Buddhadeb Bhattacharya condolence meeting

স্বপ্নপূরণের সংগ্রাম চলবে, সেই লড়াইয়েই বেঁচে থাকবেন তিনি

কলকাতা


স্বপ্নপূরণের সংগ্রাম চলবে, সেই
লড়াইয়েই বেঁচে থাকবেন তিনি

নিজস্ব প্রতিনিধি: কলকাতা, ২২ আগস্ট— নতুন প্রজন্মের জন্য কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার লড়াই চলবে, লড়াইয়ের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন তিনি। বৃহস্পতিবার নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরোর প্রাক্তন সদস্য কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্মরণসভায় একথাই ঘোষণা করলেন সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ। পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, বাংলার ছেলেমেয়েরা যাতে তাঁদের মেধা নিয়ে বাংলাকে গড়ে তুলতে পারে, তার জন্য আদর্শে অবিচল থেকে লড়াইতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। চোয়াল শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে সেই স্বপ্নপূরণের সংগ্রামকে তীব্র করতে হবে, সেই লড়াইতেই বেঁচে থাকবেন তিনি।
এদিন ভিড়ে পরিপূর্ণ নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্মরণসভায় বামফ্রন্ট এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার নতুন প্রজন্মের জন্য তাঁর আন্তরিক প্রয়াসকে স্মরণ করা হয়েছে এবং সেই লড়াইকে তীব্র করার আহ্বান জানানো হয়েছে। সভায় সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি যোগ দিতে পারেননি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দিল্লিতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার কারণে। কিন্তু এদিন সকালেই চিকিৎসকরা তাঁকে আইসিসিইউ থেকে সাধারণ শয্যায় স্থানান্তরের পরে ইয়েচুরি একটি ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছেন। নেতাজী ইন্ডোরে সভায় তা দেখানো হয়। ইয়েচুরি সেই বার্তায় বলেছেন, বাংলার যুবদের কর্মসংস্থানের জন্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শিল্পায়নের যে চেষ্টা করেছিলেন তা বাস্তবায়িত হলে আজকে বাংলার যুবদের এই দুর্দশা হতো না। লক্ষ লক্ষ যুবক পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে অন্য রাজ্যে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াসের প্রাসঙ্গিকতা তাই আজকে আরও বেশি, ভবিষ্যতেও থাকবে।
সভার শুরুতেই শোকপ্রস্তাব পাঠ করে মহম্মদ সেলিম পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের লক্ষ্যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্বপ্ন ও প্রয়াসের উল্লেখ করেন। প্রবীণ সিপিআই(এম) নেতা বিমান বসুও বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে হলে মানুষের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ রক্ষায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাজ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে আরও বহু মানুষকে টেনে আনতে হবে আন্দোলনে, সেভাবেই যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করা হবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রতি।
একা নয়, সমষ্টিগত সংগ্রামের মধ্যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নিবেদিত জীবনের উল্লেখ করে সভায় মহম্মদ সেলিম বলেছেন, চোখের জল ফেলার জন্য নয়, সেই সমষ্টিগত সংগ্রাম তীব্র করার শপথ গ্রহণ করার জন্যই আমরা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে স্মরণ করছি। তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সব ঘাটতি দুর্বলতা দূর করতে হবে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দেওয়া স্লোগান উল্লেখ করে সেলিম বলেন, ‘এ লড়াই লড়তে হবে, এ লড়াই জিততে হবে।’ 
নতুন প্রজন্মের জন্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্বপ্নকে যারা হিংসাত্মক আক্রমণে হত্যা করেছে তাদের সম্পর্কে সেলিম বলেছেন, ওরা শুধু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাদা পোশাকে কালি ছেটায়নি, নতুন প্রজন্মের স্বপ্নকেও হত্যা করেছে। আজকে সারা রাজ্যে এবং দেশে মানুষ পথে নেমেছে। রাত জাগছে পিজিটি চিকিৎসককে অত্যাচার করে খুনের প্রতিবাদে ন্যায়বিচারের দাবিতে। একটা প্রশাসন কত অমানবিক, দু্নীতিগ্রস্ত ও দুষ্কৃতীচালিত হলে তবে সর্বশক্তি দিয়ে সেই অন্যায়কে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে! এই অন্যায় আসলে নতুন প্রজন্মের এগিয়ে চলার পথে বাধা সৃষ্টি করা, কিন্তু সেই বাধা ঠেলেই নতুন প্রজন্ম বরাবর ভবিষ্যৎগামী হয়েছে। এখনও আমাদের বামপন্থী ছাত্র-যুব কর্মীরা বুদ্ধদেব ভটাচার্যের মরদেহের পাশ থেকে গিয়ে নিহতের বাবা মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন লাশের সামনে। তাঁদের আক্রমণ করা হয়েছে, শ্লীলতাহানি করা হয়েছে, তবুও ন্যায়বিচারের দাবিতে তাদের লড়াই চলছে। 
সেলিম বলেন, সবার জন্য সমতা, অংশীদারিত্ব, নিরাপত্তা থাকবে এমন একটা সমাজের জন্যই লড়াই করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত বামফ্রন্ট সরকারকে ভাঙতে যারা আক্রমণ করেছিল তারা আসলে এই সমতা, অংশীদারিত্ব ও নিরাপত্তাকে চুরমার করতে চেয়েছিল। যুব আন্দোলনের থেকে নেতৃত্বে উঠে আসা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বেকারিবিরোধী লড়াই থেকে কখনো বিচ্যুত হননি, মন্ত্রী হয়েও নয়, মুখ্যমন্ত্রী হয়েও নয়। ভূমিসংস্কারের সাফল্যকে সংহত করে, বাংলার ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত করে তাদের মেধা দিয়ে তিনি বাংলাকে গড়তে চেয়েছিলেন। তিনি যে সঠিক ছিলেন তা প্রমাণিত হবেই। 
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মৃত্যুর দিনেও যারা তাঁর সমালোচনা করেছে তাঁদের রাজনীতিকে কুৎসিত বলে অভিহিত করে সেলিম বলেছেন, কোনও মানুষই পূর্ণ হয় না। কিন্তু রবীন্দ্রভাবনায় শাণিত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন পূর্ণতার অভিলাষী, পারিপাট্যে নজর ছিল তাঁর প্রখর। কথায় ও কাজে কোনও ফারাক রাখতেন না। আদর্শে অবিচল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্বচ্ছতা ও মূল্যবোধ দেখে কেউ কেউ বলেন তিনি ‘সময়ের একটু পরে’ আসা মানুষ। আবার তাঁর নতুন প্রজন্মের স্বপ্নপূরণে তাঁর আন্তরিক প্রয়াস দেখে কেউ কেউ বলেন, তিনি ‘সময়ের একটু আগে’ আসা মানুষ, আগামী দিনে নতুন প্রজন্মই তাঁকে সঠিকভাবে বুঝতে পারবে। শ্রমিক-কৃষক, মেহনতি মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে তাঁদের স্বপ্নপূরণে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। আর সাম্প্রদায়িকতা ও বিভেদকামীদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন কঠোর। এই কঠোরতা কারো কারো পছন্দ না হলেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শুধু ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন আগ্রাসী ধর্মনিরপেক্ষ।
সভায় স্মৃতিচারণা করে সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো সদস্য সূর্য মিশ্র বলেছেন, বামফ্রন্ট সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালীন একবার বি সি রায় শিশু হাসপাতালে শিশুমৃত্যুর ঘটনায় বিরোধীরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল সেখানে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আমাকে সেখানে যেতে বলেছিলেন। আমি মাথা গরম করে সেখানে না গিয়ে বলেছিলাম, ‘ঢুকতে বাধা দিলে যাবো কী করে!’ পরে উনি আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। শিশু চিকিৎসার উপযোগী করে তুলতে হাসপাতালের উন্নতি করিয়েছিলেন। 
মিশ্র বলেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তখন চিকিৎসকদের কথা না শুনে তিনি হাসপাতাল থেকে বাড়িতে চলে ফেরার জন্য জোর করছিলেন। খবর পেয়ে আমি তাঁকে বোঝাতে গিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরতে অনড় হয়ে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘মাই লাইফ ইজ মাই লাইফ।’ আমি তখন পার্টির রাজ্য সম্পাদক। তাঁকে বলেছিলাম, ‘না, আপনার জীবন পার্টির সম্পদ, জনসাধারণের সম্পদ। আপনাকে চিকিৎসকদের কথামতোই থাকতে হবে।’ এরপর তিনি কিন্তু আমার কথা মেনে নিয়েছিলেন। 
সভায় বিমান বসু স্মৃতিচারণা করে যুব সংগঠন গড়ে তোলা থেকে সংস্কৃতির প্রসারে, কলকাতা বইমেলাকে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় পরিণত করতে, জেলায় জেলায় বামপন্থী গণআন্দোলনের উপযোগী সংগঠন গড়ে তুলতে, মন্ত্রী হয়ে পরিষদীয় কর্তব্য পালনে, ইত্যাদি নানা কাজে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অবদান উল্লেখ করে বলেছেন, আজকাল সরকারের মন্ত্রীদের মুখে যেসব কথা শুনতে পাই, যে ভাষা সন্ত্রাস দেখতে পাই তা কখনো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আচরণে ছিল না। সংগঠনের দায়িত্বে ভাসাভাসা কাজে তিনি বিশ্বাস করতেন না, গভীরে ঢুকে কাজ করতেন। যে জেলায় যেতেন সেখানে কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা বুঝে যথাসম্ভব সমাধান দিয়ে আসতেন। 
এদিনের স্মরণ অনুষ্ঠানে সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো সদস্য নীলোৎপল বসু, রামচন্দ্র ডোম সহ পার্টি নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন, জেলাগুলি থেকেও বহু পার্টি নেতা ও কর্মীরা এসেছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন মহম্মদ সেলিম। আর জি কর হাসপাতালে পিজিটি চিকিৎসকের খুনের ঘটনায় অপরাধীদের শাস্তি দাবি করে এবং তাঁর মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপন করে এক মিনিট নীরবতা পালন করেছে গোটা সমাবেশ।
 

Comments :0

Login to leave a comment