শুক্রবার অবস্থানের ৬০০তম দিন। রক্ত ঘামে ভেজা আন্দোলনের মাইলফলক তৈরির দোড়গোড়ায় বসে রয়েছেন রাজ্যের চাকরিপ্রার্থীরা। বৃহস্পতিবারও গান্ধীমূর্তির পাদদেশে দেখা গিয়েছে লড়াইয়ের সহমর্মীদের। শুক্রবারই যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগের দাবিতে ধর্মতলা থেকে গান্ধীমূর্তির পাদদেশ অবধি মিছিলের ডাক দিয়েছে রাজ্য বামফ্রন্ট। আন্দোলনকারীদের তরফেও শুক্রবার অবস্থান স্থলে ডাক দেওয়া হয়েছে গণকনভেনশনের। সেই কনভেনশনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে।
বৃহষ্পতিবার বিকেলে গান্ধীমূর্তির সামনে গিয়ে দেখা মিলল মহম্মদ কামরুজ্জামান বিশ্বাসের। গ্রামে বাড়ি কামরুজ্জামানের। প্রতিদিন নিয়ম করে সকাল ১১টার সময় গান্ধী মূর্তির অবস্থানস্থলে পাড়ি জমান কামরুজ্জামানরা। সকাল ১১টা থেকে বিকেল পাঁচটা। কামরুজ্জামানের কথায়, ‘‘সরকার আমাদের স্কুলের চাকরি পেতে দেয়নি। প্যানেলে আমাদের নাম ছিল। সেই নাম কেটে দিয়ে টাকার বিনিময়ে ভুয়ো নিয়োগ হয়েছে। সেপ্টেম্বরে কলকাতা হাইকোর্টে সিবিআই এবং ইডির তরফেও ঢালাও দুর্নীতির কথা জানানো হয়েছে। নিজেদের ন্যায্য চাকরির দাবিতে আমরা আজ রাস্তায়।’’
কোন তথ্যের কথা বলছেন কামরুজ্জামান? চলতি বছরের ২৮সেপ্টেম্বর কলকাতা হাইকোর্টে পৃথক পৃথক ভাবে নিয়োগ দুর্নীতির খতিয়ান জমা দিয়েছে ইডি এবং সিবিআই। সিবিআই’র তদন্ত অনুযায়ী, ২০১৬সালে নবম-দ্বাদশের শিক্ষক নিয়োগের জন্য এসএলএসটি ফার্স্ট পরীক্ষা নিয়েছিল স্কুল শিক্ষা দপ্তর। সিবিআই জানিয়েছে যে ১৮৭৯ জনকে নিয়োগ করা হয়েছে মেধা তালিকায় কারচুপি করে। নবম-দশমে এমন নিয়োগের সংখ্যা ৯৭২, একাদশ-দ্বাদশে এই সংখ্যা ৯০৭। ইডি’র তদন্ত রিপোর্টে অনুযায়ী দুর্নীতির চিত্র আরও ভয়াবহ। আদালতে ইডি জানিয়েছে, নবম-দ্বাদশ মিলিয়ে পাঁচ হাজারের বেশি শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। তার মধ্যে সাদা খাতা জমা দিয়ে, কিংবা মেধাতালিকায় কারচুপির মাধ্যমে চাকরি মিলেছে ৩ হাজারের বেশি।
আন্দোলনকারীরা জানাচ্ছেন, পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনো ইস্তক এই কথাগুলোই তাঁরা বলে আসছিলেন। আজ কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি আদালতে তাই জানাচ্ছে।
গন্ধীমূর্তির পাদদেশে কথা হলো অপর আন্দোলনকারী সুদীপ্ত মন্ডলের সঙ্গে। তাঁর কথায়, ‘‘সাধারণত স্কুলের টাইমিং হয় সকাল ১১টা থেকে বিকেল পাঁচটা। সেই রুটিন মেনেই আমরা ধর্মতলায় আন্দোলন চালাচ্ছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের ন্যায্য চাকরি আমরা পাবই।’’
আমাদের ন্যায্য দাবি আমরা আদায় করবই! এই অটল আত্মবিশ্বাস নিয়ে কয়েকশো যুবক যুবতী প্রথম পথে নামেন ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। শীতের কামড় মাথায় নিয়েই কলকাতার প্রেস ক্লাবের সামনে তাঁবু ফেলে অবস্থানে বসার সিদ্ধান্ত নিলেন নবম থেকে দ্বাদশের এসএলএসটি’র চাকরিপ্রার্থীরা। আরও সরল করে বললে, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির হবু শিক্ষকরা চাকরির দাবিতে সেদিন থেকে শুরু করলেন আন্দোলন। তাঁদের দাবি, যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের বঞ্চিত করে সাদা খাতা জমা দেওয়া প্রার্থীদের নিয়োগ করার কল তৈরি করেছে স্কুল সার্ভিস কমিশন। তাঁর জন্য প্রয়োজনে নিয়োগ পদ্ধতিকেও গড়ে পিটে নেওয়া হয়েছে নিজেদের সুবিধামতো। প্রবল ঠান্ডা মাথায় নিয়েই আন্দোলন শুরু করল বাংলার বঞ্চিত যুব সম্প্রদায়।
২০১৯। আন্দোলনের প্রথম দফায় শুরুর ২৯ দিন পরে প্রেস ক্লাবের অবস্থান মঞ্চে হাজির হন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এবং তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি। বলেছিলেন, প্যানেলভুক্ত একজনকেও বঞ্চিত করবে না তাঁদের সরকার। নিয়োগ প্রক্রিয়া সুষ্ঠু ভাবে চালানোর জন্য শিক্ষাদপ্তরের পাঁচ আধিকারিক এবং পাঁচজন আন্দোলনকারীকে নিয়ে গঠিত হয় একটি কমিটি।
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, এই কমিটির মাধ্যমে দুর্নীতিকে কার্যত সরকারি শিলমোহর দেওয়া হয়। কীরকম? আন্দোলনকারীরা জানাচ্ছেন, কমিটিতে থাকা আন্দোলনকারীদের সরকার কার্যত কিনে নেয়। কমিটির সদস্য আন্দোলনকারীদের চাকরি দেওয়া হয়। আন্দোলন ভাঙতে চেয়েছিল তৃণমূল সরকার।
দ্বিতীয় দফায় আন্দোলন শুরু করেন নবম-দ্বাদশ চাকরিপ্রার্থীরা। সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কের পাঁচ নম্বর গেটের সামনে ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি থেকে ফের অবস্থানে বসেন তাঁরা। ৪ অক্টোবর রাতের অন্ধকারে পুলিশ দিয়ে তাঁদের হটিয়ে দেওয়া হয়। চারদিন পরে, ৮ অক্টোবর থেকে গান্ধীমূ্র্তির সামনে টানা অবস্থান চালাচ্ছেন এসএলএসটি’র চাকরিপ্রার্থীরা।
বৃহস্পতিবার পড়তি আলোর মাঝে দাঁড়িয়েই সুদীপ্ত এবং কামরুজ্জামান জানালেন শুক্রবারের গণকনভেনশনের কথা। তাঁদের কথায়, ‘‘রাজ্যের সমস্ত চাকরিপ্রার্থী মঞ্চকে নিয়ে মহাজোট গড়ার কাজ শুরু হয়েছে। এতদিন বিক্ষিপ্ত আন্দোলন চলছিল। তার ফলে আন্দোলন দানা বাঁধার আগেই সরকার সেগুলি ভেঙে দিতে সফল হয়েছে। কিন্তু এবার জোটের পরিধি বাড়িয়ে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই আমরা। সমাজের সমস্ত মানুষকে আবেদন জানাচ্ছি আমাদের পাশে থাকার জন্য।’’
Comments :0