দলগতভাবে সংখ্যালঘু এবং জোটগতভাবে ক্ষীণ গরিষ্ঠতা নিয়ে তৃতীয়বারের জন্য সরকার গড়েছেন নরেন্দ্র মোদী। স্বাভাবিকভাবেই জোটগত বোঝাপড়ার বাধ্যবাধকতা এবং শক্তিশালী বিরোধী পক্ষের চ্যালেঞ্জকে সামাল দিয়েই সরকার চালাতে হবে। গত দশ বছর ধরে ঘনিষ্ঠ অনুর সহযোগে আপন মরজিতে যেভাবে সরকার চালিয়েছেন এবং বিরোধীদের মতামতকে হেলায় তুচ্ছ করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন এবার আর তেমনটা সম্ভব হবে না। স্বৈরাচারী কায়দায় অতি কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার লাগাম হাতে নিয়ে যেভাবে মরজিমাফিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং বিরোধীদের জন্য সংরক্ষিত গণতান্ত্রিক পরিসরটিকে যেভাবে কেড়ে নিয়েছেন সেটা এবার অত সহজ হবে না। গণতন্ত্রে বিরোধী পক্ষের ভূমিকা সরকার পক্ষের মতো সমান গুরুত্বপূর্ণ। একে আপ্তবাক্যের মতো বারবার উচ্চারণ করলেও বাস্তবে আঙিনায় প্রতি পদক্ষেপে বিরোধীদের উপর বুলডোজার চালাতেই বেশি তৃপ্তিবোধ করতেন। নিজের ইচ্ছে, মতামত বা অবস্থানে যাতে দলের মধ্য থেকেও কোনও বাধা আসতে না পারে তাই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজের একান্ত ঘনিষ্ঠ অনুগতদেরই বসিয়েছেন। তাই যখন যেমন তার মনে হয়েছে সেটাই করেছেন। দলে ও সরকারে একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসেছেন। নিজের এই অধিষ্ঠানকে স্থায়ী রূপ দিতে নিজেই নিজেকে দেবদূত বানাতে চাইলেন। বলে দিলেন আর পাঁচটা আরএসএস-বিজেপি’র কর্তাব্যক্তিদের মতো তিনি বায়োলজিকাল প্রোডাক্ট নন। স্বয়ং পরমাত্মা তাঁকে দেশ সেবা করার জন্য পাঠিয়েছেন।
তিনি যদি পরমাত্মা প্রেরিত একমাত্র দেবদূত হয়ে থাকেন তাহলে তো তাঁর কথাই প্রথম এবং শেষ কথা। বায়োলজিকাল প্রোডাক্ট হিসাবে দলের অন্য সব অর্বাচীন নেতা-মন্ত্রীরা নিছকই জয়ধ্বনি দেওয়া সংখ্যামাত্র। এহেন প্রধানমন্ত্রী সংসদের প্রথম অধিবেশনে এসে বিরোধীদের সহযোগিতা চেয়েছেন। কেননা শক্তিশালী বিরোধীরা যদি প্রবল বিক্রমে বেগড়বাই শুরু করে, স্বৈরাচারী প্রবণতাকে রুখে দেবার চেষ্টা করে, গণতন্ত্রে বিরোধিতার পরিসরকে প্রশস্ত করতে চায় তাহলে তো মোদী আর মোদী থাকতে পারবেন না। দশ বছর ধরে যে সর্বশক্তিমান একনায়কের ভাবমূর্তি নিষ্ঠার সঙ্গে গড়ে তুলছিলেন সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। মোদী, শাহ, যোগী, রাজনাথ, গড়করিতে বিশেষ আর পার্থক্য থাকবে না। পরমাত্মা প্রেরিত দেবদূত সাজার শখও মাঠে মারা যাবে। তাই ঢোক গিলে একটু গণতন্ত্রী হবার ভান করছেন। বারবার সংবিধানের কথা বলছেন। বিরোধীদের আক্রমণ করছেন গণতন্ত্র বিরোধী তকমা সাঁটিয়ে। সত্যিই ভূতের মুখে রামনাম। মোদী গণতন্ত্রের কথা বললে, সংবিধানকে সম্মান করার কথা বললে হাসির উদ্বেক হওয়াই স্বাভাবিক।
মুখে গণতন্ত্র, সংবিধানের নাম উচ্চারণ করে বিরোধীদের সহযোগিতা চাইলেও তার চরিত্রে কোনও পরিবর্তন হয়নি। যদি সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি তার সম্মানবোধ থাকত তাহলে বরাবরের রীতি মেনে সবচেয়ে বেশিবারের সাংসদকেই প্রোটেম স্পিকার করতেন। তেমনি লোকসভার উপাদক্ষ পদে বিরোধী কাউকে মেনে নিতেন। বরাবর ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে লোকসভার উপাধ্যক্ষ হয়েছেন বিরোধীপক্ষের কেউ। মোদী ক্ষমতায় আসার পর দলীয় সর্বগ্রাসী ক্ষুধার শিকার হয় ওই পদ। ২০১৬ সালে তিনি উপাধ্যক্ষ করেন শাসক জোটের সাংসদকে। ২০১৯ সালে উপাধ্যক্ষ পদে কাউকে বসানোই হয়নি। এবার বিরোধী বলেছিলেন উপাধ্যক্ষ পদ বিরোধীদের ছাড়া হোক এবং অধ্যক্ষ শাসক দলের। কিন্তু মোদী সেটা মানেননি। দু’টি পদেই তিনি নিজের অনুগত কাউকে চান। তা না হলে গণতন্ত্রের টুঁটি টিপে নিজের খুশিমত সংসদ চালাবেন কি করে। ওম বিড়লার মতো নিজের লোক অধ্যক্ষ ছিল বলেই শতাধিক বিরোধী সাংসদকে বহিষ্কার করেছিলেন। চোখ বুজে আলোচনা ছাড়াই ৩৭০ ধারা বাতিল, সিএএ, শ্রম কোড, ফৌজদারি কোড পাশ করেছিলেন। পাশ করেছিলেন কৃষক বিরোধী তিন কালা আইন। তাই বিরোধীরাও সিদ্ধান্ত নিয়েছে গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই জারি থাকবে।
EDITORIAL
গণতন্ত্রের নতুন ভেক
×
Comments :0