অনিন্দিতা দত্ত: শিলিগুড়ি
কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দেশ ও রাজ্য। সরকার সব জমি সম্পদ কেড়ে নিয়ে বেসরকারির হাতে দিয়ে মানিটাইজেশন করতে চাইছে। মোদী সরকারের ওয়াকফ আইন সংশোধনীর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করা হয়েছে সিপিআই(এম)’র তরফে। আজ শুনানি ছিল। আমাদের ভরসা আছে। শিলিগুড়িতে হিলকার্ট রোডে অনিল বিশ্বাস ভবনে বৃহস্পতিবার দুপুরে সাংবাদিক বৈঠকে একথা বলেছেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। সাংবাদিক বৈঠকে ছিলেন নবনির্বাচিত সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সমন পাঠক ও সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সদস্য গৌতম ঘোষ।
সেলিম বলেছেন, যেভাবে ওয়াকফ আইনকে সংশোধন ও বাতিল করা হয়েছে তা ওয়াকফের বিপুল সম্পত্তিকে হস্তগত ও রিয়াল এস্টেটকে তুলে দেওয়ার জন্যই। যেটা আইনত সংবিধানগতভাবে সম্ভব নয়। সেটা সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্যের মধ্যে বেরিয়েছে। আমরা নিজেরা সিপিআই(এম)’র তরফ থেকে রিট পিটিশন দাখিল করেছি এবং অসংখ্য পিটিশন দাখিল হয়েছে। আইন কি হবে না হবে সেটা ঠিক করার কথা পার্লামেন্টের। কিন্তু পার্লামেন্টে এমন সব লোকজন গেছে যারা কর্পোরেটদের স্বার্থ দেখতেই ব্যস্ত। একটা বড় অংশের জমিকে কিভাবে হস্তগত করা যায় সেজন্য বাঁধের জমি, জঙ্গল, চা বাগানের জমি, ডিফেন্স, ইরিগেশন, রেল সহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের জমি, এমনকি কলোনির জমি যেখানে দীর্ঘদিন ধরে আদিবাসী, তপশীলি উদ্বাস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করছেন সেই জমিগুলি এবং ওয়াকফের জমি এখন কেড়ে নিতে চাইছে। যখন আমাদের দেশে আইন তৈরী হয়নি পার্লামেন্ট নেই ঠিক সেই সময় নিজেদের সম্পত্তি ভালো কাজের জন্য বিধবা, অনাথ, গরীবদের জন্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে ওয়াকফ করা হয়েছিলো। ওয়াকফ মানে নিবেদিত। যে জমি নিবেদিত আছে বিশেষ কাজের জন্য। সরকার আইন সংশোধন এমনভাবে করলো ওয়াকফের জমি অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে। সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি ধর্মের মানুষ তার ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী যেমন ধর্মাচরন করতে পারেন, সেইরকম নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে পরিচালনাও করতে পারেন।
রাজ্য সম্পাদক আরো বলেছেন, ধর্মের সঙ্গে সরকারের, রাষ্ট্রের ও রাজনীতির যাতে কোন যোগাযোগ না হয়। সরকারের কাজ রেল, বিমান, পোষ্ট অফিস, ব্যাঙ্ক চালানো, ব্রিজ তৈরী, ইরিগেশন করা, সেচ বাঁধ গড়া, কলকারখানা গড়ে তোলা। নির্বাচনের সময় চা শিল্পকে বাঁচাও, পরিবহন শিল্পকে বাঁচাও বলেছিলো। ভোটের সময় কি ওরা বলেছিলো ওয়াকফের সম্পত্তি নিয়ে নেব। নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি ছিলো আপনাদের দেব। এখন নিয়ে নিচ্ছে। যে সরকার একের পর এক ব্যাঙ্ক, পোষ্ট অফিস, এয়ারপোর্ট, এয়ারলাইন্স বেঁচে দিচ্ছে। সেই সরকার বলছে নাকি ওয়াকফ চালাবে। এতেই সরকারের অসৎ উদ্দেশ্য পরিষ্কার। নিজস্ব কাজ না করে সরকার অন্য কাজে মন দিতে চাইছে। এটা কোন মুসলমান হিন্দুর বিষয় নয়। এইরকম বৃহত্তর সম্পত্তি হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ সম্প্রদায়েরও আছে। চার্চের অধীনেও কোথাও স্কুল চলছে, কোথাও বা অন্যান্য জমি আছে।
মুখে অভিন্নতার কথা বললেও, আইনে বিভিন্নতা কেন আনতে চাইছে মোদী সরকার? এই প্রশ্ন তুলে মহম্মদ সেলিম বলেন, এগুলো আসলে সিএএ, এনআরসি এবং অন্যান্য আইন যেভাবে করেছে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র তৈরী করতে চাইছে আরএসএস। যেখানে সংখ্যালঘুদের অধিকার থাকবে না। সংবিধান প্রদত্ত অধিকারও থাকবে না। ধীরে ধীরে সেদিকেই হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা চলছে। আমরা আশা রাখছি এই আইন খারিজ করবে সুপ্রিম কোর্ট। ওয়াকফের সম্পত্তি যেভাবে ম্যানেজমেন্ট হয় ঠিক সেভাবেই হবে। ওয়াকফ বোর্ড বা ওয়াকফ কাউন্সিলের দুর্নীতি আছে। ভুলও আছে। সেগুলি শুধরে নিতে হবে। ১৯৯৫সালের ওয়াকফ আইন অনুযায়ী ওয়াকফ কাউন্সিলের মারফৎ ওয়াকফ বোর্ডগুলিকে ঠিক করতে পারে সরকারের সেই অধিকার আছে। সেই কাজ করছে না। তৃণমূল আসার পরে রাজ্যের তৃণমূল এমপি, এমএলএ, কাউন্সিলার, পঞ্চায়েত প্রধান, পৌর প্রধান সহ তৃণমূলী নেতারা একের পর এক ওয়াকফ সম্পত্তির লুট করেছে বিভিন্ন জেলায়। শ’য়ে শ’য়ে সম্পত্তি নাম বদলে নিয়ে দখল করছে। তা নিয়ে বিজেপি’র সংসদে কোন কথা নেই। ওয়াকফ আইনের সংশোধনীর নাম করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উসকানি দিচ্ছে। আসলে লুট তৃণমূল বিজেপি মিলেই করছে। আর লুটকে চালিয়ে যেতে হিন্দু মুসলমানের নামে মানুষকে ভাগ করে দিতে চাইছে। ধর্ম উৎসব আনন্দের। কিন্তু সেই ধর্মকে টেনে হিঁচড়ে রাস্তায় এনে রাজনীতিতে শক্তি বৃদ্ধির অস্ত্র হিসেবে প্রদর্শন করতে চাইছে দুই দল। সম্প্রতি ও শান্তির পরিবেশকে নষ্ট করে ধর্মকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার ফলে হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণা ছড়াচ্ছে। যা মুর্শিদাবাদে হয়েছে। মালদাতে করার চেষ্টা করছে। মুর্শিদাবাদে অনেক গল্প আছে যেখানে হিন্দু ও মুসলমান একে অপরকে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু সেগুলো সংবাদে আসেনি। ক্রমাগত বাংলাকে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, গুজরাট তৈরী করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সেলিম বলেন, মুর্শিদাবাদে যদি দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরী করে, দাঙ্গা করিয়ে বিজেপি তৃণমূল অধীর এবং সেলিমকে হারায়, তাহলে আবার ’২৬ ভোট আসলে দাঙ্গার ওই পরিস্থিতি আরো বাড়বে। ঘুষ দিয়ে চুরি করার টাকা দিয়ে কর্পোরেট ফান্ড থেকে ইলেট্রোরাল বন্ড দিয়ে ভোট হয়, তাহলে ভোট পরবর্তী সময়ে সেই ঘুষ দুর্নীতি আরো বাড়বে। ধর্মকে ব্যবহার করে, ভয় ও সন্ত্রাসকে কাজে লাগিয়ে ভোট হলে, ভোটের পরে তাহলে ধর্মের রাজনীতি, ভয় ও সন্ত্রাস বৃদ্ধি পাবে। রাজ্যের বেকার ছেলেমেয়েরা কাজ পাচ্ছে না, কৃষকের ফসলের দাম নেই। উৎপাদিত ফসল রাখার জন্য কোল্ডস্টোরেজ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। পরিবহনের উপায় নেই। রাস্তা, সেতু কিছুই নেই। ১০০দিনের কাজ ২০০দিন করার কথা, ৩৬৫দিন করার কথা থাকলেও, বিজেপি আর তৃণমূলের তরজায় কাটমানির ভাগাভাগিতে বিগত তিনবছর ধরে রাজ্যে ১০০দিনের কাজ বন্ধ। ঘরের টাকা নিয়েও কেন্দ্র রাজ্য একে অপরকে দোষারোপ করছে। কিন্তু কোন তদন্ত নেই। চুরি করেও চোরেদের কোন শাস্তি হচ্ছে না। আরজি করের তদন্ত, সারদা, নারদাকান্ড, গরু, কয়লা, বালিপাচার, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি কোনটাতেই তদন্ত প্রক্রিয়া এগোচ্ছে না। দুর্নীতিগ্রস্তরা নিজেদের বাঁচাতে বেশী করে হিন্দু মুসলমান জিগির তুলছে। আর শুভেন্দু এখন সবচাইতে বেশী করে হিন্দু হিন্দু করছে। বাঁকুড়া, পূর্ব পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রামে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতিতে প্রাইমারি, আপার প্রাইমারি, মাদ্রাসা, স্কুলে তৃণমূলে থেকে সেই সময় সবথেকে বেশী দুর্নীতি করেছে। এখন বিজেপি’তে গিয়ে বড় বড় কথা বলছে। বেশী দিন নেই মানুষ ঝাঁটা হাতে অপদার্থ, সাম্প্রদায়িক দুর্নীতিবাজদের বিদায় করবে রাজ্য ও দেশ থেকে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, যারা চাকরি পেয়েছেন তাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। একমাত্র পুলিশ ও শিক্ষকতায় কিছুটা স্থায়ী চাকরি আছে। ব্যাঙ্ক, পোষ্ট অফিসে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের অন্যান্য যে কোন দপ্তরে এই সময়ে চেয়ারে কোন লোক নেই। বিএলআরও দপ্তরেও কর্মীর অভাবে কাজ হচ্ছে না। নিয়োগ হচ্ছেনা। যাদের নিয়োগ হলো তাদেরও সুষ্ঠভাবে নিয়োগ করা হলোনা। টাকা খেয়ে চুরি জোচ্চুরি করে দুর্নীতি করে নিয়োগ হয়েছে। রাজ্য সরকারের চুরি দুর্নীতির কারণেই এতো শিক্ষকের চাকরি গেলো। তৃণমূল সরকার যোগ্য অযোগ্যদের তালিকা দিতে পারছে না। চাকরিহারাদের মধ্যে যারা যোগ্য তাদের পুনর্বহালের দাবি আমরা প্রথম থেকে জানিয়েছি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যোগ্যদের কথা বলতে দিতে চাইছে না তৃণমূল সরকার। তাই তো প্রথমদিন থেকে শিক্ষক যারা রাস্তার আন্দোলনে ছিলেন পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে তাদের লাঠিপেটা করা হয়েছে। নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। যারা চুরি করলো তারাই প্রশাসন চালাচ্ছে।
সেলিম আরও বলেন, এমন অনেকেই আছেন যারা যোগ্য থাকা সত্ত্বেও চাকরি পাননি। চাকরি বিক্রি করা হয়েছে তাইজন্য যোগ্য অনেকেই বঞ্চিত হয়েছে। তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। যোগ্য চাকরিহারাদের প্রতি আবেদন জানান, হতাশ হলে চলবে না। লড়াই চালিয়ে যতে হবে। বিকাশ ভবন অভিযান আছে। শিক্ষকদের আন্দোলনে ছাত্র যুবরা যুক্ত হয়েছে। আমরা কেউ চাইনা কারো চাকরি চলে যাক। আমরা চাই সুষ্ঠু নিয়োগ হোক। তা নাহলে সরকার পোষিত স্কুলগুলি সেগুলি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। তৃণমূল বিজেপি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বন্ধ করে দিতে চাইছে। বেসরকারি কোম্পানিগুলির হাত ধরে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ছড়িয়ে দিতে উৎসাহ যোগাচ্ছে। যেখাবে ব্যবসা হবে। মূল লড়াই এখানেই। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অস্বস্তি বেড়েছে সরকারের। সিবিআই বা কেন্দ্রীয় সরকার পূর্নাঙ্গ তদন্ত করছে না। কারণ তদন্ত পূর্নাঙ্গ হলে পিসি-ভাইপো জেলে যাবে।
আগামী ২০ এপ্রিল ব্রিগেড সমাবেশকে সর্বাত্মক সফল করার আহ্বান জানিয়ে রাজ্য সম্পাদক বলেছেন, ব্রিগেড নিয়ে গ্রাম থেকে শহর, চা বাগান থেকে কলোনি পর্যন্ত প্রস্ততি শুরু হয়ে গেছে। সমস্ত গণসংগঠনের উদ্যোগে প্রচার চলছে। মালদায় হাজার হাজার মানুষের পায়ে পায়ে মানিকচকে পদযাত্রা হয়েছে। হিন্দু ও মুসলমান একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাইছে না। উভয় সম্প্রদায় নিজেদের ঘরের বেকার ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থানের প্রশ্নে লড়ছে। স্কুল বাঁচানো, স্বাস্থ্য পরিষেবা সহ সরকারী পরিষেবা নিয়ে চিন্তিত।
Comments :0