BOOK — SAYANTANI BHATTACHARJEE — KHALED CHOWDHARY — MUKTADHARA — 29 JULY 2025, 3rd YEAR

বই — শান্তিরাম পাঠক — অতীতের হাওড়াকে জানতে হলে — মুক্তধারা — ২২ জুলাই ২০২৫, বর্ষ ৩

সাহিত্যের পাতা

BOOK  SAYANTANI BHATTACHARJEE  KHALED CHOWDHARY  MUKTADHARA  29 JULY 2025 3rd YEAR

বই

মলাট যখন কথা বলে
সায়ন্তনী ভট্টাচার্য
 


পরিতোষ সেন তাঁর ‘আবু সিম্বাল, পিকাশো ও অন্যান্য তীর্থ’ বইতে বলছেন ‘‘আমাদের জীবনে এমন কিছু অনুভব হয়ে থাকে, যা নিতান্তই একক বলে আমরা চিহ্নিত করতে পারি। এবং তা করুণ, হাস্য শৃঙ্গার, অদ্ভুত, শান্ত কিংবা ভয়ানক ইত্যাদি রসসিক্ত হতে পারে। কিন্তু যেহেতু এ অনুভব নেহাতই একক, সেহেতু আর পাঁচজনকে তার অংশীদার করার একটা স্বাভাবিক তাগিদ আমরা উপলব্ধি করি।’’ ‘দেখা’র কাজই এই, ‘দেখা’ সমগ্রতায় ধরা দিতে চায়, অনেক হয়ে ধরা দিতে চায়। প্রদীপ দত্ত বলছেন, ‘‘যদি ছাপা হয়ে থাকে এইসব অমূল্য সম্পদ, তাহলে আগামী  দিনে একজনেরও যদি কাজে লাগে। যদি কোনও এক বোকাহাঁদা ছেলেমেয়ে কোনদিন খালেদ চৌধুরী নামক এক শিল্পীর কাজ নিয়ে জানতে চায়, তাহলে তার তো কাজে লাগবে। যে অন্তত ভাববে না ‘কী লাভ এই সব করে।’ ( যেটা খালেদদা প্রায়শই আমাকে বলতেন)...।’’
মলাটের নকশা কথা বলতে চায়। এখন এই কথা বলা শিল্পীর ফুটে ওঠা। শিল্পী তো প্রতি মুহূর্তে ‘Metamorphosis’ ঘটান, নিজস্বতার রূপান্তর খানিক। কাফকা বলছেন, ‘‘I cannot make you understand. I cannot make anyone understand what is  happening inside me. I cannot even explain it to myself ’’ তো প্রচ্ছদও তাই, খানিক নাড়িয়ে দেওয়া, দুলিয়ে দেওয়া। খালেদ চৌধুরী কথায়, ‘‘পাবলিশার বলছে, ‘এটা কী করলেন? এক্কের হোয়াইট.’  তো বললাম, ‘দীন না।’ বললে, ‘কী একেবারে কোনও রং নেই কিছু নেই, চারটে লেটারিংকরে ছেপেইে দিলেন!’ বললাম, ‘... জাস্ট লেটারিং করে দিয়ে হোয়াইট বার করে দিন একটা বই, দেখুন কীরকম বিক্রি হয়!’’ তো এখানেই শিল্প, তার ভেতরের ‘আমি’কে প্রকাশ করছে, যে ‘আমি’ শিল্পীর থেকে আলাদা, স্বাধীন। 
‘বিষাণ’ খালেদ চৌধুরীর করা প্রথম প্রচ্ছদ। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় সাড়ে চার হাজারের কাছাকাছি প্রচ্ছদ করেন নানা ভাষায়। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি ছাড়া অসমীয়া এবং উড়িয়া ভাষার প্রচ্ছদও করেছেন বেশ কিছু। এই বইটিতে তাঁর প্রচ্ছদের যতটুকু সংগ্রহ করা গেছে, তার তালিকা আছে। শুধু তালিকায় সীমাবদ্ধ না থেকে এই বইতে আছে সেসব প্রচ্ছদের নমুনা, তাঁর আঁকা, সম্পদ। অসাধারণ ছাপা, আঁকা জীবন্ত, যেন কথা বলছে, নীরব আছে, মনখারাপ করছে, হাসছে, কাঁদছে আরও কতশত অনুভূতি। যেন খালেদ চৌধুরী কথা বলছেন, শিল্প আর শিল্পীর স্বাধীনতার কথা। সে ভাষা যে জানে, সে জানে।
কবি উৎপল কুমার বসু বলছেন ‘‘কবিতা আমরা জানি কোনও স্বয়ংসম্পূর্ণ  বস্তু নয়। কবিতা, পাঠক এবং কবির মধ্যে এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী পদ্ধতি। এই পদ্ধতি-কেন্দ্রিক  চরিত্রের জন্য  কবিতায় ব্যাকরণ, শৈলী এবং নশ্বরতা তৈরি হয়েচে। অপরিদিকে, প্রতিক্রিয়ার জন্মদাত্রী বলে কবিতায় প্রাণ আরোপিত হয়।’’ যে কোনও ‘art form’ কে যদি আমরা এই ভাবনার নিরিখে দেখার চেষ্টা করি, তাহলে টের পাব এই ‘প্রাণ’ এবং  ‘ব্যাকরণ’ নশ্বরতায় ঈশ্বরকে বসায়।  ‘ঈশ্বর’  অর্থাৎ ‘জীবনদেবতা’।  ঘুর-ফিরে আসবে ‘দেখা’র কথাই। এবং এই ‘দেখা’ তাঁকে চিররঞ্জন চত্তচৌধুরী থেকে খালেদ চৌধুরীতে বদলে দেন। আবার সেই ‘Metamorphosis’। প্রদীপ দত্ত জানাচ্ছেন ‘খালেদ’-এর অর্থ ‘চিরকালীন’ বা ‘চিরস্থায়ী’। এক মৌলবীর কাছ থেকে তা জেনে নিয়েছিলেন। আর ‘দত্তচৌধুরী’ পদবি থেকে শুধু ‘চৌধুরী’। মানুষ তো লড়াইতে বাঁচে। ‘রপান্তর’ লড়াই বলে, ভাঙচুর বলে। 
শম্ভু মিত্র বলছেন, ‘‘তারপর একদিন খালেদ চৌধুরী ‘বহুরূপী’তে এলেন এবং রয়ে গেলেন। লোকটির অস্বাভাবিক ক্ষমতা আঁকতে পারেন, যে কোনও বাজনা বাজাতে পারেন, গান শেখাতে পারেন, আর যতো নতুন নতুন জিনিস উদ্ভাবন করতে পারেন। তাঁকে পেয়ে আবার আমাদের মাথায় ‘রক্তকরবী’র  চিন্তা পেয়ে বসল।’
প্রচ্ছদ শিল্পে খালেদ চৌধুরীর এই প্রতিভাকে দুই মালাটে ধরতে চেয়েছে। ধরতে চেয়েছে তাঁর আরকা, ভাবনায় পথ চলার  গল্পে সত্যিতে। আর এই অসম্ভব কাজটি করেছেন প্রদীপ দত্ত। যুক্তাক্ষর প্রকাশনী জানাচ্চে ‘যত ওঁর সান্নিধ্য পেয়েছি, এক ছকভাঙা মানুষকে দেখেছি। ... দীর্ঘ সময় ধরে শিল্পী খালেদ চৌধুরীর সান্নিধ্যে থাকায় এবং খালেদের খুব কাছের একজন হওয়ায় ওঁর কাছে রয়েছে চিত্রশিল্পী, মঞ্চ রূপায়ণ শিল্পী, প্রছ্ছশিল্পী খালেদ চৌধুরীর নানা কাজ। শিল্পী খালেদ চৌধুরীর প্রচ্ছদ ও অন্যান্য শিল্প এক মলাটের ভেতর আনার বাসনা ওঁর অনেক দিনের।’’ এবং সেই পথে সফলভাবে হেঁটেছে যুক্তাক্ষর প্রশনী। যাদের এটিই প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। 
এখন বইটির নাম স্পষ্ট করছে বইটির বিষয়। কিন্তুী আরও  খানিক ময়নাতদন্তে  টের পাওয়া যাবে সেখানেই এই বইটি সীমাবদ্ধ নয়। প্রচ্ছদ ধরে তোলে সময়, ইতিহাস। একসঙ্গে জুড়ে যায় খালেদ চৌধুরীর খালেদ চৌধুরী হয়ে ওঠার কথা, আরও অজস্র মানুষ, লেখক-সাহিত্যিক, মুদ্রণশিল্পী আরও কত কে। প্রচ্ছদগুলি মুদ্রণের সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রকাশ, প্রকাশের তারিখ দেওয়া আছে। ফলে তাঁর বিস্তৃত জীবন, তাঁর আঁকা, তার বাঁক-বদলের, তার ‘journey’র দলিল হয়ে উঠছে এই বই। শিল্পী, শিল্পপ্রেমী প্রদীপ দত্তর এই কিংবদন্তি শিল্পীর জীবন ও শিল্পকর্মের সন্ধানে ছুটে বেড়ানোর ফসল তিনশো দুই পৃষ্ঠার এই বই। 
প্রচ্ছদ শিল্পে খালেদ চৌধুরী। প্রদীপ দত্ত। যুক্তাক্ষর প্রকাশনী। গীতা প্রিন্টার্স। ৩০০০ টাকা।

Comments :0

Login to leave a comment