Post editorial

রাজ্য বাজেট ২০২৫ উৎপাদন আয় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি কোথায়?

উত্তর সম্পাদকীয়​

প্রসেনজিৎ বসু
সৌম্যদীপ বিশ্বাস 


গত ১২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের রাজ্য বাজেট পেশ করা হয়েছে। আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনের আগে এটাই শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। স্বাভাবিক ভাবেই বাজেটের বক্তৃতা এবং নীতির অভিমুখ বিধানসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখেই ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এমন কিছু দাবি করা হয়েছে যা বাস্তবসম্মত তো নয়ই, বরং জনগণকে বিভ্রান্ত করার শামিল।  
কেন্দ্রের মোদী সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয় স্তরের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি এবং তার বৃদ্ধির হারকে অতিরঞ্জিত করে দেখানোর অভিযোগ উঠছে বেশ কয়েক বছর যাবৎ। শুধু বিরোধীরা নন, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাক্তন অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা সহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা কোভিড অতিমারীর পরবর্তী সময়ে এই প্রবণতার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার অতিরঞ্জিত করলে সরকারের বিভিন্ন খাতে খরচ, রাজস্ব আদায়, বাজেট ঘাটতি এবং ঋণের হিসেবটাই এলোমেলো হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক হিসেব যে ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে তার সঙ্কেত পাওয়া গেছে কেন্দ্রীয় বাজেটে চলতি অর্থবর্ষের মূলধনী খাতে এবং বিভিন্ন জনকল্যাণ প্রকল্পে ব্যয়বরাদ্দ কাটছাঁট করার থেকে। এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলিকে যে কর রাজস্বের ভাগ এবং অনুদান দেয় তাতেও টান পড়েছে।  
যেটা আরও দুশ্চিন্তার বিষয়, রাজ্য সরকার কেন্দ্রের এই অবিমৃশ্যকারিতা থেকে সঠিক শিক্ষা না নিয়ে নিজেরাও রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিএসডিপি এবং তার বৃদ্ধির হার নিয়ে অতিরঞ্জিত আখ্যান এবং অতিরিক্ত আশাবাদী পূর্বানুমানের খেলায় মেতে উঠেছেন। গত অর্থবর্ষে (২০২৩-২৪) রাজ্যের জিএসডিপি বৃদ্ধির হার ৭.৬ শতাংশ হতে চলেছে বলে জানানো হয়েছিল গত বাজেটে। এই বছরের বাজেটে জানানো হয়েছে যে সেই বৃদ্ধির হার আদতে হয়েছে ৬ শতাংশ। ওই অর্থবর্ষে জাতীয় জিডিপি-র বৃদ্ধির হার ছিল ৮.২ শতাংশ, অর্থাৎ রাজ্যের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার সব রাজ্যের সম্মিলিত অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারের তুলনায় কম ছিল ২ শতাংশ বিন্দুর বেশি। 
জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর আগেই জানিয়েছে যে চলতি অর্থবর্ষে (২০২৪-২৫) জাতীয় জিডিপি-র বৃদ্ধির হার আগের থেকে কমে ৬.৪ শতাংশ হতে চলেছে। সেখানে রাজ্য বাজেটে ২০২৪-২৫-এ পশ্চিমবঙ্গের জিএসডিপি বৃদ্ধির হার ৬.৮ শতাংশ হওয়ার পূর্বানুমান দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ রাজ্য অর্থমন্ত্রকের ধারণা যে সারা দেশে যখন অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গতি কমে আসছে তখন পশ্চিমবঙ্গে সেই গতি বৃদ্ধি পাবে। এই পূর্বানুমান কতটা যুক্তিসঙ্গত?  

                       

সরকারি পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে যে কোভিড অতিমারীর সময় থেকে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির বৃদ্ধির গতি আগের থেকে শ্লথ হয়ে গেছে। ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪, এই পাঁচ বছরে রাজ্যের জিএসডিপি সহ   কৃষি, শিল্প এবং পরিষেবা ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির গড় বার্ষিক হার আগের পাঁচ বছরের গড়ের তুলনায় অনেকটাই কমে গেছে (সারণি ১ দেখুন)। জাতীয় অর্থনীতিরও বৃদ্ধির গতি অতিমারী পরবর্তী সময়ে  কমেছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার কমেছে আরও বেশি।      
সারণি ১: পশ্চিমবঙ্গে  কৃষি, শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রের মোট উৎপাদন এবং জিএসডিপি বৃদ্ধির গড় বার্ষিক হার(%)


তথ্যসূত্রঃ Handbook of Statistics on Indian States, Reserve Bank of India
বামফ্রন্ট সরকারের শেষ বছরে (২০১০-১১) এবং তৃণমূল কংগ্রেস শাসনের প্রথম বছর (২০১১-১২) পশ্চিমবঙ্গের জিএসডিপি ছিল জাতীয় জিডিপি-র ৬ শতাংশ। রাজ্য অর্থনীতির বৃদ্ধির হার লাগাতার জাতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির হারের তুলনায় কম হতে থাকায় ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গের জিএসডিপি জাতীয় অর্থনীতির ৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। এর থেকেই বোঝা যায় যে দেশের অন্য বেশ কিছু বড় রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। এই সরকারি পরিসংখ্যান রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, বর্তমান ও প্রাক্তন অর্থ মন্ত্রী এবং মন্ত্রকের শীর্ষস্থানীয় আমলাদের অজানা তো হতে পারে না। 
তা সত্ত্বেও এবারের বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, "এই সমস্ত পরিসংখ্যান পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির পুনর্জাগরণকেই নির্দেশ করে"। অর্থ মন্ত্রী যে পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে এই তথাকথিত পুনর্জাগরণের ইঙ্গিত পাচ্ছেন সেগুলি আসলে ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের অতিরঞ্জিত পূর্বানুমান, যা গত বছরের মতনই আবার নেমে আসবে সামনের বাজেটে। নির্বাচনী স্বার্থ চরিতার্থ করতে অতিরঞ্জিত পরিসংখ্যানের ব্যবহার পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার কেবল একাই করছে, তা হয়তো নয়। কিন্তু এর ফলে রাজ্যের অর্থনীতির যে ক্ষতিসাধন হচ্ছে, সেটা রাজ্য সরকার ইচ্ছাকৃত ভাবে আড়াল করার চেষ্টা করছে, যা জনস্বার্থ বিরোধী। 
কোভিড অতিমারীর পর ভারতের জাতীয় এবং রাজ্য স্তরে সর্বত্রই বাজেট ঘাটতি এবং সরকারি ঋণ বেড়েছে। সব সরকারই এখন ঘাটতি কম করতে তৎপর। বাজেট ঘাটতি কম করার দু’টি পন্থা আছে, হয় ব্যয় সঙ্কোচন করা অথবা রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি করা। অনেক সরকার আবার দু’টোই একসাথে করার চেষ্টা করে। কেন্দ্রীয় বাজেটে এবার এক দিকে চলতি বছরে ব্যয় সঙ্কোচন করে অন্যদিকে সামনের অর্থবর্ষে আয়করদাতাদের ১ লক্ষ কোটি টাকার ছাড় ঘোষণা করা হয়েছে, যার সুবিধা মূলত সমাজের বিত্তশালী অংশই পাবে। 
এই প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের বাজেট কি করেছে? চলতি বছরে মূলধনী খাতে বাজেট বরাদ্দ (Capital Expenditure) প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করে, রাজস্ব খাতে বাজেট বরাদ্দ (Revenue Expenditure) ২৬৫০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ করেছে। মূলধনী খাতে ব্যয় সঙ্কোচনের ফলে সরকারি বিনিয়োগ এবং সম্পদ সৃষ্টি ব্যহত হবে, অনেক চালু প্রকল্পে অর্থাভাব দেখা দেবে। রাজস্ব খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির মূল কারণ, ভোটের আগে জনমোহিনী প্রকল্পের নামে খয়রাতিতে ব্যয় বৃদ্ধি। 
রাজ্যের আসল অর্থনৈতিক বৃদ্ধি অতিরঞ্জিত অনুমানের তুলনায় যে কম হচ্ছে তার প্রমাণ, ২০২৪-২৫-এর মোট নিজস্ব রাজস্ব সংগ্রহ বাজেট অনুমানের তুলনায় অন্তত ২৫০০ হাজার কোটি টাকা কম হওয়া। এই সবের নিট ফল ২০২৪-২৫-এর বাজেট ঘাটতি বাজেট অনুমানের ৬৮,২৫০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৭৩,১০৮ কোটি টাকায় পৌঁছে যাওয়া। 
বাজেট ঘাটতি মেটাতেই সরকারকে ঋণ নিতে হয়। ঘাটতি বেড়ে যাওয়া মানে সরকারি ঋণ বেড়ে যাওয়া। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে গত চার বছরে ঠিক সেটাই ঘটছে। রাজ্য সরকার জিএসডিপি-র পূর্বানুমান অতিরঞ্জিত করে, তার ভিত্তিতে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নিয়ে চলেছে। এবং গভীর দুশ্চিন্তার বিষয় হল, রাজ্য সরকারের মোট ঋণ বৃদ্ধির বার্ষিক হার রাজ্যের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারের থেকে বেশি  হয়ে গেছে (সারণি ২)। ঋণ নিয়ে মূলধনী খাতে ব্যয় করা হলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বাড়তে পারতো, কিন্তু মূলধনী খাতে ব্যয় কমিয়ে খয়রাতিতে ব্যয়বৃদ্ধি হচ্ছে বলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারও কমে যাচ্ছে।

 

সারণি ২: পশ্চিমবঙ্গে বাড়ছে ঋণ বৃদ্ধির হার, কমছে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার 
আর্থিক নীতির এই অভিমুখ সকলের কাছেই পরিচিত। অচিরেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঋণের সঙ্কটে পড়বে, এবং তখন বাধ্য হয়ে ব্যয়সঙ্কোচ করতে হবে; লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে সরকারি কর্মচারীদের ডিএ বৃদ্ধি, সবই বন্ধ হয়ে যাবে। 
তৃণমূল কংগ্রেস জমানার জনমোহিনী নীতির নামে খয়রাতি বিতরণের কারণে পশ্চিমবঙ্গের উৎপাদন ব্যবস্থা বিনিয়োগের অভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। পরিসংখ্যান থেকে তার বিভিন্ন সঙ্কেত পাওয়া যাচ্ছে। কৃষিক্ষেত্রে অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটেছে। ধান এবং খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন এবং হেক্টর প্রতি উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গে আর বিশেষ বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে না। তুলনায় উত্তর প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, পাঞ্জাবের মতন রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের থেকে এগিয়ে গেছে। দেশের সংগঠিত শিল্পক্ষেত্রে অনেক আগেই পশ্চিমবঙ্গ পিছনের সারিতে। 
২০২৪ সালে জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে সংগঠিত ক্ষেত্রে মোট বড় শিল্প বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকার, যার মাত্র ১ শতাংশ এসেছে পশ্চিমবঙ্গে। ২০১৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ভারতে আসা মোট বিদেশি বিনিয়োগে পশ্চিমবঙ্গের ভাগ মাত্র ০.৭ শতাংশ, মোট জাতীয় রপ্তানিতে ৩ শতাংশের কম। অথচ পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা জাতীয় জনসংখ্যার ৭ শতাংশ। 
অর্থনীতিতে বিনিয়োগ না বাড়লে, কৃষি, শিল্প, পরিষেবা সমস্ত ক্ষেত্রের উৎপাদন ব্যবস্থাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিনিয়োগ না বাড়িয়ে খয়রাতি বৃদ্ধির রাস্তায় যেভাবে হাঁটছে তাতে অর্থনৈতিক অবনতি এবং ঋণবৃদ্ধি হচ্ছে। এর ফলে রাজ্যে না বাড়ছে কর্মসংস্থান, না বাড়ছে সাধারণ মানুষের আয় এবং জীবনমান। অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণ ঋণ করে খয়রাতি দিয়ে নয়, বিনিয়োগে বাড়িয়ে উৎপাদন, কর্মসংস্থান এবং আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে আসে। অর্থনীতির এই সহজ সত্যটাই রাজ্য সরকার জনগণকে ভুলিয়ে দিতে চাইছে।
 

Comments :0

Login to leave a comment