শান্তনু চক্রবর্তী
মুখ আর মুখোশের পালটাপালটি বিজেপি’র অনেক দিনের পুরানো খেলা। বিজেপি যেহেতু হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সংসদীয় প্ল্যাটফর্ম, তাই কিছু কিছু সাংবিধানিক শর্তাদি বাঁচিয়ে তাদের চলতেই হয়। অন্তত এখনও অবধি। যেদিন বাবা সাহেবের সংবিধানকে বিদেয় করে সঙ্ঘ পরিবারের চিরন্তন মতাদর্শগত গুরু মনুবাদ স্মৃতিশাস্ত্রকেই ভারত রাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের নির্দেশিকা করে ফেলা যাবে, তখন হয়তো সে সবের দায় থাকবে না। কিন্তু ভারতের জনসাধারণ অন্তত ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচন অবধি সেইসব সঙ্ঘ মতলববাজি রুখে দিতে পেরেছেন। সুতরাং হিন্দুত্বের মুখ আর মুখোশটাকে আলাদা রাখার প্রয়োজন এক্ষুনি ফুরোচ্ছে না। হ্যাঁ, দু’-আড়াই দশক আগেও যেভাবে গণপরিষদে আদবানিজী কঠিন কট্টর ‘লৌহপুরুষ’, বাজপেয়ীজী নম্র-কোমল বিকাশপুরুষ হিসাবে অবির্ভূত হতেন। সেই ব্যবস্থাটার হয়তো অতটা এখন দরকার নেই। সেসব দিনে লালকৃষ্ণবাবু টয়েটো গাড়ির রামরথে চেপে, তির ধনুক কাঁধে ঝুলিয়ে, যাত্রাপথের দু’পাশে দাঙ্গা ছড়াতে ছড়াতে ভোট-মৃগয়ায় বেরোতেন। আর আদবানিজীরই ভাবশিষ্য নরেন্দ্র দামোদর মোদী গুজরাটে সংখ্যালঘু নিধনযজ্ঞে পুরোহিত হয়ে পেশি ফোলালে বিকাশপুরুষ অটলজী, বাছা মেরুকরণের পাশাপাশি রাজধর্মের ব্যাপারটাও একটু দ্যাখো ট্যাখো বলে, তাঁকে মৃদু চেতাবনি দিতেন! তাকে গুজরাটে মুসলিম সংখ্যালঘুদের দুরবস্থা-অসহায়তা আতঙ্ক এক ছটাক না কমলেও, এলিট সংবাদমাধ্যমে বেশ হইচই হতো। বাজপেয়ীজী কী উদার, সংবিধান ও সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি কী অবিচল ভক্তি, সেসব নিয়ে প্রশস্তিও শোনা যেত। মোট কথা সংসদে একক গরিষ্ঠতা থেকে অনেক দূরত্ব থাকা সেই পুরাকালের বিজেপি, ওই মুখ আর মুখোশের ভারসাম্যের খেলাটা বাধ্যতই বেশ মন দিয়ে খেলত।
২০১৪-র পরে অবশ্যই বিজেপি’র সেই আগেকার লোকদেখানো রেখে ঢেকে কথা বলার বাধ্য-বাধকতা অনেক কমে গেছে। তবু তো মোদী-শাহ কিংবা যোগী আদিত্যনাথের ৫৬ ইঞ্চি ছাতির দাবাং হিন্দুত্বকেও সাম্প্রদায়িকতার খ্যামটা নাচটা সংবিধানের কিছুটা ঘোমটা টেনেই নাচতে হয় এখনও। যিনি মনুবাদী বর্ণহিন্দুত্ববাদের জাতশত্রু যিনি ‘অ্যানাইহিলেশন অব কাস্ট’ এর মতো এমন ধ্বংসাত্মক বিস্ফোরক ইস্তেহার লিখে গেছেন যিনি হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে কোনও তাত্ত্বিক প্রণোদনার বেদীর তলায় ধারাবাহিক অন্তর্ঘাতের এমন সব ভাবনা চেতনার টাইম বোমা রেখে গেছেন— স্রেফ সংসদীয় নির্বাচনী রাজনীতির খাতিরে এহেন আম্বেদকরকে তাদের সহ্য করে যেতে হচ্ছে। যাঁর মূর্তির মাথা উড়িয়ে দিতে পারলে গায়ের ঝাল মেটে, তাঁর মূর্তির গলায় মালা পরিয়ে হাতজোড় করে সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে, সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক স্নায়ুর ওপরে এ তো মস্ত চাপ। যাঁকে সইতে নারি, তার চলনবলন সবেতেই প্রকাশ্যে সিলমোহর দেওয়ার ওই ধারাবাহিক দায় মাঝেমধ্যে ধৈর্য-চ্যুতি তো ঘটায়। সেজন্যেই খোদ দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, দেশের সংসদ ভবনে, দিনরাত কেন শুধু আম্বেদকর-আম্বেদকর-আম্বেদকর বলে মালা জপা হচ্ছে, এই অভিযোগে ক্ষোভে বিরক্তিতে ফেটে পড়েন! এটা ওই আচমকা বেরিয়ে পড়া মুখোশ ছাড়া মুখ। যার জন্যে বিজেপি-কে অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে, হচ্ছে— সেই উগ্র জাতিবাদী মুখ তাই ঝটপট সাংবিধানিক সংসদীয় ধপধপে চাদরে ঢেকে ফেলতে হয়।
কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের তো অমন কোনো সাংবিধানিক দায় নেই। তাদেরকে তো নির্বাচনে লড়তে হয় না। অন্তত মুখে তো তাই বলা হয়ে থাকে। তাহলে এই মুহূর্তে আরএসএস’র সরসঙ্ঘচালক বা সংগঠনের প্রধান মোহন ভাগবত মাঝেমধ্যেই সঙ্ঘের লাইনের উল্টো রাস্তায় হেঁটে, গদি-মিডিয়া কথিত দিল্লির ‘ফেকু’ সেকুলার-লিবেরাল বাহিনী বা গদি-মিডিয়ারই আর একটা প্রিয় খান-মার্কেট গ্যাং-এর সদস্যদের জবানিতেই বয়ানবাজি করে যাচ্ছেন কেন? এই কিছুদিন আগেও যখন দেশের উত্তর ও পশ্চিমের বিভিন্ন মসজিদ, সুফি-দরগা, এমন কি নেহাতই সমাধি-স্মারকের নিচেও নিয়ম করে প্রাচীন মন্দিরের অস্তিত্ব শোনা যাচ্ছিল আর নিম্ন আদালতে তাই নিয়ে একটা করে মামলা ঢুকে দেওয়া হচ্ছিল। তখনই পুণের একটি আলোচনা সভায় গিয়ে সরসঙ্ঘচালক একদম উল্টো কথা বললেন। তিনি বললেন, রোজ রোজ নতুন করে মসজিদের তলায় মন্দিরের অস্তিত্বের দাবি তোলাটা কোনেও কাজের কথা নয়। তবে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি-সংহতি ঐক্যের ক্ষতি হয়। সংবিধানের আদর্শেও ধাক্কা লাগে।
একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে! আরএসএস মুখ্য দেশের সংবিধান বিপন্ন হতে পারে বলে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন! সেই সঙ্ঘ, থাকা সংবিধান চালু হওয়ার কয়েক দশক অবধি তাকে স্বীকারই করেনি! ভারতীয় সংবিধানের ৭৫ বছর পূর্তির প্রাক্কালে বিজেপি অবশ্য ২৬ জানুয়ারি নয়, ২৬ নভেম্বর সংবিধান পরিষদ যেদিন নতুন সংবিধানকে সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করেছিল, সেই দিনটাকেই সংবিধান দিবস হিসাবে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে, এটাকে তো সরসঙ্ঘচালকের তরফে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রকে জন্মদিনের আগাম উপহার বলা যেতে পারে। ভাগবতপন্থী শুধু এইটুকুতেই থেমে যাননি। আজও একধাপ এগিয়ে একথাও বলে ফেলেছেন, কেউ যদি মনে করে থাকেন, মন্দির-মসজিদ নিয়ে বিবাদ বিতর্ক উসকে দিয়ে। আজ সাম্প্রদায়িক আবহ পরিস্থিতিকে খারাপ করে, তাঁরা হিন্দুদের নেতা বলে যাবেন, তাহলে তাঁরা ভুল ভাবছেন। বাপরে! এতো রীতিমত হিন্দুত্ববাদের সদর দপ্তরেই কামান দাগার মতো ব্যাপার! কিন্তু সঙ্ঘ পরিবারের বাকি সদস্যরা কী সেই কামানের গোলায় মূর্ছা গেল? একেবারেই নয় কাশী পীঠের শঙ্করাচার্য থেকে শুরু করে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের শীর্ষ নেতা হয়ে, খুচরো মাঝারি নানা কিসিমের হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, বিজেপি নেতৃত্বে সুযোগ বুঝে যাদের উস্কে দেন, আবার বাড়াবাড়ি করে বেকায়দায় পড়লে মুহূর্তে আমাদের কেউ নয় বলে দায় ঝেড়ে ফেলেন— তারা সব্বাই মিলে ভাগবতজীর কড়া সমালোচনা করলেন। শঙ্করাচার্য অভিযুক্তে স্বরূপানন্দ সরস্বতী তো রীতিমত আবেগপ্রবণ হয়ে বলেই ফেললেন, সরসঙ্ঘ চালক হিন্দুমনের ব্যথা বোঝেনই না। মানে এই যে ভারতে শত শত মসজিদ মজার দরগার নিচে শত শত মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে, ক’দিন আগেও হিন্দুরা যার খোঁজও রাখেননি— সেইসব ভেঙা পড়া, চাপাপড়া ধর্মস্থানের জন্য তাঁদের কষ্ট উথলে উঠেছে, ভাগবতীজী সেই দুঃখ চোখের জল দেখতেই পাচ্ছেন না।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা আরও এক কাঠি এগিয়ে বলেই দিলেন, আরএসএস’র সঙ্ঘ চালক সনাতন ধর্মের ব্যাপারে মতামত দেওয়ার কে? সঙ্ঘ ধর্মের কী বোঝে? তারা তো স্রেফ একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন। হাওয়া বেগতিক দেখে সঙ্ঘের ইংরেজি মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-ই ময়দানে নেমে পড়ল। পুনের মোহন ভাগবতের বক্তব্যের প্রায় ৩৬০ডিগ্রি উল্টো অবস্থানে দাঁড়িয়ে অর্গানাইজারের সম্পাদকীয়-য় লেখা হলো : ঐতিহাসিকভাবে হামলা ও ধ্বংসের শিকার হওয়া ধর্মীয় স্থানগুলি সম্পর্কে সত্য জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ — সভ্যজগতে (সিভিলাইজেশনাল-সঙ্ঘপরিবারের ভীষণ প্রিয় একটা শব্দ) ন্যায়বিচার ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষার স্বার্থে ইতিহাস জানা প্রয়োজন... মেকি ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীদের ভুল ব্যাখ্যায় সত্য সন্ধানের প্রক্রিয়াটা বন্ধ হয়ে গেলে, উলটে তা মৌলবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ, সাম্প্রদায়িক শত্রুতা-হানাহানিকেই উৎসাহিত করবে। তার মানে ‘ইতিহাসের সন্ধান’ চলুক। প্রশাসন ও আদালতের পরোয়ানা নিয়ে পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ যেখানে খুশি খোঁড়াখুঁড়ি করুক। তাই নিয়ে গোষ্ঠী-সংঘর্ষ, পুলিশের গুলি চলুক। উত্তর প্রদেশের সম্ভগের মতো কিছু লাশ পড়ুক। কিন্তু হিন্দুদের পক্ষে ‘‘সভ্যতা ও ইতিহাসের ন্যায় বিচার’’ আদায় না করে থামা চলবে না! ১৯৯২-এর ধর্মস্থান আইন বদলানো নিয়ে মামলার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক অন্তর্ধর্মী আদেশে ইতিহাস-অনুসন্ধানের হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পে সাময়িক সেমিকোলন হয়তো পড়েছে। কিন্তু তাতে ‘মন্দির ওহি বনায়ঙ্গে’ স্লোগানের গলার জোর রাতারাতি কমে যাবে বা সংখ্যালঘু ধর্মীয় স্থাপত্যের মাটির তলায় খোঁজাখুঁজি করে দেখার সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী দাবিতে একেবারে পূর্ণচ্ছেদ পড়ে যাবে, এতটা আশা করা বোধহয় যাচ্ছে না।
আর কিভাবেই বা করা যাবে? স্বয়ং সেবকদের সরসঙ্ঘচালক যখন পুনের সেমিনারে গিয়ে সবার ধর্মচারণের স্বাধীনতার পক্ষে গরম গরম ভাষণ দিয়ে আসছেন, তার সপ্তাহ দেড়েক আগেই এলাহাবাদ হাইকোর্টের কর্মরত বিচারপতি শেখর যাদব সরাসরি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সম্মেলনে চলে যাচ্ছেন। আর সেখানে বিশাল হিন্দু জনসমাবেশের সামনে প্রকাশ্যে বলছেন, এদেশের আদালত-বিচার, সরকার-প্রশাসন সবটাই চালাচ্ছে, চালাবে ‘বহু সংখ্যক’ মানুষজন। মানে ভারতবর্ষের আইন-কানুন-সংসদ-মন্ত্রীসভা সবটাই চলবে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদীদের মরজিমাফিক। ভাবুন, উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতি এই কথা বলছেন এবং তিনি এমন একটা আদালতের চেয়ারে বসে আছেন, যেখান থেকে ধারাবাহিকভাবে ‘অর্গানাইজার’ কথিত ওই ইতিহাস-অনুসন্ধানের আদেশ দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কারোর যদি সংশয় জাগে, এই যে ঘন ঘন মসজিদের নিচে মন্দির খোঁড়ার জিগির আর তাতে প্রায় তৎক্ষণাৎ আদালতের সবুজ সংকেত, এই পুরোটাই আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী বাস্তুতন্ত্রের অংশ, তাহলে তাঁকে খুব কী দোষ দেওয়া যাবে?
এই বাস্তুতন্ত্রকেই ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ-রাজনীতির ভাষ্যকার, ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্রিস্তফ জ্যাফ্রেলট বলেছেন হিন্দুত্ববাদী ‘ডিপ স্টেট’। সরকারী নীতি-প্রশাসনিক বন্দোবস্ত বিচারব্যবস্থার একাংশের সঙ্গেই সেখানে হাতেহাত মিলিয়ে জুটে যায় নানা গোত্রের হিন্দু-সেনা, গোরক্ষক বাহিনী, অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড, দেবভূমি সুরক্ষা অভিযান গোছের ঠ্যাঙাড়ে-বাহিনী, হ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড, দেবভূমি সুরক্ষা অভিযান গোছের ঠ্যাঙাড়ে-বাহিনী বা ধর্মীয় মিলিশিয়া। এই ‘ডিপ স্টেট’-এর মোডাস অপারেন্ডি খুব সরল। লাভ জিহাদের অভিযোগে বাড়ির যুবকটি অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াডের হাতে গণপিটুনি খেয়ে যখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে কোনোরকমে লড়ে যাচ্ছে, ততক্ষণে সংখ্যালঘু বাড়ির দুয়ারে পৌঁছে গেছে সরকারি বুলডোজার। অপরাধী-প্রেমিকের বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। হিন্দুত্ববাদী ডিপ স্টেট আগে সাজা দেবে, প্রমাণ-আদালত-বিচার এসব পরে হলেও চলবে। এভাবেই উত্তরাখণ্ডের পোরোলায় লাভ জিহাদের ভুয়ো অভিযোগ ছড়িয়ে, প্রায় দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি করে, বহু মুসলিম পরিবারকে তাদের কয়েক পুরুষের ভিটেমাটি, রুজিরুটি-ব্যবসা ফেলে অন্য শহরে চলে যেতে বাধ্য করেছে, দেবভূমি সুরক্ষা অভিযান নামে সংগঠনটি অবশ্যই স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনের মদতে এবং আরও বৃহত্তর পর্যায়ে শেষ অবধি রাজ্যের বিজেপি সরকারের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে।
উত্তরাখণ্ড তথা ‘দেবভূমি’-কে তথাকথিত ‘ম্লেচ্ছ’ ‘যবন’ (পড়ুন মুসলিম)দের কলুষমুক্ত করাটা ওই সংগঠনটির ঘোষিত কর্মসূচি। সঙ্ঘ-পরিবারের ‘ডিপ স্টেট’ এই প্রকল্পটাকেই সম্প্রসারিত করে গোটা দেশের জন্যই এমন কর্মসূচি ভাবতেই পারে। সত্যি বলতে কী গত ১০০ বছর ধরে আরএসএস সেই লক্ষ্যেই দেশের প্রত্যক্ষ এলাকাতেও খাকি প্যান্ট আর গেরুয়া ঝান্ডার সংগঠন গড়ে তুলেছে। তাই অর্গানাইজারের সম্পাদকীয় স্তম্ভে যা লেখা হয়েছে, সেটাই হিন্দুত্ববাদের মুখের ও মনের কথা। মোহন ভাগবত পুনে গিয়ে মুখোশ সাজার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পাছে তাঁর গায়েও ‘মেকি ধর্মনিরপেক্ষ’ ছাপ পড়ে যায়। তাই তড়িঘড়ি আবার লাইনে ফিরে এসেছেন। আর ২০২৪-এর ২২ জানুয়ারি রামমন্দির উদ্বোধনের দিনটাকেই ভারতের প্রকৃত স্বাধীনতা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছেন। তা বেশ করেছেন। ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট যে স্বাধীনতা এসেছিল, তার জন্য লড়াই-সংগ্রামে আরএসএস বা তার ভ্রাতৃপ্রতিম হিন্দু মহাসভার তো এক ছটাকও ভূমিকা ছিল না। তাদের ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’ তো শুরু হয়েছে, ১৯৪৯ সালে, বাবরি মসজিদের অন্দরে, রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি রামলালার মূর্তি বসিয়ে আসা দিয়ে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ২২ জানুয়ারি সঙ্ঘ-পরিবারের ‘স্বাধীনতা দিবস’ হতেই পারে। কিন্তু তাঁদের গুরু গোলওয়ালকর তাঁর ‘বাঞ্চ অফ থট্স’-এ এত যে জাঁক করে লিখলেন, ভারতের সংবিধানে ‘ভারতীয়’ বলে কিছু নেই। সবটাই বিদেশের অনুকরণ— কিন্তু তাঁরা নিজেরা যেসব বিষয় নিয়ে মুসলিম-বিদ্বেষ প্রচার করেন, ঘৃণা-ভাষণের ফুলকি ছড়ান, সেসবের উৎসটা কী কখনো খতিয়ে দেখেছেন? সোমনাথ মন্দির থেকে রামমন্দির-বিতর্ক অবধি হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ-সংঘাতের সমস্ত মালমশলা উপাদানই তাঁরা সংগ্রহ করেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ধ্বজাধারী, ঔপনিবেশিক ইতিহাসকারদের লিখে যাওয়া বিকৃত বৃত্তান্ত থেকে।
আসলে জন্ম থেকেই যে সংগঠন সাম্রাজ্যবাদের দালালি করে এসেছে, স্বাধীন ভারতেও স্বদেশ-চেতনা, ভারতীয় ভাবধারা, বি-উপনিবেশিকরা, ইত্যাদির নাম করে, তারা আসলে ঔপনিবেশিক ইতিহাস-চেতনারই চাটুকারবৃত্তি করে চলেছে। ভারতীয় ঐতিহ্যের নাম করে সঙ্ঘ-পরিবার আসলে যেটা চালাতে চেয়েছে, সেটা সেই ঔপনিবেশিক বিদ্বেষ আর বিভাজনের নীতিরই উত্তরাধিকার। তাই স্বাধীনতা, সংবিধান, স্বদেশপ্রেম নিয়ে সঙ্ঘ পরিবার যে কথাই শোনাতে আসুক, সেটা বিশ্বাসযোগ্য হবে না। কারণ তাদের তথাকথিত রাষ্ট্রবাদের ডিএনএ-তেও তো ঔপনিবেশিক ভেজাল ভর্তি। তাই প্রকৃত স্বদেশ-চেতনা, ভারতীয়ত্ব তাদের সহ্য হয় না। সেই কারণেই তাদের নিজেদের কোনও অনু্ষ্ঠানেও বিহারের জনপ্রিয় মহিলা লোকশিল্পী যখন গান্ধীজীর প্রিয় ‘রামধনু’ গাইতে শুরু করেন, ‘জয় শ্রীরাম’-এর উদ্ধত রণহুঙ্কারে সেই সুর ডুবিয়ে দেওয়া হয়। আসলে আগ্রাসী ঘৃণার রাজনীতিটাই বোধহয় তাদের একমাত্র মুখ, বাদবাকি সবটাই আসলে মুখোশ!
Comments :0