Ramjhora tea garden

‘রামের মন্দির খুলছে, রামঝোড়া খুলবে কবে?’

রাজ্য

শম্ভুচরণ নাথ: আলিপুরদুয়ার
 

মনোজ টিগ্গা ২২জানুয়ারি অযোধ্যায় থাকছেন না। তিনি থাকবেন মাদারিহাটে। বৃহস্পতিবার জানালেন, ‘‘এলাকার মানুষকে রামমন্দির উদ্বোধন দেখানো, নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেদিন।’’
রাজ্য বিধানসভায় বিজেপি’র সহকারী দলনেতা মনোজ টিগ্গার বিধানসভা এলাকায় বেশ কয়েকটি চা বাগান বন্ধ। সেই বাগানের শ্রমিক পরিবারগুলিও কী থাকবে আপনাদের অনুষ্ঠানে? দীর্ঘদিনের আরএসএস কর্মী টিগ্গা এদিন বললেন,‘‘নিশ্চয়ই। আমার এলাকায় চারটি বাগান বন্ধ। সেই বাগানের লোকজনকেও বলা হয়েছে। বড় এলইডি টিভির বন্দোবস্ত হচ্ছে। রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠা দেখানো হবে। পুজো হবে। ভোগ বিতরণ হবে।’’
তাঁর বিধানসভা এলাকার বন্ধ বাগানগুলির অন্যতম রামঝোড়া। গত শারদোৎসবের সময় থেকে বন্ধ। সেই বাগানের শ্রমিক ছিলেন কালু কামি। তাঁর কথায়,‘‘রামের মন্দির খুলছে। রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে বলছে। ভালো। কিন্তু রামঝোড়ার কী হবে? বাগান কবে খুলবে? এলাকায় প্রচার হয়েছে বিজেপি’র। মন্দির উদ্বোধন দেখাবে। খিচুরি খাওয়াবে শুনছি। কিন্তু একদিন খিচুরি খেয়ে কী করব? আমাদের তো দিন চলে রেশনের চাল আর বাগানের ফুল খেয়ে। আমার বাড়ির লোক কী করবে আমি বলতে পারছি না। আমি যাবো না। বাগান খোলার কোনও মিটিং হলে শিলিগুড়িতে ডাকলেও চলে যাবো। কিন্তু এসবের জন্য যাবো না।’’
মাদারিহাটের ৪টি সহ আলিপুরদুয়ার জেলায় ৭টি চা বাগান বন্ধ। কালচিনি ব্লকে কালচিনি, রায়মাটাং, দলসিংপাড়া এবং মাদারিহাট ব্লকের ঢেকলাপাড়া, দলমোড়, রামঝোড়া, আর লঙ্কাপাড়া। ২০১৬-র ৭এপ্রিল বীরপাড়ার সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সভা করেছিলেন। সেখানে বলেছিলেন, ‘‘আপনাদের চা-ওয়ালা এসে গিয়েছে আপনাদের সমস্যার সমাধান করতে।’’ গত লোকসভা নির্বাচনের আগে ২০১৯-র ৬ এপ্রিল উত্তরবঙ্গে প্রচার সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন,‘‘আপনারা চা পাতা তোলেন। আমি চা বানাই।’’ তারপর বলেছিলেন, ‘‘বন্ধ চা বাগান খুলিয়েছে কেন্দ্রের সরকার।’’ কিন্তু বাস্তবে এমন কিছুই হয়নি। কেন্দ্র অথবা রাজ্য সরকার বন্ধ বাগান খোলায় কোনও পদক্ষেপ নেয়নি।
এবার পঞ্চায়েত ভোটে জেলার ৬৪টি পঞ্চায়েতের মধ্যে বিজেপি মাত্র ৪টি জিততে পেরেছে। চা বলয়ের ভোটব্যাঙ্কে ভর করে গত লোকসভা, ২০২১-র বিধানসভা ভোটে ভালো ফল করে বিজেপি। জেলার ৬৪টি পঞ্চায়েতের মধ্যে চা বলয়ে রয়েছে ৩৯টি। এবার পঞ্চায়েত ভোটে চা বলয়ের একটিতেও জিততে পারেনি বিজেপি। হারানো ভোট পুনরুদ্ধারে রামকে সামনে রেখেই এবার রামমন্দির উদ্বোধনকে হাতিয়ার করতে নেমেছে বিজেপি।
যে বাগানগুলি খোলা সে বাগানগুলির শ্রমিকদের অবস্থাও ভালো নয়। বিশেষ করে মহিলা শ্রমিকদের উপর বেশি চাপ সৃষ্টি করে। অনেক বাগানে ২৬ দিনের কাজ করে ১৩ দিনের মজুরি পাচ্ছে। যেমন তুড়তুড়ি চা বাগান। সিআইটিইউ নেতা বিদ্যুৎ গুণ জানান, ‘‘লেবার ডিপার্টমেন্টে জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনও উত্তর এখনও দেয়নি। আর রাজ্যের বাইরে যে সব মহিলা শ্রমিক কাজ করতে যায় তাদের তো অনেক সময় আর খুঁজে পাওয়া যায় না।’’
কালচিনি চা বাগানের আর এক শ্রমিক কুবির লামা জানান,‘‘বাগানের ২২০৪ জন শ্রমিক আমরা কাজ হারা হয়েছি। অস্থায়ী শ্রমিক প্রায় ৪০০ কাছাকাছি। তার স্থায়ী শ্রমিকের মধ্যে প্রায় অর্ধেক মহিলা শ্রমিক বাইরে কাজ করতে চলে গেছেন। বাগানে কিছু লোক রামের ছবি নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে। তাদের বলছে ২২ তারিখ মোম জ্বালাতে এবং রামের ছবি বাড়িতে রাখতে। শ্রমিকদের মাঝে প্রশ্ন বাগান কবে খুলবে?’’
বন্ধ চা বাগানে অনাহারে এবং অপুষ্টির কারণে নানা রোগে যাঁরা মারা যায় তাদের বয়স বেশি নয় এলাকার মানুষের দাবি, অনাহার-অর্ধাহার, অপুষ্টিজনিত রোগ ও বিনা চিকিৎসার কারণেই বাগানে এভাবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চলেছে। এছাড়া কাজ না থাকায় মানসিক অবসাদে ভুগছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, প্রশাসন নাকি কিছুই জানে না।
২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে চা বাগানের শ্রমিক, মালিক এবং রাজ্য সরকারের ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে নূন্যতম ৩৫০ টাকা মজুরির দাবি করা হয় ৷ সেই সময় মাত্র ২৬ টাকা মজুরি বাড়ে। এই বৃদ্ধির ফলে মজুরি হয় ২০২ টাকা। গত বছর মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি হাসিমারার সুভাষিনী চা বাগানের মাঠে প্রশাসনিক সভা থেকে চা শ্রমিকদের জন্য ১৫ শতাংশ অন্তর্বর্তীকালীন মজুরি বৃদ্ধির কথা ঘোষণা করেন। ফলে ২০২ টাকা মজুরি বেড়ে দাঁড়ায় ২৩২ টাকা। এখন সেটাই স্থায়ী চা শ্রমিকদের মজুরি। অস্থায়ী চা শ্রমিকদের মজুরি আরও কম। একেক বাগানের মালিক এই অস্থায়ী চা শ্রমিকদের একেক রকম ভাবে শোষণ করেন। চা শ্রমিকরা বলছেন তাঁদের নূন্যতম মজুরি বাড়িয়ে ৪০০ টাকা করতে হবে। কিন্তু চা বাগানের মালিক এবং রাজ্যের তৃণমূল সরকার তাতে রাজি নয়। তৃণমূল সরকার বরাবরের মতো মালিকদের পক্ষই নিচ্ছে। চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের ৭০ শতাংশই মহিলা। এদের অধিকাংশ আদিবাসী বা বিভিন্ন উপজাতি জনগোষ্ঠী, দলিত ও তফসিলি জাতির মানুষ। 
বিজেপি-রও বাগানের দুর্দশা নিয়ে কোনও বক্তব্য নেই এখন। ‘রাম’ তাদের ভরসা।
 

Comments :0

Login to leave a comment