TMC MAFIA NEXUS

বন্দুক,বহুতল,বেলেঘাটা,
দুর্নীতি-দুষ্কৃতী জোটের নমুনা রাজু

কলকাতা

tmc mafia crime politics bengali news

রবিবার ওড়িশার গোপালপুরে কলকাতা পুলিশের গুন্ডা দমন শাখা গ্রেপ্তার করেছে বেলেঘাটা অঞ্চলের দাপুটে তৃণমূল নেতা রাজু নস্কর। অভিযোগ, ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অলকানন্দা দাসের অনুগামীদের লক্ষ্য করে ৩০ এপ্রিল গুলি চালিয়েছেন তিনি। সেই ঘটনার পর থেকেই রাজুর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে মরিয়া তৃণমূল। যদিও এলাকার সাধারণ মানুষ জানাচ্ছেন, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের মদতেই ২০১১ সাল থেকে বেলেঘাটার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বেনিয়মের রাজত্ব কায়েম করেছিল রাজু। 

৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের অভিযোগ, কালীতারা বোস লেন, বারোয়ারি তলা, রাসমণি বাজার প্রভৃতি অঞ্চলে বস্তি উচ্ছেদ করে বহুতল বানিয়েছে রাজু। কলকাতা কর্পোরেশনের আইন বলছে, ১৯৮০ সালের পরে কলকাতা শহরে কোনও বাড়ি তৈরি করলে তার চারপাশে জায়গা ছাড়তে হয়। জায়গা না ছাড়লে নকশার অনুমোদন মেলে না। 


কিন্তু বেলেঘাটার এই অঞ্চলে ঘুরলেই নজরে পড়ে, একদম রাস্তার গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা একের পর এক নতুন বহুতল। কর্পোরেশনের আধিকারিকদের একাংশ জানাচ্ছেন, রাস্তার একদম গা ঘেঁষে বহুতল গড়ে ওঠায়, বাড়িগুলির কার্পেট এরিয়া বেড়ে গিয়েছে। শাসক দলের প্রভাব কাজে লাগিয়ে মুনাফাও বেড়েছে রাজুর। অভিযোগ, সেই বাড়তি মুনাফার একটা অংশ গিয়েছে তৃণমূলের ভান্ডারে। 
আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তৈরি হওয়া এই বাড়িগুলির ফলে একদিকে কর্পোরেশনের রাজস্ব মার খেয়েছে। অপরদিকে এলাকায় তৈরি হয়েছে জলের সঙ্কট। 

বছর দশেক আগে, ৩৩ ৩৪ এবং ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের জল কষ্ট দূর করতে বেলেঘাটা খালপাড়ে একটি বুস্টার পাম্পিং স্টেশন তৈরির উদ্যোগ নেন তৎকালীন সিপিআই(এম) কাউন্সিলর রাজীব বিশ্বাস। ওই পাম্পের মাধ্যমে ২৫ বছরের জন্য  বেলেঘাটার জল কষ্ট দূর করার পরিকল্পনা  করা হয়। কিন্তু বেআইনি নির্মাণের ফলে সেই পরিকল্পনা  অকেজো হয়ে গিয়েছে। তার কারণ, প্রতিটি বেআইনি নির্মাণ থেকেই পাম্পের মাধ্যমে কর্পোরেশনের জলের লাইন থেকে জল চুরি করা  হচ্ছে। তার ফলে সাধারণ মানুষ জল পাচ্ছেন না।  তাঁদের ভরসা জলের গাড়ি। অবস্থা সামাল দিতে কর্পোরেশনকে শোপান মাঠে শিশুদের উদ্যান নষ্ট করে আরেকটি বুস্টার পাম্পিং স্টেশন তৈরি করার কথা ভাবতে হচ্ছে।


এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ,   বেআইনি নির্মাণকে আইনি বৈধতা দিতে আজমের গ্রুপ বলে একটি নির্মাণ সংস্থা খুলে বসেছেন রাজু নস্কর। আলোছায়া সিনেমা হল ভেঙে গড়ে উঠেছে আজমের টাওয়ার। ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে নিয়ম ভেঙে  তৈরি হয়েছে ক্যারেজ ওয়ে। ২০১২ সালে এই বহুতলের দুটি তলাকে বেআইনি ঘোষণা করে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। অভিযোগ, তৎকালীন মেয়র শোভন চ্যাটার্জির হস্তক্ষেপে বাড়ি ভাঙার থেকে রেহাই পান রাজু। এবং বেআইনি নির্মাণ রেগুলারাইজ করার টাকা কর্পোরেশনের জমা পড়েছে কিনা, সে নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। বর্তমানে এই বহুতলটি আবাসনের পাশাপাশি বাণিজ্যিক কাজের জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে। 

আলোছায়া সিনেমার উল্টোদিকেই রয়েছে রাজু নস্করের বিলাসবহুল রেস্তোরা। 'দ্যা কিচেন'। ২০২১ সালের অক্টোবরে  উদ্বোধন হয় এই রেস্তোরার। অভিযোগ এই বাড়িটিও বেআইনিভাবে বস্তি উচ্ছেদ করে  নির্মিত। নির্মাণকাজ চলার সময়  বেলেঘাটা কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক পরেশ পাল ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অলকানন্দা দাসের কাট আউট দিয়ে গোটা বাড়িটি মুড়ে রাখা হয়েছিল। অভিযোগ,অগ্নি-নির্বাপন ব্যবস্থা ছাড়াই এই রেস্তোরা চলছে। 


এলাকার সাধারণ মানুষ জানাচ্ছেন, বেলেঘাটা মেইন রোডের উপর তৈরি বেলেঘাটা ক্লাব সমন্বয় সমিতির অফিস থেকেই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন রাজু। এই অফিসটিও ফুটপাথ দখক করে অবৈধভাবে নির্মিত। ৩০ এপ্রিল গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে রাজুর বিরুদ্ধে। গুলিবিদ্ধ হন পিন্টু দাস নামে এক ব্যক্তি।  রবিবারের গন্ডগোলের পর থেকেই ক্লাব সমন্বয় সমিতির অফিসে তালা ঝুলছে। এই অফিসের ঢিল ছোড়া দূরত্বে রয়েছে রাজুর ব্যক্তিগত অফিস। পুলিশের দাবি, তল্লাশি চালিয়ে সেই অফিস থেকে  একটি বন্দুক  এবং কার্তুজ মেলেছে। 

সিআইটি রোড এবং বেলেঘাটা মেইন রোডের উপর প্রায় সমস্ত বাসস্ট্যান্ড মমতা ব্যানার্জি এবং পরেশ পালের হোর্ডিং দিয়ে সাজানো। হোর্ডিংয়ের তলায় লেখা, ‘সৌজন্যে রাজু নস্কর’। আইন অনুযায়ী, এই জাতীয় কোনও বিজ্ঞাপন দিতে গেলে কর্পোরেশনকে ট্যাক্স জমা দিতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই এখানে সেরকম কিছু হয়নি। যদিও রাজু গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই, তার নাম কালো কালি দিয়ে ঢাকার তৎপরতা শুরু হয়েছে। 
বাসস্ট্যান্ডের পাশাপাশি, নিজের হোটেলের সামনের ফুটপাতের একাংশ দখল করে গান্ধীজী সহ মনীষীদের মূর্তি বসিয়েছেন রাজু। মাসখানেক আগেও প্রতিটি মূর্তির তলায় লেখা ছিল পরেশ পাল এবং অলকানন্দা দাসের নাম। সংবাদমাধ্যমে শোরগোল পড়ায় তৃণমূল নেতাদের নাম কেটে সেখানে মনীষীদের নামই লেখা হয়েছে। 


বেলেঘাটার তৃণমূলের একটা অংশ জানাচ্ছে, কাউন্সিলর এবং বিধায়ককে দিয়ে মনীষীদের মূর্তি উদ্বোধন করিয়ে সমাজসেবী সাজার চেষ্টা করেছিল রাজু। এর পাশাপাশি, তৃণমূলের প্রশ্রয়ে এলাকায় রবিনহুড ইমেজ তৈরির চেষ্টাও চালাচ্ছিলেন রাজু নস্কর। 

তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণ অনুযায়ী, কিছুদিন আগে অবধিও রাজু নস্করের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল পরেশ পাল এবং অলকানন্দা দাস উভয়ের। সমস্যা তৈরি হয় অলকানন্দা দাসের বাবা অলোক দাস আসরে নামায়। তিনি চেষ্টা করছেন পরেশ পালকে সরিয়ে বেলেঘাটা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী হওয়ার। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রাজু নস্করকে সরিয়ে ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের নির্মাণের পুরো রাশ নিজের হাতে নিতে চাইছেন অলকানন্দা দাস। সেই থেকেই সংঘাতের সূত্রপাত।

তৃণমূলের এই অংশটি জানাচ্ছে, রাজু নস্কর মাসিক ৬-৭ হাজার টাকা বেতনে দেড়শ দুশো বেকার যুবকের একটি বাহিনী পোষে। এই বাহিনী গত ১০-১২ বছর ধরে প্রতিটি নির্বাচনে ভোট লুঠ করেছে।  অলকানন্দা দাস আসরে নামায় এই বাহিনীতে ভাঙন ধরেছে। তার ফলেই এলাকা দখলে মরিয়া হয়ে ওঠে রাজু নস্কর। নিজের বিধায়ক পথ ধরে রাখতে মরিয়া, পরেশ পালও তাকে সাহায্য করছেন।

Comments :0

Login to leave a comment