ডা: অমিত পান
সাম্প্রতিক কালে অ্যাসোসিয়েশন অব চেস্ট ফিজিশিয়ান, ওয়েস্ট বেঙ্গল এক আবেদনে জানিয়েছে, ‘ড্রাগ সেনসিটিভ’ যক্ষ্মা রোগীদের (যাদের প্রচলিত ওষুধে কাজ হয়) জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের সারা দেশজুড়ে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক প্রভৃতি রাজ্যগুলি তাদের গভীর উদ্বেগের কথা স্বাস্থ্য মন্ত্রককে জানিয়েছে। এপ্রিল মাসের শেষে সিআইটিইউ’র সাধারণ সম্পাদক তপন সেনও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছেন।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও অবস্থা সমান গুরুতর। যদিও রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তর এ বিষয়ে চুপচাপ থাকাই পছন্দ করেছে। সম্ভবতঃ রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী(?) কী চাইছেন সেটা সঠিকভাবে অনুধাবন না করতে পারার জন্য। কারণ অন্যান্য নানা বিষয়ে অতি সরব থাকলেও এ রাজ্যের 'মাননীয়া' এ ব্যাপারে সম্পূর্ণই নীরব!
প্রসঙ্গতঃ, গত বছরে ‘ড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট’ যক্ষ্ম রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যাপক আকাল দেখা দিয়েছিল। দুটি ক্ষেত্রেই পরিণাম অতি ভয়ঙ্কর, কারণ ‘ড্রাগ সেনসিটিভ’-দের ওষুধ বন্ধ হলে (সাময়িকভাবেও), তা ‘ড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট ভ্যারাইটি’ তৈরি করতে সাহায্য করবে। আর ‘ড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট কেস’-এ ওষুধ না পাওয়া গেলে তা সরাসরি মৃত্যুর কারণ ঘটবে।
সারা পৃথিবীতে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যায় ভারত অবশ্যই শীর্ষস্থানে, মোট রোগীর ২৭ শতাংশ। মৃত্যুর হার আগের থেকে কমলেও আন্তর্জাতিক গড়ের দ্বিগুণ (ভারতে ১২ শতাংশ, যেখানে আন্তর্জাতিক গড় ৫•৮ শতাংশ)। ২০২২ সালে যক্ষ্মা রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ৩,৪২,০০০ অর্থাৎ প্রতি ঘন্টায় চল্লিশের এবং দিনে এক হাজারের কাছাকাছি। ভারতে কোভিডে মৃত্যুর সরকারি হিসাব থেকে খুব দূরে নয় কিন্তু। প্রতি এক লক্ষ মানুষের মধ্যে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘হু’-এর মতে ২১০।
যদিও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক বলছে ওটা ঠিক নয়, সংখ্যাটা হবে ১৯৬। এ বিষয়ে অবশ্য ভারতের স্থান বিশ্বে পঞ্চম, তার আগে রয়েছে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, কাম্বোডিয়া,বটসওয়ানা ও বাংলাদেশ। তবে, কোভিডকালে যক্ষ্মারোগের চিকিৎসা কার্যত লাটে তোলার বিষয়ে শীর্ষে থাকা পাঁচটি দেশের সামনের সারিতে আছে ভারতবর্ষ।
‘হু’-এর মতে, কোনো পরিবারের বাৎসরিক আয়ের শতকরা দশ শতাংশের বেশি যদি রোগের চিকিৎসার কারণে ব্যয়িত হয়, তাহলে তাকে বলা হবে,'ক্যাটাস্ট্রফিক হেল্থ সিচুয়েশন'। ভারতবর্ষের শতকরা কুড়ি ভাগ মানুষ এই অংশে পড়ে। আর, যক্ষ্মা রোগীর ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরও বেশি। কিনে ওষুধ খাওয়া রীতিমতো ব্যয়বহুল শুধু নয়, খোলা বাজারে ওষুধ পাওয়াই দুঃসাধ্য। কারণ প্রথমতঃ জোগানই কম আর দ্বিতীয়তঃ বিক্রি কম হওয়ায় কাউন্টার ওষুধ আনানোর চেষ্টাও করে না। ফলতঃ, চিকিৎসায় ছেদ এবং তৎপরবর্তী ফলাফল প্রায় অনিবার্য।
কিন্তু, এরকম হওয়ার কী কথা ছিল?
২০১৮ সালে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন 'টিবি মুক্ত ভারতের' সঙ্কল্প। ১৯৬২ সালে শুরু হওয়া ‘টিউবারকিউলোসিস কন্ট্রোল প্রোগ্রাম’,পরে ১৯৯৩ সালে আরএনটিসিপি বা ‘রিভাইসড ন্যাশনাল টিউবারকিউলোসিস কনট্রোল প্রোগ্রাম’, পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয় এনটিইপি বা ন্যাশনাল টিউবারকিউলোসিস এলিমিনেশন প্রোগ্রাম’-এ। ২০২২ এ রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মূর্মূ উদ্বোধন করেন PMTBMBA অর্থাৎ ‘প্রধানমন্ত্রী টিবি মুক্ত ভারত অভিযান’, সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয় ২০২৫ সালে। ২০২৩ সালে বারাণসীতে ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড টিবি সামিট-এ প্রধানমন্ত্রী ‘টিবি মুক্ত পঞ্চায়েত’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
আমাদের দেশে আবার কোনো সঙ্কল্প, তা কেন্দ্রে হোক বা রাজ্যে, সরকার বা এমনকি দলের নামেও হয় না। বলা হয় ‘দিদি কি গ্যারান্টি’ বা ‘দাদা কা গ্যারান্টি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। খুবই ভালো কথা, কারণ ভোটের বাজারে এখন এই সব গ্যারান্টি ও তার রূপায়নের ঢঙ্কানিনাদেই চতুর্দিক উদ্বেলিত। কিন্তু ২০২৩ সালের হিসাব মতো ২৫•৫ লক্ষ যক্ষ্মারোগীদের চিকিৎসার গ্যারান্টি বোধহয় উহ্যই রইলো।
প্রসঙ্গতঃ, এই সংখ্যাটাও কিন্তু সম্পূর্ণ নয়। কারণ যক্ষ্মা রোগনির্ণয় কর্মসূচিতেও ‘হু’-এর গাইডলাইন মেনে চলার বিষয়ে ভারত অনেকটাই পিছিয়ে। আর, ২০২২ থেকে তো তার আগের দু’বছরের পড়ে থাকা কাজ করতেই অনেকটা ব্যস্ত থাকতে হয়েছে।
তা আর কী করা যাবে? ভারতবর্ষের মোট ভোটার কত? মোটামুটি ৯৭ কোটির কাছাকাছি। তার মধ্যে সব মিলিয়ে আধ কোটিরও কম লোক নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কি? তার চেয়ে কোথায় মন্দির হয়েছে বা কোন ধারা বাতিল হয়েছে কিংবা মহিলাদের মাথাপিছু অনুদান পাঁচশ থেকে হাজার হয়েছে, গ্যারান্টির সেই অধ্যায়গুলির চর্চাই বরং বেশি করে হোক। ঢাক ঢোল কাঁসি ডিজে আরো যা কিছু আছে সব বাজিয়েই হোক!
সব গ্যারান্টিই রাখতে হবে এই গ্যারান্টিই বা কে দিলো?
Comments :0