিপদের মধ্যে আছে। গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা আক্রান্ত। আক্রান্ত মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তা। সংখ্যালঘুরা এর বাইরে নন। তাই এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা সুরক্ষিত হবে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের ঐক্য গঠনের মাধ্যমে। ধর্মীয় ঐক্য গঠনের মাধ্যমে নয়। মানুষের ঐক্য মজবুত হবে রুটি রুজির সংগ্রামকে বিস্তৃত ও দৃঢ় করার মাধ্যমে। সংখ্যালঘু জনগণের অংশ হিসাবে আমাদেরকেই সোচ্চারে বলতে হবে মুসলিম জনগণ ভিখারি নন। তাঁরা ভিক্ষা বা অনুকম্পা চান না। তাঁরা চান শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা। সেটা পেতে চান ধর্মনিরপেক্ষতার দৃষ্টিকোণ থেকে, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। দেশ ও রাজ্যে অন্যান্য অংশের শ্রমিক কৃষকের মতো সংখ্যালঘু শ্রমিক কৃষকরা আক্রান্ত। আক্রান্ত পরীযায়ী শ্রমিকেরা। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র ধ্বংস হচ্ছে। নতুন শিল্প নেই। আক্রান্ত হচ্ছেন সব অংশের যুবদের মতো সংখ্যালঘু যুবরা। কাজের দাবি জানাতে গিয়ে শহীদের মৃত্যু বরণ করেছেন মঈদুল ইসলাম। আক্রান্ত নারীরা। হাথরাসের মতো ঘটনা ঘটেছে হাঁসখালিতে। ধান্দা পুঁজি ও চিট ফান্ড পুঁজির জাঁতাকলে অন্যান্য অংশের মানুষের মতো ক্ষতিগ্রস্ত সংখ্যালঘু জনগণ। সীমাহীন দুর্নীতিতে অন্যান্য অংশের মতো সংখ্যালঘু চাকরি প্রার্থীরাও বঞ্চিত। সুতরাং সংখ্যালঘু জনগণের কাছে লড়াইটা সামগ্রিক। সেই লড়াই-এর একটা ধাপ হলো আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে ফ্যাসিবাদী চরিত্রের বিজেপিকে যেমন পরাজিত করা, তেমনি স্বৈরাচারী দুর্নীতিতে নিমজ্জিত তৃণমূলকে উৎখাত করা। ইতিমধ্যেই রাজ্যের মানুষ তোলাবাজি, দুর্নীতি, দখলদারী এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। এতে সংখ্যালঘু জনগণের বড় অংশই সামিল হয়েছেন। মানুষের জোট তৈরি হচ্ছে। সন্দেশখালি, ভাঙড়, ডোমকল সহ বিভিন্ন এলাকায় সে চিত্র ফুটে উঠেছে। ভয়কে জয় করেই পথ চলতে হবে।

Comments :0

Login to leave a comment