SITARAM YECHURY

নবরত্ন’র চোখে পড়েছিল সীতারামের গুণাবলি

উত্তর সম্পাদকীয়​

নীলোৎপল বসু

প্রায় ৪০ বছরের সম্পর্ক ছিল আমার সঙ্গে। আমি ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে এসএফআই সর্বভারতীয় কেন্দ্রে কাজ করতে আসি। এর আগেও নিশ্চয়ই পরিচয় ছিল আমার সাথে, কারণ সীতারাম ছিলেন এসএফআই’র সর্বভারতীয় সভাপতি। কিন্তু খুব অল্প বয়সেই কমরেড সীতারাম পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলী সদস্য হয়ে যান, ফলে আমি যখন কাজে যোগ দিই তখন পার্টিগত ভাবে সীতারাম ইয়েচুরি ছাত্র ফ্রন্টের দায়িত্বে ছিলেন। আসলে কমরেড সীতারাম মাত্র ৩৫ বছর বয়সেই পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমাদের পার্টিতে নেতৃত্বের তখন যে বয়স ছিল, তাঁরা সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তুলনামূলকভাবে নতুন প্রজন্মের কমরেডদের নেতৃত্বে তুলে আনবেন। সেই সূত্রেই কমরেড সীতারামের উত্থান। আমাদের পার্টির নবরত্নের অনেকেই তখন পার্টির সর্বভারতীয় কেন্দ্র থেকে পার্টি পরিচালনা করতেন। স্বভাবতই এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কমরেড সীতারামের কিছু বিশেষ গুণ ও প্রতিভা ইতিমধ্যেই তাঁদের সবার কাছে ধরা পড়েছিল। আসলে সীতারাম জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের তিনবারের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। ছাত্র আন্দোলনে তিনি দ্রুত নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। তার সম্পাদনায় এসএফআই মুখপত্র স্টুডেন্ট স্ট্রাগল হয়ে ওঠে একটি খুবই উন্নত মানের পত্রিকা। তাঁর লেখা ও বলার অদ্ভুত আকর্ষণীয় ক্ষমতা পার্টি নেতৃত্বের কাছেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। পার্টি ও আন্দোলনের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করার জন্য নেতৃত্বের সুদূরপ্রসারী ভাবনা ছিল। ফলে তাঁদের জহুরীর চোখ আরও কয়েকজন তরুণ কমরেড সহ সীতারামকে সঠিকভাবেই সামনে সারিতে তুলে এনেছিল। 
আমি দিল্লিতে আসার পর যখন প্রথম এসএফআই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অংশ হিসাবে কাজ শুরু করি, তখন সেই কাজে প্রত্যক্ষভাবেই কমরেড সীতারামের নেতৃত্বে আমার শিক্ষানবিশির শুরু।
তারপর প্রায় দীর্ঘ সাত বছর প্রত্যক্ষভাবে এসএফআই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অংশ হিসাবে যুক্ত ছিলাম। পার্টির পক্ষ থেকে তখন দায়িত্বে ছিলেন কমরেড সীতারাম। এই সময় ঘনিষ্ঠভাবে একসঙ্গে কাজ করার মধ্য দিয়ে ওনার গুণাবলী খুব কাছ থেকে দেখা ও অনুভব করবার সুযোগ হয়েছিল আমার। 
কমরেড সীতারামের আকস্মিক মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে আমাদের পার্টির ও আন্দোলনের পক্ষে যে অপরিসীম ক্ষতি করেছে তাই শুধু নয়, দেশের গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির মধ্যেও একটি প্রবল অভাববোধ সৃষ্টি করেছে।
তাঁর মৃত্যুর পর এই চোদ্দ-পনেরো দিনেই যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া এবং আলাপ আলোচনা হচ্ছে তার মধ্যে দিয়েই তাঁর ব্যক্তিত্ব ও কর্মজীবনের অবদান কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেই সম্পর্কেও একটা ধারণা তৈরি করে দিচ্ছে। কয়েকদিন আগে একটি ইউটিউব পোর্টালের আলোচনার শীর্ষক ছিল সীতারামের মৃত্যু এবং বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরবর্তীতেই পার্টির এবং বামপন্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে অসংখ্যবার এই প্রশ্ন আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে, আর বিভিন্ন সময় পার্টির অন্যতম প্রধান মুখপাত্র হয়ে সীতারাম বোধহয় ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে বেশি এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। কাজেই এই প্রশ্নের জবাব দিতেও আমাদের সীতারামের কাছেই বারবার ফিরে যেতে হবে। 
আদর্শে দৃঢ়, মতাদর্শগত বিশ্লেষণে স্পষ্ট এবং তত্ত্বের সাথে অনুশীলনের সংমিশ্রণে যে মার্কসবাদী লেনিনবাদী ধারা, তার অনন্য অনুসরণকারী ছিলেন সীতারাম। তার ব্যাখ্যা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। সিপিআই(এম) বা বামপন্থীদের বিচার করবার মাপকাঠি সবদিক থেকেই আর পাঁচটা রাজনৈতিক দলের থেকে আলাদা হতে বাধ্য। সিপিআই(এম) এবং বামপন্থীরা তাদের উপস্থিতি সংসদের বাইরে গণসংগ্রামের মধ্য দিয়েও নিশ্চিত করে। সুতরাং আমাদের ভূমিকা, অংশগ্রহণ এবং প্রভাবকে শুধুমাত্র সাংসদ সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। আনন্দের কথা যে বারবার বলার মধ্য দিয়ে এই বক্তব্য বামপন্থী মহলের বাইরেও বৃহত্তর গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে বেশ কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা  অর্জন করেছে। 
আমরা আজ রাজনীতির যে পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তার আগে বামপন্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা জাতীয়স্তরে অনুভূত হয়েছিল বিশেষভাবে দু’বার। প্রথমবার সত্তর দশকে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আর দ্বিতীয়বার আশির দশকের শুরুতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির বিরুদ্ধে দেশের ঐক্য ও সংহতির লড়াইতে। অনেক আত্মত্যাগও এই দুটি পর্যায়ে আমাদের করতে হয়েছে। কমরেড সীতারাম ছিলেন এই দুই লড়াইয়ে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম। 
এই মরণপণ রাজনৈতিক লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা দারুণভাবে আত্মস্থ করেছিলেন তিনি। বামপন্থীদের বাইরের ব্যাপকতর অংশকে সমবেত করবার  যে বোঝাপড়া, তার দীর্ঘ অনুশীলনের মধ্যে দিয়েই গ্রহণযোগ্য নেতা হিসাবে পরিণত হয়েছিলেন আজকের কমরেড সীতারাম। তত্ত্ব এবং তার অনুশীলনে প্রগাঢ়ভাবে বিশ্বাসী কমরেড সীতারাম ছিলেন একজন পরিপূর্ণ মার্কসবাদী-লেনিনবাদী।
আমাদের পার্টি এবং বামপন্থীদের কাছে আজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন সীতারাম। এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলাই তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলীকে সামনে তুলে এনেছে। আশির দশকে বিশ্বায়ন এবং নয়া উদারবাদের উত্থান। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের  সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির পিছু হটার পটভূমিতে পৃথিবী জুড়ে উগ্র দক্ষিণপন্থার প্রাদুর্ভাব। আমাদের দেশের মাটিতে এই নতুন চ্যালেঞ্জের বর্শাফলক হিন্দুত্ব এবং তার চালিকা শক্তি আরএসএস প্রায় আট দশকের ব্যবধান পেরিয়ে আজ ভয়ঙ্কর। ১৯৯২ সালে ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে এই নতুন বিপদের হিংস্রতা আরও স্পষ্ট হয়েছে। 
আমার সঙ্গে কমরেড সীতারামের ঘনিষ্ঠতার জন্যই আমার এই ধারণা স্পষ্ট হয়েছে যে, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরাধিকারকে ছিন্নভিন্ন করে দেবার চেষ্টা করছে। এই পরিস্থিতি অভূতপূর্ব এক বিপর্যয়ের পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। কমরেড সীতারামের এই বোঝাপড়া তৈরির ক্ষেত্রে কমরেড জ্যোতি বসু  ও কমরেড হরকিষেণ সিং সুরজিতের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। ঘটনাচক্রে এই দু’জনেরই রাজনৈতিক কাজের জায়গা ছিল ওই বিভাজনের রাজনীতির প্রধান শিকার। বাংলা এবং পাঞ্জাব– দুই রাজ্যই দেশভাগের ঘটনায় ভুক্তভোগী। কাজেই কমরেড জ্যোতি বসু ও কমরেড সুরজিত ছিলেন এই অভিজ্ঞতার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সাক্ষী। 
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর আমদের যে নতুন বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তা হলো, হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জকে তাত্ত্বিকভাবে মোকাবিলা করা। ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয় সীতারামের একটি পুস্তিকা- 'এই হিন্দু রাষ্ট্র কি?'। আরএসএস’র প্রথম যুগের এবং সব মিলিয়ে প্রধান তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রকাশিত হয়েছিল গোলওয়াকারের 'উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড' বইয়ে। এই তত্ত্বের থেকে এটা স্পষ্ট যে, এর প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে বিকাশমান শক্তিশালী স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে গড়ে ওঠা ভারতীয় জনগণের ঐক্যকে বিভক্ত করা। এটা করতে গিয়ে গোলওয়াকার স্পষ্টতই ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতার ঐতিহাসিক ভিত্তিটিকে সম্পূর্ণভাবে বিকৃত করেন। 
মার্কসবাদী হবার সূত্রেই সীতারাম জানতেন যে, হিন্দুত্ব বা আরএসএস’র মতাদর্শের এই মূল উপাদানটিকে সম্পূর্ণভাব অনাবৃত করাই হবে আগামী দিনগুলোয় বামপন্থীদের মতাদর্শগত চ্যালেঞ্জ। কমরেড সীতারাম বারবার উল্লেখ করেছেন, দেশ কাল সময় নির্বিশেষে 'নির্দিষ্ট পরিস্থিতির নির্দিষ্ট বিশ্লেষণ'ই মার্কসবাদী দ্বন্দ্বতত্ত্বের প্রধান উপাদান। কমরেড সীতারাম বুঝেছিলেন, গোলওয়াকারের তত্ত্ব খণ্ডনে প্রধান বৈশিষ্ট্য হতে হবে সমাজ সভ্যতা এবং ইতিহাসের বিশ্লেষণের আলোতেই।
সীতারামের এই লেখাটি এতই কার্যকরী ছিল যে, নানা সময়ে আরএএসএস’র পক্ষ থেকে সীতারামকে খণ্ডন করে এবং আক্রমণ করার জন্য তাত্ত্বিক পালটা যুক্তির বদলে, তারা সীতারামের লেখার তথ্য নিয়ে মিথ্যাচার করে গেছে। কিন্তু সীতারামের লেখার গভীর সত্যান্বেষণ শেষ পর্যন্ত তাদের রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য করেছিল।
হিন্দুত্বের প্রকৃত চেহারা উন্মোচনের মধ্য দিয়ে, ওদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে স্পষ্ট করে দেন সীতারাম তাঁর লেখায়। হিন্দু ধর্মের বহুত্ববাদী দার্শনিক চরিত্রের বদলে ব্রাক্ষণ্যবাদী ব্যবস্থায় সামাজিক বৈষম্য যে আসলে হিন্দু ধর্মের প্রকৃত ঐতিহ্যের পরিপন্থী, তাও স্পষ্ট করেন সীতারাম তাঁর লেখনীতে। এরসঙ্গে রাজনৈতিক শাসনের যে কাঠামোটি গোলওয়াকার হাজির করেন, সেটাও যে ইতালীয় ও জার্মান ফ্যাসিবাদের অনুপ্রেরণায়, তাও স্পষ্ট হয়ে যায় সীতারামের ওই লেখার বিশ্লেষণের মাধ্যমে। 
পরবর্তীতে সময় যত এগিয়েছে, বিশেষ করে বিজেপি’র শাসন পরিচালনাকালে, আরএসএস’র এই মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি বারেবারে সামনে চলে এসেছে। আর এর বিপরীতে আমাদের পার্টির সমসাময়িক আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পার্টির কর্মসূচিতেও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, বিজেপি ভারতের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি থেকে চরিত্রগতভাবে একেবারেই আলাদা। কারণ আরএসএস-ই তাদের পরিচালনা করে।
ঘনিষ্ঠ  সম্পর্কের কারণেই কমরেড সীতারামের কাজকর্মের ধারা সম্পর্কে দু’-তিনটি অন্য প্রসঙ্গেরও উল্লেখ করা জরুরি। কমরেড সীতারাম অন্য কোনও গ্রহের জীব ছিলেন না। একজন মার্কসবাদী লেনিনবাদী হিসাবেই তিনি বুঝেছিলেন যে, ভারতে হিন্দুত্বের এই অভিযান সামগ্রিকভাবে পৃথিবী জুড়ে উগ্র দক্ষিণপন্থার উত্থানেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। অর্থনীতির মেধাবী ছাত্র  হওয়ার সুবাদে সীতারাম বিশ্বায়ন এবং নয়া উদারবাদের আত্মপ্রকাশে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির ভূমিকা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। পাশাপাশি দীর্ঘদিন পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রধান হিসাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজনীতি এবং কমিউনিস্ট ও অন্যান্য প্রগতিশীল আন্দোলন সম্পর্কে প্রগাঢ় জ্ঞান তাঁকে উগ্র দক্ষিণপন্থার বহুমাত্রিক উপাদানগুলিকে বুঝতে সাহায্য করেছিল। সুতরাং আমাদের পার্টিতে যখন সোভিয়েত পরবর্তী দুনিয়ায় আমাদের মতাদর্শগত স্পষ্ট অবস্থান ঘোষণা করবার প্রশ্ন উঠলো, আমাদের পার্টির চতুর্দশ কংগ্রেসে তখন কমরেড সীতারামই পার্টির পলিট ব্যুরোর পক্ষ থেকে সেই খসড়া উপস্থিত করেন। পরবর্তীতেও মতাদর্শগত প্রশ্নে পার্টির দলিল তৈরির কাজে কমরেড সীতারামের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আসলে দেশ বিদেশে তত্ত্ব ও তার প্রয়োগে এবং বিভিন্ন পরিস্থিতির সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবিক জ্ঞান তাঁকে সাহায্য করেছিল এই পরিবর্তনগুলির তাত্ত্বিক ভিত্তিকে উপলব্ধি করার ও তাকে পালটাবার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার। 
দেশের মধ্যে পার্টি এবং বামপন্থীদের যে দায়িত্ব নির্দিষ্টভাবে পালন করা দরকার, তার একটি অপরিহার্য অংশ ছিল সমমনোভাবাপন্ন শক্তিগুলিকে একটি গ্রহণযোগ্য ন্যূনতম বোঝাপড়ার ভিত্তিতে একত্র করা। এই কাজও কমরেড সীতারাম আয়ত্ত করেছিলেন কমরেড সুরজিতের কাছে শিক্ষানবিশ হিসাবে। ১৯৯৬ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার এবং পরবর্তিতে ২০০৪ সালে প্রথম ইউপিএ সরকারের পরিচালনার জন্য ন্যূনতম কর্মসূচি তৈরিতেও কমরেড সীতারামের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গভীর বোঝাপড়া এবং অনুশীলনের মাধ্যমেই শাণিত হয়েছেন কমরেড সীতারাম। তারই প্রতিফলন ঘটেছে ইন্ডিয়া মঞ্চ গঠনে। তাঁর একটা সহজাত প্রতিভা ছিল— বিভিন্ন ভিন্নমুখী মতামতকে আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান করে একটি সার্বিক গ্রহণযোগ্যতায় নিয়ে আসা এবং সেই ঐকমত্যকে একটি খসড়াতে রূপ দেওয়া। সীতারামের মৃত্যুর আকস্মিকতায় বৃহত্তর রাজনৈতিক শক্তিগুলির মধ্যেও অভাববোধ তৈরি হয়েছে। 
কারোর পক্ষেই সীতারামের এই আকস্মিক প্রয়াণের ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তাকে অস্বীকার করবার সুযোগ নেই। 
কমরেড সীতারাম ছিলেন বলিষ্ঠ আশাবাদী। চূড়ান্ত সঙ্কটের মুখেও তিনি ভেঙে পড়তেন না। ২০১৪ সালের পরে এবং বিশেষ করে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রায় আসুরিক শক্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশের পরেও কমরেড সীতারাম গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে, সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং চূড়ান্ত স্বৈরাচারী আক্রমণের মধ্য দিয়ে দেশে ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের যে প্রবল বিপদ তৈরি হয়েছে, হিন্দুত্ববাদের মধ্যে ফ্যাসিবাদের স্পষ্ট প্রবণতার জন্যই তা চিরস্থায়ী হতে পারে না– ওরা অজেয় নয়। ভারতীয় সংবিধানের রক্ষার সংগ্রামে ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণই হবে এক্ষেত্রে আমাদের পথ। সুতরাং কমরেড সীতারামের আনুষ্ঠানিক অনুপস্থিতির মধ্যেও বহুমুখী সংগ্রামগুলিকে সামগ্রিক মতাদর্শগত পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালনা করবার মাধ্যমেই হতে পারে কমরেড সীতারামকে শ্রদ্ধা জানাবার সঠিক প্রয়াস।  

কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি লাল সেলাম।।
কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি দীর্ঘজীবি হোন।।
 

Comments :0

Login to leave a comment