বর্ধমানের শক্তিগড়ে ল্যাংচার দোকানের সামনে ফিল্মী কায়দায় প্রকাশ্য শুটআউটের ঘটনায় সামনে আসছে একাধিক গুরুতর প্রশ্ন। ঘটনার পরতে পরতে রহস্যের পাশাপাশি রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ ছবিও সামনে এসেছে।
চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়েছে, অথচ প্রকাশ্যে ছয় রাউন্ড গুলি চালিয়ে কয়লা মাফিয়া রাজু ঝা’র খুনের ঘটনায় একজনকেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি। পুলিশ ধামাচাপা দিতে চাইলেও জানা গেছে হামলাকারীরা একটি নয়, দুটি গাড়িতে করে এসেছিল।
আবার সোমবারই দিল্লিতে কয়লা পাচারকাণ্ডে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তলবে হাজির হওয়ার কথা ছিল রাজু ঝা’র। কলকাতা থেকে বিমানেই দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল। তার আগের রাতেই এমন হত্যাকাণ্ড, স্বাভাবিকভাবেই অনেক প্রশ্ন সামনে আনছে। রাজু ঝা’র বয়ান কি কোনও প্রভাবশালী মহলকে আরও বিপদে ফেলতে পারতো?
তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকা।
ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে খুন হওয়া কয়লা মাফিয়া রাজেশ ঝা ওরফে রাজু ঝা’র সঙ্গেই গাড়িতে ছিলেন ইলামবাজারের বাসিন্দা শেখ আবদুল লতিফ। শুধু তাই নয়, সাদা রঙের দামি ফরচুনা গাড়িটি (ডব্লিউবি ৪৮ডি ৭০৩২) আবদুল লতিফের নামেই কেনা হয়েছিল। ২০২০ সালে গাড়িটি কেনা হয়। শেখ আবদুল লতিফ গোরু পাচারকাণ্ডে অভিযুক্ত। আসানসোল আদালতে গত বছরের আগস্টেই গোরু পাচারকাণ্ডে চার্জশিট দিয়েছিল সিবিআই। তারপর থেকেই ফেরার আবদুল লতিফ। সেই লতিফের গাড়িতে করেই শনিবার সন্ধ্যায় দুর্গাপুর থেকে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন কয়লা মাফিয়া রাজু ঝা। গাড়ির পিছনের আসনে বসেছিলেন লতিফ।
গত আট মাস ধরে ফেরার ছিল লতিফ। বাংলাদেশেও কয়েকমাস গা ঢাকা দিয়েছিল। সিবিআই নাকি খুঁজে পাচ্ছিল না তাকে। সেই লতিফকেই শনিবার রাতে গুলিকাণ্ডের পরেও আক্রান্ত গাড়িটির সামনে বেশ কিছুক্ষণ দেখা যায়। এমনকি তাকে ফোনেও কথা বলতে দেখা যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে তদন্তের স্বার্থেই গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যক্তি কীভাবে পুলিশের সামনে দিয়েই স্রেফ হাওয়ায় মিশে গেল? ঘটনার পরেই ঘটনাস্থলে এসেও পুলিশ চিনতে পারল না আবদুল লতিফকে, যাকে সিবিআই খুঁজছে গত কয়েকমাস ধরে? পুলিশি অপদার্থতা নিয়েও তাই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এমনকি লতিফ গাড়িতে ছিল প্রাথমিক ভাবে পুলিশ সেটাও স্বীকার করতে চাইছিল না। অথচ ল্যাংচার দোকানের সিসিটিভি ফুটেজেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে শুট আউটের পরেও দাঁড়িয়ে আছে সেই গাড়িটি। সামনে কাচ ছড়িয়ে ছিটিয়ে, গাড়িতে গুলি আর রক্তের দাগ। আর সেই গাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলে চলেছেন গোরু পাচারকাণ্ডে অভিযুক্ত আবদুল লতিফ।
ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শীও বটে। আততায়ীদের চিহ্নিত করতে লতিফকে জেরা করা রাজু ঝা হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। যে গাড়িতে গুলি চলল সেই গাড়িতেই ছিলেন লতিফ, তারপরেও পুলিশ তাকে আটকানোর চেষ্টা করল না? কোথায় গেল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কাছে অধরা লতিফ? পুলিশের তরফে কোনও উত্তর দিতে অস্বীকার করা হচ্ছে। ঘটনাক্রমে নজর রাখছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই’ও।
রাজ্য পুলিশের একটি সূত্রে রবিবার জানা গেছে চাঞ্চল্যকর আরও একটি তথ্য।
একটি নয়, আততায়ীরা এসেছিল দুটি গাড়িতে। অর্থাৎ ঘটনাস্থলে রাজু ঝা যে গাড়িতে ছিলেন সেই গাড়িতে হামলা চালানোর জন্য দুষ্কৃতীরা এসেছিল দুটি গাড়িতে করে। তবে পুলিশের তরফে এই নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
শনিবার রাত পর্যন্ত পুলিশের তরফে জানানো হয় নীল রঙের একটি ব্যালেনো গাড়িতে করে আততায়ীরা এসেছিল। ঐ গাড়ি থেকেই রাজু ঝাকে লক্ষ্য করে পরপর ছটি গুলি চালানো হয়। তারপর কলকাতার দিকে চলে যায় গাড়িটি। এদিকে রবিবার সকালে শক্তিগড় স্টেশনের কাছে ঐ গাড়িটির হদিশ মেলে। গাড়িটি রাস্তার ধারে ফেলে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা। মনে করা হচ্ছে সড়কপথে না গিয়ে শক্তিগড় স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে পালিয়েছে দুষ্কৃতীরা। ঐ গাড়িটির ভিতরে কয়েকটি মদের বোতল, কয়েকটি ভুয়ো নম্বর প্লেটও পাওয়া গেছে।
তবে এদিনই একটি সূত্রে জানা গেছে আরও একটি গাড়ি ছিল। সেই গাড়িতেই ছিল আততায়ীরা। ভাড়াটে শার্প শুটার দিয়েই অপারশেন চালানো হয় বলে দাবি পুলিশের একাংশের। একটি সূত্র থেকে জানা গেছে দ্বিতীয় ঐ গাড়িতেই ছিল শার্প শুটার। সেখান থেকেই রাজু ঝা’র গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চলে। রাজু ঝা সামনের আসনে বসে ছিলেন।
জানা গেছে, শনিবার সন্ধ্যা ছটা দশ নাগাদ দুর্গাপুরে তাঁর নিজের হোটেল থেকে রওনা দেন রাজু ঝা। দুর্গাপুরের হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজেও দেখা গেছে লবিতে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন রাজু ঝা ও আবদুল লতিফ। তাদের মধ্যে বৈঠকও হয়। গাড়িতে রাজুর সঙ্গে ছিল বেনাচিতির বাসিন্দা বারিন মুখার্জি, আবদুল লতিফ। নুর নামে এক যুবক গাড়ি চালাচ্ছিল। রাজু ঝা’র মৃত্যু হয় ঘটনাস্থলেই। দুটি গুলি সরাসরি তাঁর বুকে লাগে। পিছনের আসনে বসে থাকা বারিন মুখার্জিও জখম হন, তাঁর বা হাতে গুলি লাগে। কোনমতে দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন আবদুল লতিফ। আর গাড়ির চালক হামলার কয়েক মিনিট আগেই বাথরুমে যান। বারিন মুখার্জি আর গাড়ির চালক নুর এখন পুলিশের হাতে। তাঁরা প্রত্যক্ষদর্শীও বটে। তারপরেও চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়েছে। পুলিশ হামলাকারীদের সম্পর্কে কোনও তথ্যই দিতে পারছে না।
লালার নেটওয়ার্ক সিবিআই তদন্তের ঠেলায় বন্ধ। আসানসোল কয়লাঞ্চলে তবে কি ফের নতুন করে পা বাড়ানোর চেষ্টা করতেই এই গুলি খেতে হলো কয়লা মাফিয়া রাজু ঝাকে? বর্ধমানের বিস্তীর্ণ চত্বরে বালিঘাটের বরাত, অন্যদিকে ইসিএলের কয়লার ডিও’র বরাত-ক্রমেই ক্ষমতাসীন মাফিয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে বিরোধ তীব্র হচ্ছিল রাজু ঝা’র। এর আগে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি দুর্গাপুরের সিটি সেন্টারের অম্বুজা কলোনিতে বেসরকারি পরিবহণ সংস্থার দপ্তরের দরজার সামনে গুলি চলে। রাজু ঘনিষ্ঠ লোকেশ সিংয়ের দপ্তরে সেই হামলার লক্ষ্যও রাজু ছিল মনে করা হচ্ছে। রাজু ঝা’র সঙ্গে বিজেপি’র সখ্য ২১’র ভোটের সময় দেখা গেলেও পরবর্তীকালে রাজনীতিতে দেখা যায়নি তাকে। তবে বিজেপি’র সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র ছিল।
Comments :0