ঋদ্ধি রিত
পরিচালক: সুজিত সরকার
অভিনয়: অভিষেক বচ্চন, আহিল্যা বামরো, জয়ন্ত কৃপালনি
ইচ্ছে থাকলে মানুষ সব কিছুই করতে পারে, তার সঙ্গে চাই ধৈর্য ও মানসিক শক্তি। সেইরকমই এক গল্প তুলে ধরে সুজিত সরকারের সিনেমা ‘আই ওয়ান্ট টু টক’। পরিচালক তাঁর সিনেমায় বহুবারই মৃত্যু ও জীবনী শক্তির টানাপোড়েনের গল্প তুলে ধরেছেন। এর আগেও ‘পিকু’, ‘অক্টোবর’-এর মতো সিনেমাতে চরিত্রগুলি বাঁধা হয়েছিল, আশা, মৃত্যু, শোক এবং তা নিয়েই জীবন উদ্যাপনের অঙ্ক মেনে। ‘আই ওয়ান্ট টু টক’-ও সেই রকমই এক গল্প। তবে, এবার গল্প বলার ক্ষেত্রে সুজিত বেশি ফোকাসে আনলেন বিষণ্ণতা ও একাকীত্বকে। এই সিনেমার গল্প আসলে বাবা-মেয়েকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। আর সঙ্গে অনুঘটক হিসাবে থাকে ক্যানসার। পরিচালক নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অর্জুন সেনের জীবনের সত্যি ঘটনা অবলম্বনে এই সিনেমার তৈরি করেছেন। তাই হয়ত, প্রতিটি ফ্রেমই খুবই যত্নের, বলা ভালো অনুভূতিতে ভরা। অর্জুনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অভিষেক বচ্চন।
অর্জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ। ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা অর্জুন বিশ্ব বিপণন জগতে পরিচিত নাম। ধূর্ত সেলসম্যান। তবে সেই ধূর্ততায় সে নিজে অন্যায় কিছু দেখে না। গ্রাহককে ‘ম্যানিপুলেট’ ও ‘কনফিউজড’ করতে সে রপ্ত। স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর অর্জুনের কাছের মানুষ বলতে তার মেয়ে রেয়া। তাও তার সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন সপ্তাহে মাত্র একটা দিন। তাই নিজেকে সারাক্ষণ কাজেই নিমজ্জিত রাখতে চান অর্জুন। এইরকমই একদিন নিজের অফিসে গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং চলাকালীন অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। হাসপাতালে নিয়ে গেলে জানা যায় তার গলায় ক্যানসার হয়েছে। ডাক্তার জানিয়ে দেন হাতে সময় আর মাত্র একশো দিন। চমকে উঠলেও অর্জুন কিন্তু ভেঙে পড়ে না। দ্বিতীয় পরামর্শ নিতে পৌঁছে যান বিখ্যাত ডাক্তার জয়ন্ত দেবের কাছে। ডাক্তার আশ্বস্ত করে পরামর্শ দেন অস্ত্রোপচারের। ইতেমধ্যে অর্জুনের চাকরি চলে যায়। দুরত্ব বাড়ে বন্ধুদের সঙ্গে। প্রথম অস্ত্রোপচারের পর বোঝা যায় আরও অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন, কারণ তার শরীরে একাধিক স্থানে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ক্যানসার। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে অর্জুন। একবার আত্মহত্যার কথাও ভাবে সে।
একের পর এক অস্ত্রোপচারের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েও বড় হয়ে ওঠে। ছোট বেলায় থাকা বাবা-মেয়ের দুরত্বও কমতে থাকে সময়ের সঙ্গে। যদিও অর্জুনের জীবন হয়ে ওঠে হাসপাতাল আর বাড়ি। তার শরীরে কুড়িটারও বেশি অস্ত্রোপচার হয়।
কবিতার মতো এই সিনেমার শুরু থেকে, একের পর এক দৃশ্যপটে ফুটে ওঠে নিস্তব্ধতা। সংলাপের পরিমাণ কম কিন্তু সংলাপের ধার কম নয়। তাই, কম কথা এবং বেশিটা যাপনের সিনেমা হয়ে উঠেছে ‘আই ওয়ান্ট টু টক’। সিনেমা জুড়ে বিভিন্ন সময় অভিনেতাদের গভীর অভিব্যক্তি অসাধারণ আবেগঘন মুহূর্ত তৈরি করায় দর্শকের বেরিয়ে আসা কঠিন। বেশ কিছু দৃশ্য, যেমন ক্যানসার ধরা পড়ার পর চিকিৎসক ও অর্জুনের প্রথম দেখা, মাঝরাতে বাড়ি ফিরে সিঁড়িতে বাবা ও মেয়ের কথোপকথন, অস্ত্রোপচারের পর হাসপাতালে অর্জুন ও রেয়ার অভিব্যক্তি বা ম্যারাথনে বিধ্বস্ত অর্জুনকে পিছন থেকে ঠেলতে ঠেলতে রেয়ার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো অনেক দৃশ্য দর্শক বহুদিন মনে রাখবেন। সিনেমা জুড়ে মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার ওঠাপড়াকেই গুরুত্ব দিয়েছেন পরিচালক। টানাপোড়েন, একাকীত্ব বোঝাতেই হয়তো এই সিনেমাতে আবহসঙ্গীত প্রায় নেই, বরং বাস্তব শব্দকেই ব্যাকগ্রাউন্ড হিসাবে ধরেছেন পরিচালক। যার মধ্যে সবচেয়ে দাগ কাটে শহরের ক্যাকাফোনি। তবে, দৃশ্যের প্রয়োজনে মার্জিত সঙ্গীতের ব্যবহার বেশ ভালো। সিনেমার চিত্রগ্রহণেও নিয়ন্ত্রণ দক্ষতার ছাপ স্পষ্ট।
পরিচালকের অন্য সিনেমার মতোই এখানেও অভিনেতারা ছক ভেঙে চরিত্র নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। বিশেষত এই সিনেমাতে ডাক্তার জয়ন্ত দেবের ভূমিকায় জয়ন্ত কৃপালনি এবং রেয়ার চরিত্রে আহিল্যা বামরোর সাবলীল অভিনয় আগামী অভিনেতাদের কাছে শিক্ষণীয় হতে পারে। উপযুক্ত সঙ্গত দিয়েছেন বহুদিন বাদে অন্য ধরনের চরিত্রে হাজির হওয়া জনি লিভারও। অন্য অভিনেতারাও নিজেদের ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবু ‘আই ওয়ান্ট টু টক’ সিনেমাটি একেবারেই যেন অভিষেক বচ্চনের সিনেমা। সিনেমার প্রতিটি মুহূর্তকে যেন একান্ত নিজের করে ফেলেছেন তিনি। অভিষেক আরও একবার প্রমাণ করলেন তাঁর অভিনয়ের ধার কতটা। তাঁর অভিনয়ে মণিরত্নমের ‘গুরু’ কিংবা ‘যুবা’ সিনেমার সেই আক্রোশ ছিল এই সিনেমাতেও। তবে সেই আক্রোশ অনেকটাই নরমপাকের। বলা ভালো, চিত্রনাট্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিটি দৃশ্যকেই একেবারে নিজের করে নিয়েছিন তিনি। ছুটির দিনে ডাক্তারের কাছে ছুটে যাওয়া বা ছোট্ট রেয়ার কাছে পাওয়া ধাক্কা কাটিয়ে বেরিয়ে আসার অভিব্যক্তির প্রকাশ, চোখ ফেরানো যায়নি এক মুহূর্তেও। তাই হয়ত, ‘গুরু’ বা ‘যুবা’র মতো ছবির অভিনয়ের কথা মাথায় রেখেও অক্লেশেই বলা যায় ‘আই ওয়ান্ট টু টক’ ছবিতে অভিষেক বচ্চনের অভিনয়, তাঁর জীবনের মাইলফলক হয়ে থাকবে।
সত্যি বলতে, কিছু সিনেমা থাকে যা শুধুই বিনোদনের। আবার কিছু সিনেমা থাকে যেগুলো দর্শকদের সিনেমার মধ্যেকার জীবনটাকে বেঁচে নিতে বাধ্য করে। ‘আই ওয়ান্ট টু টক’ দ্বিতীয় ভাগের উদাহরণ হয়ে থাকবে। এই সিনেমা দর্শককে টেনে সিনেমার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়, যার ফলে দর্শক নিজের জীবনকে মিশিয়ে ফেলতে বাধ্য সিনেমাটার সঙ্গে। তার থেকে বাইরে বেরনোর উপায় নেই। এখানেই পরিচালকের সার্থকতা।
শেষে বলা যায়, ‘আই ওয়ান্ট টু টক’ বিষাদ ভরা হলেও, আশা, আকাঙ্ক্ষা আর ওবশ্যই মনের জোরের উপর ভর করেই এগিয়ে যাওয়ার কথা বলে। অনেকটা ঠিক ওই ছোটগল্পের মতো, যা শেষ হয়েও— শেষ হয় না।
Comments :0