বেশ কয়েক বছর আগে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তাদের এক গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টে একেবারে তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে স্পষ্ট করে দিয়েছিল, কলকারখানায় ধর্মঘটের জন্য যত শ্রমদিবস নষ্ট হয় তার থেকে অনেক বেশি শ্রমদিবস নষ্ট হয় লে অফ, লক আউট ও সাসপেন্সন অব ওয়ার্কের কারণে। রিপোর্টে এটাও বলে দেওয়া হয়েছিল কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাবার পেছনে ধর্মঘটের ভূমিকা নিতান্তই সামান্য। কলকারখানা বন্ধ হবার প্রধান কারণ মালিকপক্ষের সিদ্ধান্ত। প্রসঙ্গত ধর্মঘটের দায় শ্রমিক কর্মচারীদের। তারাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ধর্মঘট করেন তাদের ন্যায়সঙ্গত অপূর্ণ দাবি আদায় করার জন্য। আর লে অফ, লক আউট বা সাসপেন্সন অব ওয়ার্ক একান্তভাবেই, মালিকের সিদ্ধান্ত। শ্রমখাতে ব্যয় যতটা সম্ভব কম করে মুনাফার হার বাড়ানোর জন্যই মালিকরা কর্মী হ্রাস, শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে উৎপাদন বন্ধ করার নানা ফন্দি আটেন।
সম্প্রতি ‘হিন্দু’ পত্রিকা গোষ্ঠী তাদের এক সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট করে দিয়েছে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য লড়াই করলে বা ধর্মঘট করলে শিল্পের পরিবেশ নষ্ট হয় না বা রুদ্ধ হয় না শিল্পের বিকাশ। কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য পরিসংখ্যান ব্যবহার করে এবং বিশ্লেষণ করে সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে যে সব রাজ্য শিল্পে যত বেশি উন্নত সেখানে তত বেশি শ্রমিক আন্দোলন, ধর্মঘট হয় এবং শ্রমদিবস নষ্ট হয়। আবার একইভাবে সেইসব রাজ্যগুলিতেই শিল্পে বেশি বিনিয়োগ হয়, বেশি বিনিয়োগ হয়, বেশি নতুন কলকারখানা তৈরি হয় এবং বেশি কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মালিকের মুনাফা না বাড়লেও তারা ধর্মঘটের মধ্যে নতুন বিনিয়োগ বা নতুন কারখানা গড়ার ঝুঁকি নিতেন না।
সম্প্রতি তামিলনাড়ুতে স্যামসাঙ কারখানায় মূলত সিআহটিইউ’র নেতৃত্বে টানা ৩৭দিন ধর্মঘটের ফলে দেশময় গেল গেল রব ওঠে। মালিক পক্ষ, তাদের সংগঠন বণিকসভা, বৃহৎপুঁজির স্বার্থবাহী কেন্দ্রের মোদী সরকার এবং পুঁজিবাদের সমর্থক ও রক্ষক অর্থনীতিবিদরা তারস্বরে কান্নাজুড়ে দেন এবার আর কেউ ভারতে বিনিয়োগ করতে আসবে না। স্যামসঙ ভারতে তাদের সব কারখানা বন্ধ করে দিয়ে অন্য দেশে চলে যাবে। তাদের অনুসরণ করবে অন্য বিদেশি বহুজাতিক সংস্থাগুলিও। বিদেশিরা যদি হাত গুটিয়ে নেয় তাহলে দেশীয় কর্পোরেটও বিনিয়োগ করতে ভয় পাবে। দেশে শিল্পের ভবিষ্যতে বড়সড় প্রশ্ন চিহ্ন দেখা দেবে। এহেন প্রচারের উপসংহার টানা হয় এইভাবে যে শিল্পের বিকাশে সব চেয়ে বাধা শ্রমিকরা। সর্বনাশ ডেকে আনে শ্রমিকদের আন্দোলন। অর্থাৎ শ্রমিকদের যতরকমভাবে শোষণ ও বঞ্চনা করা হোক না কেন কোনোরকম প্রতিবাদ করা যাবে না। মালিকের সর্বোচ্চ মুনাফার স্বার্থে দেশ থেকে শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলন নির্মূল করে দিতে হবে।
হিন্দুর সমীক্ষায় ফুটে উঠে জীবন্ত বাস্তব ছবি। শিল্পে উন্নত, তামিলনাড়ু, গুজরাট, মহারাষ্ট্রে যেমন সবচেয়ে বেশি শ্রমিক ধর্মঘট হয় তেমনি এই তিন রাজ্যের সবচেয়ে বেশি নতুন কারখানা হয় এবং নতুন বিনিয়োগ হয়। এমন কি এই রাজ্যগুলিতেই সর্বাধিক হারে বাড়ে নতুন শ্রমিক। সমীক্ষা এটাও জানিয়েছে শিল্পের বিকাশের প্রধান শর্ত উন্নত পরিকাঠামো, বাজার এবং সরকারি উদ্যোগ। শ্রমিক ধর্মঘটের ভূমিকা নেই বললেই চলে। ধর্মঘট শ্রমিকদের মানসিকভাবে চাঙ্গা করে। দাবি আদায় হলে অনেক বেশি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে। তাই বেশি ধর্মঘট সত্ত্বেও শিল্পোন্নত রাজ্যগুলিতে বেশি স্থায়ী সম্পদ তৈরি হচ্ছে। শ্রমিকরা শিল্প বন্ধ করার বা তাড়াবার জন্য ধর্মঘট করে না। ন্যায্য অধিকারে ভর করে শিল্পকে উন্নত ও বিকশিত করতে চায়।
Editorial
ধর্মঘট শিল্প বাড়ায়, তাড়ায় না
×
Comments :0