Lancet R G Kar

ভারতে চিকিৎসা ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানালো ল্যানসেটও

আন্তর্জাতিক

কলকাতা দিয়েছিল ডাক, ‘রাত দখল করো মেয়েরা’। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ১৪ আগস্ট রাতে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় গোটা রাজ্যই নেমে এসেছিল রাস্তায়। সেই সঙ্গে সেই রাতেই দেশের নানা জায়গায়, এমনকী বিদেশেও বিভিন্ন শহরে রাস্তায় নেমে আর জি করের নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন মানুষ। সেই শুরু। ক্ষোভের আগুন জ্বলছেই। এবার বিশ্বে চিকিৎসা বিজ্ঞানের শীর্ষস্থানীয় সাময়িকপত্র দ্য ল্যানসেট তুলে ধরলো কলকাতার সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক-ছাত্রীর ধর্ষণ-খুনের ঘটনাকে, সামনে নিয়ে এল ভারতে চিকিৎসার কাজে যুক্ত ব্যক্তিদের দুঃসহ কাজের পরিবেশকে। সারা বিশ্বেই বিশেষত চিকিৎসক এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষকদের কাছে দ্য ল্যানসেট প্রথম পছন্দ। ফলে এই পত্রিকার পৃষ্ঠায় আর‍‌ জি করের নৃশংসতার বিবরণ ও বিশ্লেষণ ঘটনার প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের আরও বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। ল্যানসেটের পাশাপাশি শ্রমিক-কর্মচারীদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব ট্রেড ইউনিয়নস (ডব্লিউএফটিইউ)-ও আর জি করের ঘটনার কড়া নিন্দা করে এবং অপরাধীদের শাস্তি ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কর্মরতদের যথাযথ নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে রবিবার চিঠি দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রধান সচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগম, কেন্দ্রের স্বাস্থ্য মন্ত্রী জে পি নাড্ডা এবং কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী প্রতাপরাও যাদবকে।
ল্যানসেটে আর জি করের ঘটনাকে এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছেন দীনেশ সি শ‌র্মা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মরত অবস্থায় কলকাতার আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে এক রেসিডেন্ট ডাক্তারের বর্বর যৌন নির্যাতন ও খুনের ঘটনায় স্থানীয় পুলিশ এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেপ্তার করলেও রেসিডেন্ট ডাক্তাররা তাতে সন্তুষ্ট নন। তাঁরা পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবিতে ধর্মঘটে শামিল হয়েছেন। ভারতের চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-ও (আইএমএ) এই দাবিকে সমর্থন জানিয়ে চিকিৎসায় যুক্ত সমস্ত পেশাদার ব্যক্তির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছে এবং সারা দেশে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। কিন্তু ঘটনা এটুকুই নয়। আর জি করের ঘটনা চিকিৎসায় যুক্ত কর্মীদের কাজের জায়গার খারাপ পরিবেশ এবং কাজের সময়ের অমানবিক বোঝাকে সামনে নিয়ে এসেছে। আইএমএ-ও বিশেষ করে ভারতের গ্রামীণ ও জেলা হাসপাতালগুলিতে মহিলা চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সংগঠন বলেছে, নিরাপত্তার অভাবের কারণেই একটি মহানগরীতে এক বিরাট হাসপাতালে এমন নৃশংস অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। এমনকী ঘটনার পরে বিক্ষোভের মধ্যে ওই হাসপাতালে হামলাও চালানো হয়েছে। একটি বড় শহ‍‌রে উন্নত স্তরের হাসপাতালেই যদি এমন ঘটতে পারে, তাহলে জেলা হাসপাতালে বা গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মহিলা চিকিৎসকদের নিরাপত্তা থাকতে পারে কীভাবে! আইএমএ’র সভাপতি আর ভি অশোকান বিমানবন্দরের মতো হাসপাতালগুলিকেও ‘নিরাপদ অঞ্চল’ বলে ঘোষণা করার এবং চিকিৎসকদের উপর আক্রমণ প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় আইনের যে দাবি জানিয়েছেন, তাও উল্লেখ করেছে দ্য ল্যানসেট। পত্রিকার প্রতিবেদনে এই সঙ্গেই বলা হয়েছে, ভারতে ২৫টি রাজ্যে চিকিৎসকদের উপর হামলা প্রতিরোধে আইন থাকলেও সেগুলি কাজে আসছে না। অপরাধীদের শাস্তিদানের হার খুবই কম। আইএমএ’র পক্ষ থেকেও দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে তা জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেই চিঠিতে আইএমেএ বলেছে, এই তরুণী চিকিৎসকের হত্যাকাণ্ড প্রথম ঘটনা নয়, উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে এটি শেষ ঘটনাও হবে না। ল্যানসেট তার প্রতিবেদনে আইএমএ’র এই বক্তব্য প্রকাশ করে বুঝিয়ে দিয়েছে, পত্রিকাও চিকিৎসকদের সর্বভারতীয় সংগঠনের এই অভিমতের সঙ্গে সহমত। 
ডব্লিউএফটিইউ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রের স্বাস্থ্য মন্ত্রী সহ পাঁচ জনকে যে চিঠি দিয়েছে, তাতেও আর জি করের ঘটনার নিন্দা করার পাশাপাশি ভারতে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, আর জি করের ভয়াবহ ঘটনায় জনগণের ব্যাপক ক্ষোভ এবং ‘রাত দখল করো’ কর্মসূচিতে বিরাট সাড়া মহিলাদের নিরাপত্তাহীনতার সমস্যার গভীরতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। কলকাতা হাইকোর্ট এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করলেও অপরাধীদের গ্রেপ্তারে দেরিতে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ভারতে সাংবিধানিক সুরক্ষা এবং আইনি ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও মহিলাদের উপর অত্যাচারের ঘটনা অব্যাহত। আর জি করের ঘটনা দেখিয়ে দিলো, মহিলাদের অধিকার ও জীবন রক্ষায় সুসংহত পদক্ষেপ কতটা জরুরি, বিশেষত যাঁরা হাসপাতালের মতো খোলা পরিবেশে কাজ করেন। নিরাপত্তার পাশাপাশি ডব্লিউএফটিইউ’র চিঠিতে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ব্যাপক দুর্নীতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ডব্লিউএফটিইউ বলেছে, ভারতে তাদের অনুমোদিত সংগঠনগুলির কাছ থেকে ওই দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গিয়েছে। সমস্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তারাও আর জি করের ঘটনার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তাদের দাবি, সিবিআই-কে দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে চিকিৎসক-ছাত্রীর ধর্ষণ ও খুনের অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে, সমস্ত সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে এবং ভারতের সব মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। ডব্লিউএফটিইউ’র তরফে এই চিঠি লিখেছেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পামবিস কিরিটসিস।  

Comments :0

Login to leave a comment