সংবিধানের প্রস্তাবনায় জ্বল জ্বল করা দু’টি শব্দ ‘সমাজতান্ত্রিক’ এবং ধর্মনিরপেক্ষ’ নিয়ে আরএসএস-বিজেপি’র যত গাত্রদাহই থুকুক না কেন সেগুলি যে সংবিধানের মৌলিক চরিত্রেরই দ্যোতনা তা স্পষ্ট করে দিয়েছে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ। হিন্দুত্ববাদের ওপর ভিত্তি করে ধর্মীয় সংখ্যা গুরু হিন্দুদের নিয়ে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর ঘোষিত লক্ষ্য আরএসএস-বিজেপি’র। নানা ধর্ম-বর্ণ-জাত-ভাষা-সংস্কৃতির পারস্পরিক সহাবস্থানে তৈরি ভারতের বহুত্ববাদী সমাজ অনুবাদী আরএসএস’র দু’চক্ষের বিষ। আরএসএস’র রাজনৈতিক শাখা হিন্দু মহাসভা, জনসঙ্ঘ হয়ে আজকের বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত সংবিধানকেই কার্যত অস্বীকার করত। জাতীয় পতাকারও তারা বিরোধিতা করেছিল। এখন ক্ষমতাসীন হবার ফলে প্রকাশ্যে আর সেসব বলতে পারছে না। তবে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর এবং সেই অনুযায়ী সংবিধানকে বদলে ফেলার আদর্শগত অবস্থান থেকে তারা সরে আসেনি। তাই পরিস্থিতির চাপে এই সংবিধানকে গিলতে বাধ্য হলেও তাদের আসল লক্ষ্য সংবিধান বদলে ফেলা এবং ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানিয়ে মনুবাদের পশ্চাৎপদতায় ভারতীয় সমাজকে আবদ্ধ করা।
আরএসএস-বিজেপি রাজনৈতিকভাবে ধর্মীয় ফ্যাসিস্ত চরিত্রের অতি দক্ষিণপন্থী বুর্জোয়া দল। সামাজিকভাবে ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, ব্রাহ্মণ্যবাদী তথা মনুবাদী দল। তাই রাজনৈতিক মতাদর্শে তাদের সবচেয়ে শত্রু বামপন্থী তথা কমিউনিস্টরা। তাদের এই মৌলিক অবস্থানের কথা মাঝে মধ্যে তারা স্মরণ করিয়ে। বামপন্থী মতাদর্শের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যেহেতু জড়িয়ে আছে সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা তাই এই শব্দ দু’টির ঘোরতর বিরোধী তারা। সংবিধানের প্রস্তাবনায় শব্দ দু’টির উজ্জ্বল উপস্থিতি তাই তাদের গাত্রদাহের প্রধান কারণ। যেভাবেই হোক শব্দ দু’টি উপড়ে ফেলতে তারা মরিয়া। কিন্তু সেটা করার মতো শক্তি বা জনসমর্থন তাদের নেই। আইনি পথে শব্দ দু’টি সরাতে তার বহুকাল ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এটা ঠিক ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর যে সংবিধান গৃহীত হয় গণপরিষদে তাতে এই শব্দ দুটি ছিল। জরুরি অবস্থার সময় ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনের সময় শব্দ দু’টি যুক্ত হয়। এই যুক্তি খাড়া করেই হিন্দুত্ববাদীরা সুপ্রিম কোর্টে একাধিক আবেদন জানায়। সব আবেদন এক করে শুনানির পর রায় দেয় সর্বোচ্চ আদালত। তাতে পরিষ্কার করে দেওয়া হয় সংবিধানের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে ধর্মনিরপেক্ষতার সুর। ভারত রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম নেই। সব ধর্মের মানুষের স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণের সমানাধিকার রয়েছে। কেউ কারো ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করতে পারে না। সংবিধানের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের অর্থই ধর্মনিপেক্ষতা। তাই প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের মৌলিক চরিত্রকেই বাঙ্ময় করেছে। তেমনি সমাজতান্ত্রিক কথার অর্থ অর্থনৈতিক নীতি বা কাঠামোকে নির্দিষ্ট করে না। বরং জনকল্যাণকর নীতি বা ব্যবস্থাকেই তুলে ধরে। সমাজতান্ত্রিক শব্দে বেসরকারি ব্যবসা বা ব্যক্তিগত মালিকানায় কোনও বাধা নেই। ধর্ম-বর্ণ-জাত নির্বিশেষে সকল নাগরিককে সমান চোখে দেখা এবং সকলের জন্য সমান সুযোগের ব্যবস্থা করাই সমাজতান্ত্রিক শব্দের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠছে। অতএব শব্দ দু’টি সংবিধানের মৌলিক চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
Seculari and Socialist
ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্র সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ
×
Comments :0