সৌরভ চক্রবর্তী
প্রতি বছর ১৪-২০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গে পালিত হয় অরণ্য সপ্তাহ। উদ্ভিদ চারা রোপণ তথা বনমহোৎসব আজ বাংলার সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। রেকর্ড ভাঙা তীব্র গরম, মৌসুমী বায়ুর খামখেয়ালিপনা, বর্ষা ঘোষিত হলেও তেমন বর্ষা নেই— উত্তাপ কমছে না। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী বাতাসের কার্বন-ডাইঅক্সাইড শোষণে অরণ্যের ভূমিকা, বাতাসকে শীতল রাখার জন্য গাছের পাতার বাষ্পীভবন যা আবার বৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি করে, আঞ্চলিক জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, জল পরিশুদ্ধ করে ভূগর্ভস্থ জলকে রিচার্জ করা, ভূমিক্ষয় রোধ করার মতো বর্তমান ইস্যুগুলির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে অরণ্য সপ্তাহ পালন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রবীন্দ্রনাথ পরিবেশ আন্দোলনের অগ্রদূত
অরণ্য সপ্তাহ তথা বনমহোৎসব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে রবীন্দ্রনাথ আসবেনই। শান্তিনিকেতনের গৌড় প্রাঙ্গণে সিংহ সদনের সামনে একটি বকুল চারা রোপণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বনমহোৎসব ঘোষণা করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তার ২২ বছর পর ১৯৫০ সালে দেশের সরকার জুলাই মাস ধরেই বনমহোৎসবের ঘোষণা করে।
বন মহোৎসব শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের "মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে " গান গেয়ে। 'পল্লীপ্রকৃতি' গ্রন্থে 'অরণ্যদেবতা', 'হলকর্ষণ' এবং ' জলোৎসর্গ ' এ তিনি যা বলেছিলেন বা মুক্তধারা নাটকে বাঁধ দিয়ে বেঁধে দেওয়া জলকে মুক্ত ক'রে মুক্তধারায় পরিণত করার কাহিনি যেন আজকের পরিবেশ সঙ্কট বনাম উন্নয়ন বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে আজকেরই লেখা-প্রচারপত্রে ছেপে বিলি করলেই হলো।
অরণ্য দেবতায় তিনি লিখলেন, " মানুষ গৃধনুভাবে প্রকৃতির দানকে গ্রহণ করেছে; প্রকৃতির সহজ দানে কুলোয়নি, তাই সে নির্মমভাবে বনকে নির্মূল করেছে। তার ফলে আবার মরুভূমিকে ফিরিয়ে আনবার উদ্যোগ হয়েছে। ভূমির ক্রমিক ক্ষয়ে এই যে বোলপুরে ডাঙ্গার কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে, বিনাশ অগ্রসর হয়ে এসেছে— এক সময়ে এর এমন দশা ছিল না, এখানে ছিল অরণ্য— সে পৃথিবীকে রক্ষা করেছে ধ্বংসের হাত থেকে, তার ফলমূল খেয়ে মানুষ বেঁচেছে, সেই অরণ্য নষ্ট হওয়ায় এখন বিপদ আসন্ন।"
' হলকর্ষণ ' এ তিনি লিখলেন, " পৃথিবীর দান গ্রহণ করার সময় লোভ বেড়ে উঠলো মানুষের। অরণ্যের হাত থেকে কৃষি ক্ষেত্র জয় করে নিলে, অবশেষে কৃষি ক্ষেত্রের একাধিপত্য অরণ্যকে হটিয়ে দিতে থাকলো। নানা প্রয়োজনে গাছ কেটে কেটে পৃথিবীর ছায়াবস্ত্র হরণ করে তাকে দিতে লাগল নগ্ন করে। তাতে তার বাতাসকে করতে লাগল উত্তপ্ত, মাটির উর্বরতা ভাণ্ডার দিতে লাগল নিঃস্ব করে। অরণ্যের-আশ্রয়-হারা আর্যাবর্ত আজ তাই খরসূর্যতাপে দুঃসহ।"
এতো আজকেরই কথা! মৃত্তিকার অবক্ষয়, অরণ্যের সাথে আবহমণ্ডলের তাপের সম্পর্ক তিনি সেই কবেই বলেছেন! আর " মাটির বুকের মাঝে বন্দি যে জল মিলিয়ে থাকে / মাটি পায়না, পায়না, মাটি পায়না তাকে " - এতো জলচক্রের নিখুঁত বর্ণনা! এই চিরায়ত অমূল্য সম্পদ আজ আমাদের আয়ুধ। ইউনাইটেড নেশনস'র বর্তমান লক্ষ্যে তো এসব কথাই আছে! রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে আজ পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা অনেক শাণিত যুক্তি হাজির করতে পারে। রবীন্দ্রনাথই পারেন বনমহোৎসবে শামিল হওয়া লাখো মানুষকে আজকের জলবায়ু সঙ্কট বিরোধী লড়াইয়ের সারিতে দাঁড় করিয়ে দিতে।
চরম সঙ্কটে অরণ্য বাস্তুতন্ত্র
অরণ্যে ৬৮% স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৭৫% পাখির প্রজাতি, ৮০% উভচর প্রজাতির বাস। অরণ্য ধ্বংস হলে প্রজাতিগুলোও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ইউনাইটেড নেশনস বলছে ১৯৯০ সালের পর থেকে ১০ শতাংশ অরণ্য ধ্বংস করা হয়েছে- প্রতি মিনিটে ৩৭টা ফুটবল মাঠের সমতুল অরণ্য ধ্বংস প্রাপ্ত হচ্ছে। ২০২২ সালে ১৬ মিলিয়ন হেক্টর বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। বিগত ৫০ বছরে আমাজনের ১৭% ক্রান্তীয় অরণ্য কেটে আগুন লাগিয়ে সাফ করা হয়েছে পাম তেল, সয়াবিন, খনি, নগরায়নের জন্য। ধ্বংস হচ্ছে জীব-বৈচিত্র, বিনষ্ট হচ্ছে জলচক্র, ঘটছে ভূমিক্ষয়। ইউনাইটেড নেশনস যা বলেছে তা বিস্ময়কর— যে জমির উপর জঙ্গল দাঁড়িয়ে আছে সেই জমির আর্থিক মূল্যের কারণেই অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে চকোলেট এবং শ্যাম্পু তৈরি করতে পাম তেলের প্রয়োজন হয়। গোটা বিশ্বের চকোলেট এবং শ্যাম্পুর জন্য কি সুবিশাল অরণ্যে প্রয়োজন! একবার অরণ্য ধ্বংস হলে তাকে আর ফেরানো যায়না - প্রক্রিয়াটা একমুখী।
অতীত ভারতের অরণ্য ব্যবস্থাপনা
রবীন্দ্রনাথ ভূমিক্ষয়ের কারণে বোলপুরে মাটির ডাঙ্গার কঙ্কালসার চেহারার কথা বলেছেন এবং বলেছেন আগে সেখানে ঘন অরণ্য ছিল আর সেই অরণ্য নিধন মানুষের লোভের কারণেই— এখান থেকেই প্রশ্ন আসে ভারতের অতীত ইতিহাসের সামাজিক অরণ্য ব্যবস্থাপনা কেমন ছিল? কেন তা ভেঙে পড়লো? এর জন্য দায়ী কে? কেমন করে অরণ্যছেদন পরিবেশ এবং চিরায়ত কৃষি ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে?
গবেষকেরা বলছেন যে, সিন্ধু সভ্যতার পর্বে উদ্ভিদের সংকরায়ন, উদ্ভিদের গৃহ পালন, উদ্যানবিদ্যার নিদর্শন পাওয়া যায়।
সম্রাট অশোকের আমলে শ্রেষ্ঠ বন ব্যবস্থাপনা
এরপর আসে মৌর্য সাম্রাজ্যের পর্ব। ব্রাহ্মী ভাষায় লিখিত সম্রাট অশোকের গিরনার শিলালিপি থেকে জানা যায়, দেবনাম প্রিয় সম্রাট প্রিয়দর্শী বলছেন যে, “ আমি মানুষের এবং পশুদের জন্য ভেষজ ওষুধের ব্যবস্থা করেছি, দূর থেকে তুলে এনে ঔষধি গাছ গাছরা, ফলমূল যা সেখানে ছিল না তা রোপণ করেছি। মানুষ এবং পশুদের প্রয়োজনের জন্য গাছ লাগানো হয়েছে, কূপ খনন করা হয়েছে। ”
রোমিলা থাপার সপ্তম স্তম্ভলিপির উল্লেখ করে বলেছেন, " অশোক বলছেন যে রাস্তার ধারে মানুষ এবং পশুদের ছায়া দেবার জন্য বট গাছ লাগানো হয়েছে। প্রতি আট ক্রোশ অন্তর বিশ্রামাগার বানানো হয়েছে। "
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র বলছে, অরণ্য সম্পদ পরিচালনা এবং অরণ্য দেখভালের জন্য একজন সুপারিনটেনডেন্ট থাকতেন। তিনি কর্মচারীদের দিয়ে কর এবং বন সম্পদ সংগ্রহ করতেন, দুর্যোগ ছাড়া অন্য সময়ে বনজ সম্পদের ক্ষতি করলে জরিমানা এবং ক্ষতিপূরণ আদায় করতেন। অরণ্য সংরক্ষণ করা হতো এবং বন আইন তৈরি করা হয়েছিল।
অশোকের পঞ্চম স্তম্ভ লিপিতে পাওয়া যায়— কিছু পশুদের নামের তালিকা যাদের কোনোভাবেই হত্যা করা যাবে না। আরও একটা লেখায় কিছু পশুদের নাম আছে যাদের নির্দিষ্ট দিন ছাড়া হত্যা করা যাবে না। শেষে আছে আর একটা চতুষ্পদ প্রাণীদের তালিকা, যারা খাবার যোগ্য নয় এবং কাজেও লাগেনা তাদের হত্যা করা যাবে না অর্থাৎ অনর্থক পশুহত্যা চলবে না।
যৌথ মালিকানায় অরণ্য
অশোকের সময়ের মতো এতটা সুগঠিত অরণ্য ব্যবস্থাপনা পাওয়া না গেলেও ভারতের ক্ষেত্রে অরণ্য ছিল যৌথ মালিকানায়— রাজা মালিক আর অরণ্য নির্ভর আদিবাসী মানুষ যারা অরণ্যের পরিচর্যা, অরণ্য রক্ষা এবং অরণ্য সম্পদের ব্যবহারের অধিকারী ছিল। অরণ্যকে ভিত্তি করেই ছিল সেই মানুষদের আর্থিক সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবন। সেই মানুষ ঈশ্বরের দান হিসাবে অরণ্যকে গ্রহণ করত, তাদের পরিচর্যায় অরণ্য ছিল নিরাপদ, অরণ্যই তাদের সমাজ জীবনের কাঠামো নির্মাণ করে দিত। প্রতিষ্ঠিত ছিল যৌথ মালিকানা— মানুষের অরণ্যের অধিকার ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। অরণ্যে মানুষ শিকার করতো, পশুচারণ করতো, নদীতে মাছ ধরত, মধু মোম মাশরুম সাল কেন্দু পাতা, রেশম গুটি, বাঁশের কঞ্চি, সাবুই ঘাস সংগ্রহ করত।
ইংরেজ আমলে অরণ্য— পরিবেশের সর্বনাশ
ইংরেজরা এসে অরণ্যকে ঘিরে এই আর্থ-সামাজিক এবং নিবিড় আন্তর্সম্পর্কটি ভেঙে দিয়েছিল। ধ্বংস করেছিল পরিবেশ এবং চিরায়ত কৃষি ব্যবস্থা। হরণ করে নিয়েছিল আদিবাসী মানুষের চিরায়ত জঙ্গলের অধিকার
ইংরেজের কাছে মানুষের অধিকার, ভূমিক্ষয়, সার্বিক পরিবেশের থেকে রাজস্ব আদায় অনেক বেশি মূল্যবান ছিল। অরণ্য সাফ করে কৃষির সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়, বাণিজ্য পরিবহণের জন্য রেলের সম্প্রসারণ, বাষ্পীয় ইঞ্জিন চালানোর জ্বালানি, রেলওয়ে স্লিপার, রয়েল নেভির জাহাজ নির্মাণ এবং আসবাবপত্রের জন্য বিপুল পরিমাণে যে কাঠের প্রয়োজন, তার জন্য ভারতের জঙ্গল সাফ হতে লাগল। যখন তাদের নিজেদের দেশে ওক অরণ্য অদৃশ্য হতে শুরু করলো ভারত থেকে সুবিশাল পরিমাণ কাঠ ইংল্যান্ডে রপ্তানি করা হয়। বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম ইংরেজ আসার আগে জঙ্গলাকীর্ণ ছিল— রাজস্ব এবং কাঠের লোভ ছিল এই জঙ্গল সাফ করার চালিকাশক্তি। ফলে বোলপুরের মাটি নগ্ন হয়ে ডাঙার কঙ্কালে পরিণত হয়েছিল— যা রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন।
যৌথ মালিকানায় অরণ্যকে ইংরেজ কবজা করেছিল নিজ স্বার্থে, হরণ করেছিল আদিবাসী মানুষের জঙ্গলের অধিকার। অরণ্যকে তারা রাজস্ব আদায়ের যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছিল— তাই তারা অরণ্য বলতে খাজনার জন্য কৃষি জমি এবং বাণিজ্য-পরিবহণের জন্য কাঠ বুঝতো। অরণ্য ছিল তাদের কাছে সোনার খনির মতো— তাই জঙ্গলের ওপর একচেটিয়া দখল কায়েম করার প্রয়োজন ছিল তাদের। এই প্রেক্ষাপটেই লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৫ সালের ৩ আগস্ট 'বন নীতি ' ঘোষণা করেন। ১৮৬৫ সালে ভারতীয় বন আইন তৈরি হয় - ১৮৮৭ এবং ১৯২৭ সালে তা সংশোধিত হয়।
স্বাধীনতার পরেও ঔপনিবেশিক নীতিই রয়ে গেলো
ইংরেজ আমলে অরণ্য নীতি ছিল অরণ্যের ওপর নিরঙ্কুশ দখল কায়েম করা এবং আদিবাসী মানুষের জঙ্গলের অধিকার হরণ করে তাদের অরণ্য থেকে উচ্ছেদ করা।
ইংরেজ চলে গেল, দেশ স্বাধীন হলো কিন্তু নীতিতে পরিবর্তন হলো কি? না হলো না। স্বাধীন ভারতে রাষ্ট্র দখল নিল অরণ্যের, নিজ দেশের আদিবাসী জনগণের অরণ্যের অধিকার হরণ ক'রে তাদের কার্যত অরণ্য থেকে উচ্ছেদ করা হতে থাকলো।
স্বাধীন ভারতে ১৯৮০ সালে ১৯২৭ সালের আঙ্গিকেই বন আইন তৈরি হলো— এর পরিবর্তন হলো ২০০৬ সালে, যা অরণ্যের অধিকার আইন বলেই পরিচিত। এই প্রথম আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার আইনগত স্বীকৃতি পেল, অরণ্য আবার তার রক্ষকদের ফিরে পেল। তাদের বাসস্থানের অধিকার, পশুচারণ, মাছ ধরা, কাঠ ব্যতীত অরণ্য সম্পদের এমনকি সরকারের কাঠ বিক্রির একটা অংশের অধিকারও স্বীকৃতি পেল। স্বীকৃতি পেল অরণ্যের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের অধিকার। জঙ্গল কাটতে হলে তাদের মতামত নিয়েই কাটতে হবে নিশ্চিত হলো সেটাও। রক্ষা পেল পরিবেশ।
কিন্তু না, জঙ্গলের রক্ষকদের পাহাড়ায় রাখা যাবে না, তাই আবার আইনি সংশোধন— আবার অধিকার হরণ, আবার বাস্তুতন্ত্রের অবক্ষয়। অসহায় পরিবেশ।
আইনের সংশোধন কার স্বার্থে
২০০২ এর আইন সংশোধন ক'রে জৈব বৈচিত্র (সংশোধিত) আইন ২০২৩ তৈরি করা হলো। এতে অরণ্যের জৈব বৈচিত্রের বিপুল সম্পদের বাণিজ্যিকীকরণের পথ সুগম হলো, ভেষজ, ইউনানি ইত্যাদি চিকিৎসা ও গবেষণার নামে জৈব বৈচিত্রের সুবিধা ও ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত করা হলো। এ বিষয়ে ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের অধিকারী অরণ্যবাসী আদিবাসীদের সুবিধা ভাগাভাগির যে অধিকার স্বীকৃত ছিল, তাকে অস্বীকার করে তাদের ন্যায় সঙ্গত পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হলো। এতে অরণ্যের জৈব বৈচিত্রের প্রভূত ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী। বানিজ্যের স্বার্থেই অরণ্যকে ব্যবহার করা হলো।
বন (সংরক্ষণ) সংশোধিত আইন ২০২৩— অরণ্যবাসী আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার আইন ২০০৬ কে বন্ধ্যা ক'রে দিল— তাদের মতামত এড়িয়েই জঙ্গল সাফ করার ব্যবস্থা করা হলো। এতে খনির নামে নির্বিচারে জঙ্গল সাফ করার পথ সুগম হলো।
অরণ্য নিয়ে ঔপনিবেশিক ইংরেজদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতির ঘেরাটোপেই আবার ফিরে গেল স্বাধীন ভারতের বন আইন এবং বীশ্ববিক্ষা।
হাসদেও অরণ্যের করুণ কাহিনি
এতসব আইন সংশোধনের মাধ্যমে আদতে অরণ্যকে বাণিজ্যিক স্বার্থে কর্পোরেটদের উপহার দেওয়ার যে বন্দোবস্ত তা চাক্ষুষ হচ্ছে ছত্তিশগড়ের জৈব বৈচিত্রে ভরপুর হাসদেও অরণ্যে কোল ব্লক বণ্টনে। রাজস্থান রাজ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন নিগমের নামে, কয়লা উত্তোলনের বরাত পেয়েছে আদানি গোষ্ঠী— এখনও পর্যন্ত ৩০০০০ গাছ কাটা হয়েছে, আরও ২৫০০০ গাছ কাটা হবে। ১০০ বছর ধরে হাসদেও জঙ্গলকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করে এসেছে অরণ্যবাসী মানুষ। নিবিড় শাল মহুয়ার জঙ্গলে হাতি, ভালুক, সরীসৃপের আবাসভূমি। ৭০০ পরিবারের জীবন-জীবিকা সমস্যার মুখে। এমনিতেই আবাসস্থলের সঙ্কোচনে হাতিরা লোকালয়ে চলে আসে সূত্রপাত হয় ' ম্যান - অ্যানিম্যাল কনফ্লিক্ট ' - ইতিমধ্যে ২৭ টি হাতি করিডর ছেড়ে জাতীয় সড়কে উঠে পড়তে বাধ্য হয়েছ। হাসদেও অরণ্য বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতি লড়াই করছে সেখানে— সারা দেশে আলোড়ন পড়েছে, প্রতিবাদ হচ্ছে।
সাফ হচ্ছে জঙ্গল তবুও বাড়ছে নাকি অরণ্য!
সারাদেশে কোথাও খনির জন্য, কোথাও বাড়ি ঘর হোটেলের জন্য, কোথাওবা সড়ক সম্প্রসারণ, বৃহৎ নদীবাঁধ, কৃষিক্ষেত্রের জন্য অরণ্য নিধন চলছে ; যদি এটাই বাস্তব হয় তাহলে দেশের অরণ্য তো কমার কথা কিন্তু ফরেস্ট সার্ভে অব ইন্ডিয়া তাদের ২০২১ র শেষ প্রতিবেদনে জানায় যে দেশে অরণ্যের আচ্ছাদন ৭,১৩,৭৮৯ বর্গ কিলোমিটার যা দেশের ভৌগোলিক আয়তনের ২১.৭১%। তারা বলে ২০১৯-২০২১ এ দেশের অরণ্য আচ্ছাদন ১৫৪০ বর্গ কিলোমিটার বেড়েছে।
এদিকে 'গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ'এর প্রতিবেদন বলছে ঠিক উল্টো কথা। তারা বলছে - ভারতে ২০০০-২০২৩ সাল পর্যন্ত ২.৩৩ মিলিয়ন হেক্টর বৃক্ষের আচ্ছাদন কমেছে। মাননীয় ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের প্রতিবেদনকে স্বীকৃতি দিয়ে নিজেই ' স্যুয়ো মোটো ' মামলা গ্রহণ করেছে এবং পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক তথা ভারত সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে যে— কেন ভারতের বৃক্ষ আচ্ছাদন ২.৩৩ মিলিয়ন হেক্টর কমে গেল। আমরা সাগ্রহে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যনালের রায়ের প্রতীক্ষায় থাকবো।
উন্নয়নের নামে ঘটে চলা ব্যাপক অরণ্য নিধন, বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশের চরম অবক্ষয় ঢাকবার কৌশলী অপপ্রয়াস চলছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই এবারের অরণ্য সপ্তাহ। লাখো মানুষের উদ্ভিদ চারা রোপণের উৎসব। বনমহোৎসবে শামিল হওয়া লাখো মানুষ একদিন সার্বিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বাস্তুতন্ত্র-পরিবেশ সঙ্কটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হবেন, এটাই সময়ে দাবি।
Comments :0