ঈশান লাল
পঞ্চাশ বছর, একেবারেই পঞ্চাশ বছর আগে লেখা অশোক মিত্রর একটি ইংরেজি গদ্যের শিরোনামের বাংলা তর্জমা এমন হতে পারে: ‘এলেন দেবী দুর্গা’। প্রকাশিত হয়েছিল ‘ইকোনোমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’-তে ১৯৭৪ সালে।
সেই ১৯৭৪ সাল, রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় সন্ত্রাসে মানুষ খুন যখন সহজ সরল প্রাত্যহিকতায় পৌঁছেছিল, অথবা প্রাত্যহিকতাকেও পার হয়ে যাচ্ছিল এই রাজ্যে। ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই শনিবার ভিয়েতনাম দিবসে প্রকাশ্য দুপুরে প্রবীর দত্ত খুনের পর অশোক মিত্রের যে গদ্য তার বাংলা ভাষান্তরের চেষ্টা করলে হয়তো এমন হয়: ৬০ কোটি মানুষের এই দেশে মানুষের প্রাণের দাম বড্ড সস্তা: ‘সকালের খাওয়ার আগে গোটা দুই মানুষ গুলি করে মারো, আরও এক গন্ডা বা বেশি সকাল আর দুপুরের খাওয়ার মাঝে, সন্ধে নামার আগে আরও দুটো বা তিনটের বেশি।’ সেই ১৯৭৪ সালেও সেই জুলাই মাস পার হয়ে সেপ্টেম্বরের কিনারায় বা অক্টোবরে এসেছিল দুর্গাপুজো।
সে-সময়ের দুর্গাপুজো নিয়ে অশোক মিত্রের সেই ইংরেজি গদ্যের (‘কামেথ দ্য গডেস’, ইপিডব্লিউ ১৯৭৪, পরবর্তীকালে সংকলিত হয়েছে ক্যালকাটা ডায়ারি-তে ) পর্যবেক্ষণ ছিল— উৎসবের পুরো মরশুমটাই শহুরে শ্রেণির দখলে চলে গেছে। শহুরে মানুষ রীতিমতো স্নায়ুর চাপে ভুগছে বাহুল্যময় প্রদর্শনবাদে কোথাও যেন কোনও ফাঁক থেকে না যায়। দেব-দেবীকে তো বেঁচে থাকতেই হবে, আসতেই হবে যাতে তাঁদের উপর নির্ভর করে বেঁচে-থাকা পরগাছা পরজীবীরা বাঙালির সম্প্রদায়গত সামূহিক আরাধনাকে ব্যবহার করে বাণিজ্য-বেসাতি করে খেতে পারে। পুরোটাই হিন্দু বাঙালি আরাধনার বাণিজ্যিকীকরণ আর শহুরেকরণ।
পঞ্চাশ বছর পর বদলেছে কতটুকু ?
বদলায়নি বড় একটা। বরং বলা যেতে পারে, তার সঙ্গে দখলদারির আরও দু’-একটা মাত্রা যোগ হয়েছে। দখলদারি আরও সর্বাত্মক হয়েছে। গত শতকের সাত বা আটের দশক অবধিও শোনা যেত কলকাতার বেশ কয়েকটি দুর্গাপুজো বা মধ্য-কলকাতার একটি কালীপুজোর মালিকানা কেনা-বেচা হতো। রাজনৈতিক নেতাদের হাতের মুঠোয় কিছু পুজো থাকত আর বাকিটা দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকদের প্রশ্রয়পুষ্ট বাহুবলীদের হাতে। সুতরাং সেই সব বছরে পরজীবীদের ঝাড় বাড়ছিল গতিতে, তারাই শাসক, দুনিয়া তাদের।
একুশ শতকের শূন্য দশকের কিনারায় এসে দ্রুত যুক্ত হতে থাকল নতুন মাত্রাগুলি। পুজোগুলি সরাসরি চলে গেল কাউন্সিলর বা ছোট বড় দক্ষিণপন্থী নেতাদের হাতে। অথবা উলটো দিক থেকে বলা যায়, মহানগর বা নগর-পরিসরের দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে উপছে পড়ছে বাহুবলীদের ভিড়। কোনও রাখঢাক না-রেখেই শাসনবিধি অনুমোদিত পদে তাদের দেদার ভিড়। যে ক’টি পুজো প্রতিষ্ঠান বা সঙ্ঘ রাজনীতির বাইরে ছিল, স্থানীয় মানুষদের আয়োজনে ছিল, তাও দখলে নিয়ে তবে শাসকদলীয় লোভ ও লাভের পরিতৃপ্তি।
গত এক যুগে মহানগর বা শহরতলিতে এমন কোনও দুর্গোৎসব মেলা কঠিন যা শাসকদলের কোনও কাউন্সিলর, বিধায়ক, নেতা, মন্ত্রীর অধীনের বাইরে রয়ে গেছে। আদলটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এইরকম: এঁদের প্রত্যেকের অধীনে একটি খাস বৃহৎ পুজো থাকবে, সেটি খাস তালুক, আর এলাকার বাকি সকল পুজোর মাথায় হয় তিনি প্রধান পৃষ্ঠপোষক, নয় সভাপতি, নয়…
বাঙালি দুর্গোৎসবের এই রাজনৈতিক-বাহুবলীতন্ত্র, ক্ষমতাতন্ত্রের বিস্তৃত জালের নিরেট বুনোট যখন তৈরি হয়ে গেল বিগত এক যুগের খানিক বেশি সময় ধরে, তখন এই তন্ত্রের মাথায় যিনি আছেন দখলে-নেওয়া সমগ্র উৎসবের উপর আড়ে-বহরে তাঁর কর্তৃত্বের ঘনত্ব বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বোধন বা প্রাক-বোধন থেকে বিসর্জন বা বিলম্বিত-বিসর্জন অবধি কর্তৃত্বের সেই লক্ষণগুলিই প্রকট হয়ে উঠেছে মারীগুটিকার মতো।
সুতরাং আমি যেমন ‘অনেক মাস্তান কন্ট্রোল করি’ তেমনই সকল পুজোই আমিই ‘কন্ট্রোল’ করি। রাজ্যের সকল বিধানসভা কেন্দ্রে যেমন ‘আমাকেই ভোট দিন’, অতএব সকল বিধানসভা কেন্দ্রের যেমন আমিই বিধায়ক তেমনই সকল দুর্গোৎসবই আসলে আমার মালিকানায় দুর্গাপুজো। এই কর্তৃত্ববাদ যেহেতু এই রাজ্যের ক্ষমতায় সুতরাং নিজের কর্তৃত্বলোভকে পরিতৃপ্ত করতে রাষ্ট্রের অর্থ, জনগণের অর্থ ব্যবহার করতে আর বাধা থাকে না, আসল কথা লজ্জাও থাকে না। পুজোর সংগঠকদের যে লাখ-ছুঁই ছুঁই (আগামী বছর নিশ্চয় পাকা এক লাখই ছোঁবে) অনুদান দেওয়া হচ্ছে, মহানগরে, জেলায় জেলায় যে বিসর্জন-কার্নিভাল আয়োজন করা হচ্ছে দেদার জেলা-জলুসে, এই সহজ, অতি-সহজ সত্যটা আমরা কিছুতেই ভুলতে চাইছি না, তা জনগণের অর্থেই। অথচ সেই অর্থ-অনুদানের, সেই অর্থের অপচয়-বিনিময়ে জেল্লা-জলুস আয়োজনের মৌতাত ভোগ করছেন ক্ষমতাতন্ত্রের প্রধান।
জনগণের অর্থের বিনিময়ে পুজো-কমিটিগুলোকে অনুদান অথচ প্রতি মণ্ডপের প্রবেশপথে বা অভ্যন্তরে ঝোলানো থাকবে একজনেরই ছবি। ১৯৭৪ সালের দুর্গোৎসব নিয়ে অশোক মিত্রের সেই গদ্যে রাজনীতিকদের কথা ছিল। দুরারোগ্য রোগের মতো রাজনীতিক। যাদের হাজিরা ‘এমনকি’ পুজো উদ্বোধনেও। বিগত পঞ্চাশ বছরে ওই ‘এমনকি’ শব্দটার মধ্যে যেটুকু দ্বিধা বা আড়াল ছিল, তা একেবারে ধুয়ে মুছে গেছে। পিছনের এক দশকে রাজনীতিকদের, ক্ষমতায় আসীন রাজনীতিকদের উদ্বোধন ছাড়া কোনও পুজো শাস্ত্রীয় আচারের চারদিনে পৌঁছাতেই পারবে না। এবং সিংহভাগ পুজোর উদ্বোধক একজন, সেই একজন যিনি বাহুবলীতন্ত্রের, উৎসবকে দখল করার ক্ষমতাতন্ত্রের চূড়ায়।
সেইমতো কার্নিভাল। উদ্বোধন যেমন ক্ষমতাতন্ত্রের শিরোমণিকে বাদ দিয়ে কিছুতেই সাঙ্গ হতে পারে না তেমনই বিসর্জনও আমাকে দেখিয়ে তবে নিরঞ্জন। তাই কার্নিভালের মঞ্চ জুড়ে আমি, আমাকে দেখিয়ে তবে শোভাযাত্রায় প্রতিমা যাবে গঙ্গার ঘাটে। বাঙালির বৃহত্তর উৎসবকে দখলের বৃত্তে আনার পথে কোনও ফাঁক রাখা চলবে না।
এই প্রথম বিরোধিতার মুখে পড়ল সেই সর্বাত্মক দখলদারি। দখলদারির মুখে পড়তে পারে, ক্ষমতাতন্ত্র যে সে-কথা একেবারে আন্দাজ করতে পারছিল না, তা নয়। ক্ষমতাতন্ত্রের পক্ষ থেকে বাক্য ছিল, ‘অনেক তো হলো, এবার উৎসবে ফিরুন !’ বা এই ধরনের সামান্য হেরফের। উৎসবে ফিরুন মানে, আমার দখলের আয়ত্তে ফিরে আসুন। আমার দখলের বাইরে থাকার অবাধ্যতা চলবে না, সবশুদ্ধ আমার দখলে অন্দরে চলে আসুন !
অথচ পুরোটাকে দখলের অন্দরে আনা গেল না। উৎসবের মধ্যেই প্রতিবাদের স্রোত জেগে থাকল। এবং দখলের গাঢ় বিপরীত চিহ্ন হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকল ধর্মতলায় অনশন মঞ্চ।
ক্ষমতাতন্ত্রের পক্ষে মেনে-নেওয়া বড় কঠিন। আরও কঠিন এই কারণে, উদ্বোধনের বা উৎসব আয়োজনের তবু নানা বিন্দু থাকে, কিন্তু বিসর্জন-কার্নিভালের তো একটাই কেন্দ্র, সেই ধর্মতলা, সেই রেড রোড। আর সেখানেই দখলদারির বিপ্রতীপ চিহ্ন। যা অনশনমঞ্চ। অন্যতর বিষয়ে নবীন চিকিৎসকদের অনশনমঞ্চ গড়ে উঠলেও আসলে তা উৎসব-দখলদারির বিপরীত চিহ্ন, সার্বিক দখলদারির বিপরীত চিহ্ন।
এবারের কার্নিভালে রেড রোডে যখন আলোর রোশনাই, বেজে উঠবে বিসর্জনের ঢাক, হাজার কাঠির ঝনৎকার, নিশ্ছিদ্র অনশন দখল নেবে মঞ্চে শায়িত কয়েকজন তরুণের এক-একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। আপনার হয়তো মনে পড়ে যাবে, গত শতকের সেই সব সত্তরেই লেখা শঙ্খ ঘোষের ‘হাসপাতালে বলির বাজনা’, আমরা কিছুতেই বলব না কার্নিভালে বলির বাজনা, আমরা শুধু দেখব, কার্নিভাল মঞ্চ আর অনশন মঞ্চ— মঞ্চের দুই বিপরীত চিহ্ন। দখলের দুই বিপ্রতীপ বিজ্ঞান।
পঞ্চাশ বছর আগে প্রবীর দত্ত খুনের পর, অশোক মিত্রের ইংরেজি গদ্যের বিস্ফোরক অংশটির বাংলা ভাষান্তরের চেষ্টা ইতিমধ্যেই আমরা করেছি: ‘সকালে খাওয়ার আগে গোটা দুই মানুষগুলি করে মারো…’ , কিন্তু এই বাক্যগুলির পরেই ঘাপটি মেরে ছিল, বড় জোর দু’-আড়াইখানা নিরীহ কথা। ওই সব খুনের কথা শুনতে শুনতে সত্তায় ক্লান্তি প্রবেশ করবে, আত্মা ক্লান্ত, ক্লান্ত হবে। যতক্ষণ না একটা খুন আমার ঘর-দুয়ার অবধি চলে আসে।
আরজিকর, মেমারি, জয়নগর, পটাশপুর— নারীত্বের অবমাননা, মানবতার অবমাননা চলছেই। প্রায় প্রতিদিন শুনতে শুনতে সত্তা ক্লান্ত হবে, একঘেয়ে লাগবে। সব স্বাভাবিক থাকুক, সব চলুক— উৎসব, উদ্বোধন, কার্নিভাল, সব দেখে শুনে সয়ে যাবো, হয়তো মেতে মিশেও যাবো, যতক্ষণ না মনুষ্যত্বের ওই চূড়ান্ত অবমাননার একটি আমরা চৌকাঠ অবধি চলে আসে।
Comments :0