একে পরিকাঠামোর অভাব, তার ওপর রেফার কেস ডেকে আনছে মৃত্যু। হাসপাতালে হাসপাতালে তীব্র হচ্ছে এই অভিযোগ। ‘স্যার, আমাদের বাচ্চাটা বাঁচবে তো?’ -চিকিৎসক, এমনকি স্বাস্থ্যকর্মীদের দেখলেই ছুটে গিয়ে প্রশ্ন করছেন উদ্বিগ্ন মা-বাবা। মৃত্যু বাড়ছে। থামছে না মা-বাবার কান্না। গত ২ দিনে জ্বর ও শ্বাসকষ্টে রাজ্যে আরও ৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ৩ জনের শরীরে মিলেছে অ্যাডিনো ভাইরাস। এই মৃত্যুর তালিকার মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি রেফার কেস। ‘রেফার না হলে হয়তো এতগুলি বাচ্চা মারা যেত না’- বুধবার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অপেক্ষমাণ পরিবারগুলির এমনই বক্তব্য ছিল দিনভর।
একই দৃশ্য বি সি রায় হাসপাতালেও। এভাবেই অসুস্থ শিশুর চাপ ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে যাওয়া চরম বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েছে কলকাতার অন্যান্য হাসপাতালগুলিও। বিভিন্ন বেসরকারি সূত্র বলছে, গত ৭০ দিনে ১০০ ছাড়িয়ে আরও ক্রমশ বাড়ছে মৃত্যু সংখ্যা।
বুধবার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্ত্বরে গোটা দিনই ছিল নানা মর্মান্তিক ছবি। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট থেকে ছোট্ট শিশু সন্তানকে বুকে আগলে নিয়ে এসেছেন আবু তাহের, মেহেরুন্নিসার পরিবার। উদ্বিগ্ন মুখে ভবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, ভেতরে তাঁদের শিশুকে পরীক্ষা করছেন চিকিৎসকরা। একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে বললেন, স্থানীয় চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে পাঠিয়ে দিয়েছে। নিয়ে আসতে পথেই এত সময় লেগে গেল। ৭ মাসের শিশু, নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। ভিড়ের চাপ সামলাতে হিমশিম অবস্থা চিকিৎসকদেরও। কিছুটা দূরে প্লাস্টিক বিছিয়ে অসহায়ভাবে বসেছিলেন সৈকত মান্না ও তাঁর স্ত্রী জবা মান্না।
ফুলেশ্বর থেকে এসেছেন তাঁরা। বললেন, উলুবেড়িয়া হাসপাতাল থেকে রেফার করেছে তাদের ৪ মাসের শিশুকে। অবস্থা ভালো নয়, এখানে ভর্তি নেবে কিনা জানি না। মিনিটে মিনিটে বহু মুমূর্ষু শিশু নানা প্রান্ত থেকে এসে পৌঁছাচ্ছে। কী হবে কে জানে।
চিকিৎসক মহলের বক্তব্য, জেলায় জেলায় বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল, চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী থেকে দরকারি চিকিৎসা সরঞ্জামের সুব্যবস্থাই নেই। স্বাস্থ্য দপ্তরের এই গাফিলতির ফল ভুগছে শিশুদের পরিবারগুলি, ভয়ঙ্কর চাপ বাড়ছে চিকিৎসকদের ওপরেও। চলতি মরশুম অর্থাৎ গত ২ মাসে রাজ্যে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা বিভিন্ন বেসরকারি সূত্র অনুযায়ী ১০০ ছাড়িয়ে ক্রমশ আরও উর্ধ্বগামী হয়েছে। অথচ সরকারিভাবে বলা হয়েছে মৃত্যু সংখ্যা ১৯! শুধু তাই নয়, দেওয়া হচ্ছে না দৈনিক মৃত্যু বা হাসপাতালে একদিনে ভর্তি হওয়ার কোনও তথ্যও। অন্যদিকে রোজই সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত একের পর এক মর্মান্তিক দৃশ্য ভেসে উঠছে উপস্থিত সকলের চোখের সামনে। মৃত শিশুদের মা-বাবার কান্নায় ভরছে আকাশ বাতাস।
এরই মধ্যে খবর এসেছে হুগলীর মগরার বাসিন্দা এক ৬ মাসের শিশুর মৃত্যু হয়েছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। হুগলীর ইমামবাড়া হাসপাতাল থেকে রেফার করা হয়েছিল শিশুটিকে। অন্যদিকে উলুবেড়িয়ার বাসিন্দা ৬ মাস বয়সের একটি শিশুর মৃত্যুর খবর মিলেছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। উলুবেড়িয়া হাসপাতাল থেকে রেফার করা হয়েছিল তাকে। এছাড়াও হাওড়া বালির বাসিন্দা ৫ বছরের একটি শিশুকে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে প্রথমে ভর্তি করা হয়েছিল স্থানীয় একটি চিকিৎসাকেন্দ্রে। এরপর শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে রেফার করা হয় কলকাতার বিসি রায় শিশু হাসপাতালে। মঙ্গলবার মৃত্যু হয়েছে তার। এই বিসি রায় হাসপাতালেই বনগাঁর একটি হাসপাতাল থেকে ৯ মাসের এক শিশুকে রেফার করা হয় বিসি রায় হাসপাতালে। বুধবার মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গিয়েছে শিশুটির। শুধু বিসি রায় হাসপাতালেই গত ৭ দিনে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৪০ জনের। এছাড়া মঙ্গলবার ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথে একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, কয়েকদিনের অজানা জ্বরে মঙ্গলবার গভীর রাতে মৃত্যু হয় কালনার এক ৮ বছরের শিশুর। মৃত নুসরত খাতুনের বাড়ি কালনা থানার নান্দাই গ্রাম পঞ্চায়েতের নতুনগ্রামে। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, আট দিন আগে শিশুটির প্রবল জ্বর আসে। প্রথমে তাকে শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে তাকে কালনা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় শিশুটির অবস্থার আরও অবনতি হলে রেফার করে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে দু’দিন চিকিৎসা চলার পর মঙ্গলবার রাত দেড়টা নাগাদ তার মৃত্যু হয়।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ৩ দিন আগে বিধানসভায় বলেছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। অতএব রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের তরফে বুধবার বিসি রায় হাসপাতালে পরিদর্শনে এসে মুখ্যমন্ত্রীর সুরে সুর মিলিয়ে বলা হলো এখন পরিস্থিতি ভালোর দিকে, সুষ্ঠু পরিষেবা মিলছে। কিন্তু কোথায় কী? সঙ্গে সঙ্গেই এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন হাসপাতালে উপস্থিত ভুক্তভুগী পরিবারগুলি।
রাজ্য স্বাস্থ্যদপ্তর ইতিমধ্যে বৈঠকের পর বৈঠক করে রেফার কেসের ইতি টানার কথা বলেছে। রেফার কেস বন্ধ করতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রীও। কিন্তু রাজ্যের চিকিৎসক মহলের বক্তব্য, রোগের কারণ জিইয়ে রেখে বাইরে থেকে বিক্ষিপ্ত কিছু ওষুধ প্রয়োগ করলে রোগ সারে না। রেফার কেস বন্ধ করতে হলে জেলায় জেলায় হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রগুলিতে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করতে হয় অনেক আগে থেকে। সেসব প্রায় কিছুই করেনি রাজ্য সরকার। তাহলে সেইসব চিকিৎসাকেন্দ্রের চিকিৎসকরা শিশুদের বাঁচাতে কী করবেন? ফলে অবধারিতভাবে চাপ বাড়ছে কলকাতার ওপরে। যখনই একটি বিপর্যয় আসে, তখনই বেসামাল হয়ে পড়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রশাসন। তার কারণ স্বাস্থ্য পরিষেবার মূল বিষয়গুলিই অবহেলিত থেকে গেছে গত কয়েক বছরে। এই অবস্থা সামাল দিতে শিশুদের পরিবারকে নিজেদেরই সতর্ক থাকতে হবে, বিধিনিষেধগুলি মেনে চলতে হবে।
Comments :0