জামিনের আবেদন ছিল দায়সারা। মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহধন্য বাহুবলী নেতার জামিন আটকানোর বরং মরিয়া প্রয়াস ছিল পুলিশের, সরকার পক্ষের আইনজীবীর। দিল্লির ইডি হেপাজতে যাওয়া আটকাতে অনুব্রত মণ্ডলের জামিনের বিরোধিতা করে দীর্ঘ সওয়ালও করলেন সরকার পক্ষের আইনজীবী। যদিও বিফলে গেল চেষ্টা, খুনের চেষ্টার অভিযোগে পুলিশের হেপাজতের পরে সরাসরি জামিনই পেয়ে গেলেন অনুব্রত মণ্ডল। তাতে আদালত কক্ষেই পুলিশ থেকে তৃণমূলের নেতাদের মুখ ‘ছোট’ হতেও দেখা গেল!
অনুব্রত মণ্ডলকে মামলা দিতে যেমন সব উজাড় করে দিয়েছিল পুলিশ, ঠিক তেমনই তার জামিন আটকাতেও সরকার পক্ষ চালিয়েছিল মরিয়া প্রয়াস। এ এক বেনজির দৃশ্য। মমতা ব্যানার্জির পুলিশ প্রশাসন, সরকারি আইনজীবীরা এমনকি তৃণমূল কর্মীরা, এমনকি খোদ অনুব্রত মণ্ডল পর্যন্ত চাইছেন তৃণমূল কর্মীর অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর যেন জামিন না হয়, যেন পুলিশ হেপাজতেই থাকতে পারেন!
এরাজ্যে তৃণমূল নেতার কাছে পুলিশ হেপাজতই যেন সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল!
ইডি’র হাত থেকে বাঁচতে দলের কর্মীকে দিয়েই সাজানো ঠুনকো মামলায় সাত দিনের পুলিশ হেপাজতের মেয়াদ শেষ করে মঙ্গলবার দুবরাজপুর আদালতে তোলা হয়েছিল অনুব্রত মণ্ডলকে। গোরু পাচার মামলায় অনুব্রতর দিল্লিতে ইডি’র হেপাজতে যাওয়া যখন নিশ্চিত ঠিক তখনই আচমকা এক অভিযোগ দায়ের হয়ে যায় অনুব্রতর বিরুদ্ধে। অনুব্রতরই দলের এক প্রাক্তন প্রধান গত ১৯ ডিসেম্বর বীরভূমের দুবরাজপুর থানায় দায়ের করেন ‘অভিযোগ’। দুবরাজপুর ব্লকের বালিজুড়ি পঞ্চায়েতের প্রধান শিবঠাকুর মণ্ডলের অভিযোগ, ‘২০২১ এর বিধানসভা ভোটের সময় দুবরাজপুর পার্টি অফিসে ডেকে পাঠিয়ে অনুব্রত আমাকে টুঁটি চেপে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন। কারণ আমি আর দল করব না বলেছিলাম।’ কয়েক লাইনে দায়সারা ভাবে লেখা ঘটনার বিবরণ। গত বছরের মে মাসে ঘটেছিল সেই ঘটনা, এফআইআর’এ তাই আছে। যদিও মে মাসে বিধানসভা ভোটের ফল বেরিয়ে গিয়েছিল! সেই অদ্ভুত বিবরণে ভর করেই নিমেষে হয়ে যায় এফআইআর। রাতারাতি আসানসোল জেলে গিয়ে অনুব্রতকে ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ সম্পূর্ণ করে ‘শোন অ্যারেস্ট’ দেখিয়ে ‘প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট’ নিয়ে পুলিশ অনুব্রতকে আসানসোল জেল থেকে দুবরাজপুর আদালতে পেশ করে নিজেদের হেপাজতে নেয়।
সাত দিনের সেই হেপাজত শেষ করে এদিন ফের আদালতে তোলার আগে রাজ্য পুলিশ তৈরিও রেখেছিল প্ল্যান-বি। অনুব্রত মণ্ডলের জামিন আটকানোই ছিল মূল উদ্দেশ্য। তাই ফের পুলিশ হেপাজত চাওয়া হয়েছিল। পুলিশ হেপাজত মঞ্জুর না হলে কমপক্ষে জেল হেপাজত মিলবে নিশ্চিত ছিলেন সকলেই। তাই অনুব্রতকে আদালতে তুলতেই দুবরাজপুর থেকে সিউড়ি যাওয়ার রাস্তা নিরুপদ্রব রাখতে সার বেঁধে মোতায়েন করা হয়েছিল সিভিক বাহিনী। কারণ বিচারক জেল হেপাজতে পাঠালে অনুব্রতর ঠাঁই হতো সিউড়ি জেল।
দুবরাজপুর আদালতের বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট আরাত্রিকা দাস ২ হাজার টাকা ব্যক্তিগত বন্ডের বিনিময়ে মঞ্জুর করেছেন অনুব্রত মণ্ডলের জামিন। ৩০৭ নম্বর ধারার মতো গুরুতর অভিযোগ যার বিরুদ্ধে তাঁকে পুলিশ হেপাজত থেকে সরাসরি জামিন দেওয়া সাধারণত হয় না বলেই মত প্রকাশ করেও দুবরাজপুর আদালতের একাংশের আইনজীবীর মন্তব্য, মামলার প্রেক্ষাপট তো পরিষ্কার। কোন উদ্দেশ্য কাজ করছে এর পেছনে জলের মতো পরিষ্কার। তার ওপর উচ্চ আদালতের কড়া নজরদারি রয়েছে এই মামলার উপর। ফলে নিম্ন আদালতের বিচারক সব দিক বিবেচনা করেই এই নির্দেশ দিয়েছেন।
সুতরাং, নিজের জেলার সিউড়ি জেলে নয়, গোরু পাচারকাণ্ডে সিবিআই’র হাতে ধৃত হিসাবেই ফের সেই আসানসোল জেলেই ফিরতে হলো এই তৃণমূলের বাহুবলী নেতাকে।
এদিন দুপুর আড়াইটে নাগাদ অনুব্রতকে তোলা হয়েছিল এজলাসে। শুনানি শুরু হতেই সরকারি আইনজীবী যুক্তি দেন, ‘অভিযোগ গুরুতর। অভিযুক্তই এই মামলার সবচেয়ে বড় সাক্ষী। অভিযুক্ত গত ছয়দিন ধরে নিশ্চুপ ছিলেন। আজ সকালে এমন কিছু বলেছেন যা মামলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেস ডায়রিতে সব আছে। তাই তাকে জামিন দিলে তদন্ত প্রভাবিত হবে।’ তদন্তকারী আধিকারিকও বলেন, ‘অনেক তথ্য পাওয়া যাবে অভিযুক্তের কাছে। তাছাড়াও অভিযোগে ঘটনার সময় নিরাপত্তারক্ষীর উপস্থিতির কথা বলা আছে। তাই আরও সাত দিনের পুলিশ হেপাজতের জন্য আবেদন করেছি।’ জামিন আটকানোর সপক্ষে এতকিছু যুক্তি দেওয়ার পর অনুব্রতর হয়ে আদালতে দাঁড়ানো এক আইনজীবী স্রেফ একলাইনে বলেন, ‘আমি জামিনের আবেদন করছি।’
কারও বুঝতে অসুবিধা হয়নি, সমালোচনার ঝড় আটকাতে লোকদেখানো আইনজীবী দাঁড় করানো হয়েছিল অনুব্রতর জামিনের আবেদন করতে। সব শুনে বিচারক নির্দেশ দিতে বেশ কিছুটা সময় নেন। তখন এজলাসে বসে অনুব্রত। তার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল চেয়ারের। সেই চেয়ারে বসেই ফ্যান চালাতে বলেন। তার হাতে এসে পৌঁছায় মিনারেল ওয়াটারের বোতল। কিছুক্ষণ বাদেই বিচারক জামিন মঞ্জুরের নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ পেতেই চোখ ছানাবড়া হয় সরকার পক্ষের আইনজীবী থেকে পুলিশ, এজলাসে উপস্থিত আইনজীবী থেকে বাইরে থাকা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের।
বিচারকের নির্দেশ মেলার ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই যেমনভাবে অনুব্রতকে আনা হয়েছিল আসানসোল থেকে দুবরাজপুর, ঠিক একইভাবে এদিন উলটো পথ ধরে পুলিশের কনভয়। আর অভিযোগ দায়েরের পর থেকে সংবাদমাধ্যমে মুখর থাকা অভিযোগকারী শিবঠাকুর মণ্ডল হয়ে গিয়েছেন বেপাত্তা। ফোন করলেও তা ধরছেন না।
Anubrata Dubrajpur Bail
অনুব্রতকে নিজেদের হেপাজতে রাখতে পারল না রাজ্য পুলিশ
×
Comments :0