খসড়া ওবিসি সংরক্ষণের আওতা থেকে ৪০টি জনগোষ্ঠীকে বাদ দিতে চলেছে রাজ্য সরকার! গত সোমবার রাজ্য মন্ত্রীসভার বৈঠক থেকে অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণের খসড়া সংশোধন নীতি অনুমোদন করা হয়েছে।
মন্ত্রীসভার বৈঠকের পর অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে প্রশাসনের কেউই মুখ খুলতে চাননি। কোন জনগোষ্ঠীকে ‘ওবিসি এ ’ ও ‘ওবিসি বি’ ক্যাটাগরির তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে আনা হয়নি। একইসঙ্গে এতদিন ১৮০টি জনগোষ্ঠী ওবিসি সংরক্ষণের তালিকায় থাকার পর কোন ৪০টি জনগোষ্ঠীকে বাদ দেওয়া হলো, সেটাও প্রকাশ করা হয়নি। রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তরের এক আধিকারিক শুধু জানিয়েছেন, ‘‘১৪০টি জনগোষ্ঠীকে ওবিসি সংরক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। জনগোষ্ঠীর তালিকা পরবর্তীকালে সরকার প্রকাশ করবে।’’
নবান্ন সূত্রের খবর, ওবিসি সংরক্ষণের নয়া খসড়াতে ২০১০ পূর্ববর্তী সময়ের ৬৬টি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৬৪টি জনগোষ্ঠীকে রাখা হয়েছে। অতীতের ৬৬ টি জনগোষ্ঠীত মধ্যে ১২টি ছিল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। বাকি ৫৪ টি হিন্দু জনগোষ্ঠীর। ফলে কোন দু’টি জনগোষ্ঠীকে বাদ রাখা হলো তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। আবার মমতা ব্যানার্জির আমলে ১১৪ জনগোষ্ঠীকে ওবিসি তালিকায় আনা হয়েছিল। সূত্রের খবর, নয়া সংরক্ষণে ১১৪টির মধ্যে ৭৬টি জনগোষ্ঠীকে রাখা হয়েছে। ১১৪টি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১১০টি ছিল মূলত সংখ্যলঘু সম্প্রদায়ের অনগ্রসর শ্রেণি। আর বাকি ৪টি ছিল হিন্দু অনুগ্রসর সম্প্রদায়ভুক্ত।
ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে মন্ত্রীসভার বৈঠকের পর সরকারের তরফ থেকে কোনও উচ্চবাচ্য না করায় কারা সংরক্ষণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ল, তা নিয়ে যথেষ্টই জটিলতা তৈরি হয়েছে। প্রাক্তন সিপিআই(এম) সাংসদ ও ‘আওয়াজ’ রাজ্য কমিটির সভাপতি অধ্যাপক সাইদুল হক জানান,‘‘কোন ১৪০টি জনগোষ্ঠীকে সরকার অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণের তালিকায় নিয়ে এল, তা প্রকাশ্যে আনা দরকার। অতীতের ১৮০টি থেকে কোন যুক্তিতে কমিয়ে ১৪০টি করা হলো, তার পক্ষে সরকারের যুক্তি কী তা প্রকাশ্যে না আনলে ফের মামলার মুখে পড়বে রাজ্য সরকার।’’ ‘আওয়াজ’ সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, বিজ্ঞানভিত্তিক, কার্যকরী সমীক্ষা না করে সরকার যদি তাড়াহুড়ো করে মন্ত্রীসভার বৈঠক থেকে সংরক্ষণ নীতি অনুমোদন করিয়ে নেয়, তার ফল ভুগতে হবে শেষ পর্যন্ত গরিব মানুষকেই। একইসঙ্গে অতীতে সংরক্ষণের আওতায় থাকা সমস্ত জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে আনার দাবি করা হয়েছে।
মন্ত্রীসভার বৈঠক থেকে অনুমোদনের পর ওবিসি সংরক্ষণের নয়া নীতিকে বিল হিসাবে রাজ্য বিধানসভার অধিবেশন থেকে পাশ করাতে হবে। তার ভিত্তিতে তৈরি হবে আইন। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে রাজ্য বিধানসভার বর্ষাকালীন অধিবেশনে মন্ত্রীসভায় অনুমোদিত নয়া ওবিসি সংরক্ষণের খসড়া নীতি আইনি বৈধতা পেতে চলেছে। তার আগে অবশ্য আগামী ১৫ জুনের মধ্যে কলকাতা হাইকোর্টে রাজ্য সরকারকে হলফনামা জমা দিতে হবে। গত মে মাসেই কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিসন বেঞ্চের বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী ও রাজশেখর মানথা’র বেঞ্চ ওবিসি’র সমীক্ষার কাজ নিয়ে বেশ কিছু নির্দেশ দিয়েছিল রাজ্য সরকারকে। মূলত সমীক্ষার সময় সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া, যোগ্য ওবিসি সম্প্রদায় যাতে সমীক্ষা প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে, আবেদন করতে পারে তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দিয়েছিল রাজ্য সরকার। আদালতের এই নির্দেশ মেনে কাজ হয়েছে কিনা তা হলফনামা আকারে রাজ্য সরকার জমা দেবে।
গত ২০২৪ সালের ২২ মে কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে এরাজ্যের প্রায় ১০ লক্ষাধিক ওবিসি শংসাপত্র বাতিল হয়ে যায়। হাইকোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টে যায় রাজ্য সরকার। কিন্তু শীর্ষ আদালত হাইকোর্টের রায়ের ওপর কোনও স্থগিতাদেশ না দিয়ে মামলা কলকাতা হাইকোর্টে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। তারপর থেকে এরাজ্যে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের শংসাপত্র নিয়ে চরম ভোগান্তি শুরু হয়ে যায়। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ থেকে পড়াশোনার ক্ষেত্রে ওবিসি সংরক্ষণ কার্যত শিকেয় ওঠে।
আসলে ২০১২ সালে মমতা ব্যানার্জির সরকার অনগ্রসর জাতি সংক্রান্ত আইনের একটি সংশোধনী এনে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল কমিশন ফর ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস ওয়েলফেয়ার’ সংস্থার ভূমিকাকেই কার্যত খর্ব করে দেয়। কমিশনের পরিবর্তে রাজ্য সরকার নিজেরাই কোন জনগোষ্ঠী ওবিসি তালিকায় আসবেন তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী হয়ে ওঠে। গত বছর কলকাতা হাইকোর্টে ডিভিসান বেঞ্চের রায়ে সরকারের ২০১২ সালের এই সংশোধনী আইনকেই অবৈধ বলে জানিয়ে দিয়েছিল।
এখন মন্ত্রীসভার বৈঠকে অনুমোদিত হওয়া নয়া ওবিসি সংরক্ষণ খসড়া নীতি কীভাবে গ্রহণ করা হয়েছে সেটা প্রকাশ্যে না আসা পর্যন্ত সংশয় থেকেই যাচ্ছে। বিশেষত ওবিসি সংরক্ষণের জন্য রাজ্যবাসীকে কীভাবে সুযোগ দিয়েছে তা ঠিক হবে আদালতেই।
OBC list
মন্ত্রীসভায় পাশ খসড়া, ওবিসি সংরক্ষণে বাদ পড়ছে ৪০ জনগোষ্ঠী

×
Comments :0