মনোজ আচার্য
বেকাররা যে শ্রমের মজুত ভাণ্ডার এবং তাদের দেখিয়ে মালিকরা কীভাবে শ্রমিকদের ওপরে চাপ সৃষ্টি করে, বেশি খাটিয়েও মজুরি কম দেয়, কার্যত আধা বেকারে পরিণত করে শ্রমিকদের সেই নিদর্শন বাড়ছে কলকাতা শহরেও। এখানে মুম্বাই বেঙ্গালুরু কিংবা কেরালার মতো কাজের সুযোগও নেই, কাজের মজুরিও নেই। বিপুল মজুত বেকার বাহিনীকে দেখিয়ে কর্মরতদের সঙ্গেও এখানে অমানবিক আচরণ করে কর্তৃপক্ষ। এরাজ্যে উৎপাদনমূলক শিল্প না থাকায় কেবল ব্যবসায়ীরা বিপণনের কাজ করাচ্ছে, তার জন্য সামান্য মজুরিতে নিয়োগ করছে বেকারদের, টার্গেট পূরণ করতে না পারলেই ছাঁটাইয়ের হুমকি মুখে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হচ্ছে তাঁদের।
৫ লাখ টাকার উপরে ব্যবসা দিলে তবেই হাজার পাঁচেক টাকার বেতন মিলবে। এর উপর বাড়তি ব্যবসা দিলে তবেই মিলবে ইনসেনটিভস। যে মাসে টার্গেট পূরণ হয় না, সে মাসে বেতনের টাকা জোটানোও মুশকিল। আর যে মাসে ইনসেনটিভস হয় না সে মাসে সংসার খরচে অনেক কিছুই কাটছাঁট করতে হয়। তাছাড়া প্রতিনিয়ত কাজ চলে যাওয়ার আতঙ্ক তো রয়েছেই। বর্তমানে দুর্বিষহ অবস্থায় এরাজ্যের লক্ষ লক্ষ যুবক যুবতীর জীবিকা।
কলকাতা মহানগরে বসবাসকরী শিক্ষিত যুবক যুবতীদেরও এই একই অবস্থা! রাজ্যজুড়ে কাজের চরম আকাল। নতুন শিল্প কলকারখানা গড়ে ওঠার বালাই নেই। বহু কল কারখানও বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি দপ্তরেও নেই নিয়োগ। এই পরিস্থিতিতে জীবিকার জন্য হাপিত্যেশ করা এরাজ্যের বহু যুবক-যুবতী রোজগারের জন্য বিভিন্ন বহুজাতিক, কর্পোরেট সংস্থা থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নামমাত্র বেতনে কাজ করে কোনোমতে জীবনধারণ করে পরিবার নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের হতাশাগ্রস্ত জীবন নাগাল পায়না মমতা ব্যানার্জির উন্নয়ন ও মোদীর আচ্ছে দিনের।
কাজের এই আকালের বাজারে মহানগরের বহু শিক্ষিত ছেলে মেয়ে উপায়ন্তর না পেয়ে শেষমেশ এমন অনিশ্চিত জীবনের জীবিকাকে অবলম্বন করে রুজিরুটির বন্দোবস্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
রাজ্যে নতুন শিল্প কলকারখানার দেখা না মিললেও যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে শপিং মল থেকে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার অফিস। এদের দরকার সস্তার শ্রমিক-কর্মচারী। বেকারির যন্ত্রণায় দগ্ধ এরাজ্যের হাজার হাজার বেকার বাধ্য হয়ে এধরনের সংস্থাগুলোতে টার্গেট বেসড জবে যোগ দিচ্ছে। এই হাজার হাজার বেকারের পরিশ্রমকে ব্যবহার করে সংস্থাগুলি কোটি কোটি টাকার মুনাফা লুটছে এবং তার বদলে নামমাত্র বেতন দিচ্ছে শ্রমিক-কর্মচারীদের।
এই টার্গেট বেসড জবে যুক্তদের অবস্থা কেমন? তারা কি চাইছেন? রাজ্য ও দেশের বর্তমান পরস্থিতি নিয়ে কি অভিমত তাদের? তারই একটা ভাষ্য ধরা পড়ল ময়দানে এই দাবদাহের মধ্যে। মহানগরের অলিতে গলিতে এই প্রচণ্ড রোদের তেজের সঙ্গে যুঝে ক্লান্ত ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে একটু স্বস্তির জন্য অনেকেই এসে ময়দান বা ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের গাছের নিচে বসেন। এদের একটা বড় অংশই বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা, বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোতে কাজ করেন। কেউ লোন বিভাগে, কেউ অ্যাকাউন্ট ওপেনিং, আবার কেউ বেসরকারি বিমা থেকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের কাজ করেন।
তাদের মধ্যেকার কথাবার্তা শুনলেই বোঝা যায় জীবিকা নিয়ে কি নিদারুণ হতাশার রোজনামচার জীবন তাদের। কথা হচ্ছিল জয়দেব দাস নামের বছর তিরিশের এক যুবকের সঙ্গে। এক বেসরকারি ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট ওপেনিং এর কাজ করেন। বলছিলেন, এ মাসটা এখনও কিছুই হলো না। একটা অ্যাকাউন্টও এখনও খোলাতে পারিনি। গত মাসে টার্গেট পুরন না হওয়াতে বস সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন এমাসে দশটা অ্যাকাউন্ট ওপেনিং না করতে পারলে আমাকে টার্মিনেট করে দেওয়া হবে।
মুথুট ফাইনান্সে কর্মরত এক যুবকের কথায়, বাবা অনেক টাকা খরচ করে বিবিএ পড়িয়েছেন, কিন্ত শেষমেশ ঢুকতে হলো এই ফিনান্স কোম্পানিতে। টার্গেট পূরণ না হলে ম্যানেজারের গালাগাল, দুর্ব্যবহার, ছাঁটাইয়ের হুমকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।
করোনা,লকডাউনের সময় আমাদের যে কি দুরবস্থা হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। বলছিলেন হাওড়ার যুবক বিপ্লব কর্মকার। কোম্পানি বেতন বন্ধ করে দিয়েছিল। আসলে আমাদের পরিশ্রমে মোটা টাকা মুনাফা করার পরই আমাদের বেতন বাবদ কিছু দেওয়া হয়। ওই সময় ব্যবসা দিতে পারিনি তাই বেতনও দেয়নি।
এরকমই চরম হতাশার কথা শোনা যাচ্ছে মহানগরের বিভিন্ন শপিং মলে কাজ করা ছেলেমেয়েদের মুখেও। কত টাকার সেল কোন কাউন্টার থেকে হলো তার ওপর ভিত্তি করেই বেতন নির্ধারণ। কোম্পানি লাভের জন্য ব্যবসা করছে এটা ঠিকই। কিন্তু তাদের মুনাফার পরিমান ও কর্মচারীদের বেতনের মধ্যে যে চূড়ান্ত বৈষম্য রয়েছে তা দূর করতে সরকারের কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বলছিলেন এক সংস্থার প্রোডাক্ট বিক্রেতা। কিন্তু তেলেভাজা শিল্প আর পকৌড়া শিল্প দেখিয়ে যারা শিল্পায়নের দাবি করে তারা সরকারের এসব করণীয় নিয়ে ভাবছে কই!
গত দশ পনেরো বছরে এরাজ্যে উৎপাদন শিল্প, বুনিয়াদি শিল্প চরম ধাক্কা খাওয়ার প্রভাব পড়েছে শ্রমের বাজারে কর্মরতদের ওপরেও। একদিকে বিপুল বেকার বাহিনীকে দেখিয়ে তাঁদের দিয়ে সস্তায় কাজ করিয়ে নিচ্ছে মালিকরা। অন্যদিকে মানুষের হাতে টাকা না থাকায় বিপণনের কাজে যুক্ত কর্মীদের কাজ, টার্গেট পূরণ করা আরও অনেক বেশি কঠিন হয়ে গেছে। কিন্তু মালিক কর্তৃপক্ষকে তা বোঝাবে কে? তারা চাবুক হাতে কাজ করিয়ে নিতে চাইছে।
মে দিবস আসছে। কিন্তু শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার আক্রমণ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। নির্বাচনী সংগ্রামেও মে দিবসের বার্তাকে হাতিয়ার করে অধিকার অর্জনের লড়াইকে তাই শক্তিশালী করতে চাইছে ট্রেড ইউনিয়নগুলি। সংসদে শ্রমিক, বেকার সবার কথা সোচ্চারে যারা বলতে পারবে তারাই রক্ষা করতে পারবে শ্রমজীবীদের অধিকার।
Comments :0