দলমত নির্বিশেষে শ্রদ্ধা প্রয়াত মনমোহন সিংকে
বৃহস্পতিবার রাতেই জাতীয় পতাকায় ঢেকে প্রয়াত মনমোহন সিংয়ের দেহ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর মোতিলাল নেহরু রোডের বাসভবনে। শুক্রবার সকাল থেকেই সেখানে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হন দলমত নির্বিশেষে দেশের রাজনীতিবিদরা। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু, উপ রাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং, বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডার পাশাপাশি কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে, সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী প্রমুখ বাসভবনে গিয়ে শ্রদ্ধা জানান। বেশ কয়েকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও দিল্লিতে এসে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানান। বেশিরভাগ সময়ে মরদেহের পাশে ছিলেন স্ত্রী গুরশরণ কাউর সহ পরিবারের সদস্যরা। শনিবার সকালে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে কংগ্রেসের সদর দপ্তরে। আরও বহু মানুষকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ করে দিতে কংগ্রেস দপ্তরে মরদেহ রাখা হবে ঘণ্টাখানেক। সকাল সাড়ে ৯টায় শুরু হবে মরদেহ নিয়ে নিগমবোধ ঘাট শ্মশান অভিমুখে অন্তিম যাত্রা। সেখানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৫১ মিনিটে দিল্লির এইমসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মনমোহন সিং। তাঁর মৃত্যুতে সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের কথা ঘোষণা করা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে। তবে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কেন্দ্রের সরকারের কাছে এমন কোনও জায়গায় প্রয়াত মনমোহন সিংয়ের শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানানো হয়েছিল, যেখানে তাঁর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা যাবে। কিন্তু মোদী সরকার সেই অনুরোধে সাড়া দেয়নি।
দেশ-বিদেশের অগণিত রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রপ্রধান, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের তরফে শোক জানানো হয়েছে মনমোহন সিংয়ের জীবনাবসানে। এদিন সকালে নয়াদিল্লিতে জরুরি ভিত্তিতে বৈঠকে বসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা। সেখানেই সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সময়কালে সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা থাকবে। মন্ত্রীসভার বৈঠকে প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর স্মরণে দু’মিনিট নীরবতা পালনের পাশাপাশি একটি শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সেই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘‘জাতীয় জীবনে পদচিহ্ন রেখে গিয়েছেন ড. মনমোহন সিং। তাঁর মৃত্যুতে দেশ হারালো একজন বিশিষ্ট রাষ্ট্রনায়ক, স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ এবং স্বতন্ত্র মাত্রার রাজনীতিবিদকে।’’ প্রধানমন্ত্রী মোদী শোক জানিয়ে এদিন বলেছেন, ‘‘ওঁর জীবন সবসময়ে আগামী প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। কীভাবে একজন ব্যক্তি যাবতীয় বঞ্চনাকে উপেক্ষা করে কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সাফল্যের উচ্চ শিখরে পৌঁছেছিলেন, তা সত্যি শিক্ষণীয়। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেশের উন্নয়ন এবং অগ্রগতিতে তাঁর অবদান চিরস্মণীয় হয়ে থাকবে।’’
এদিন মোতিলাল নেহরু রোডের বাসভবনে গিয়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে শেষ শ্রদ্ধা জানান তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন, অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু, হিমাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সুখবিন্দর সিং সুখু, তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী রেবন্ত রেড্ডি এবং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী আতিশী। এরই পাশাপাশি শ্রদ্ধা জানান দিল্লি এবং উত্তর প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী যথাক্রমে অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও অখিলেশ সিং যাদব। শোক জানিয়ে এদিন বিবৃতি দিয়েছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সহ বামপন্থী দলগুলি। আরজেডি প্রধান লালুপ্রসাদ যাদব বলেছেন, ‘‘মনমোহন সিংয়ের মৃত্যু দেশের পক্ষে বড় ক্ষতি। একজন সৎ ব্যক্তি ছিলেন। ওঁর অধীনে মন্ত্রী ছিলাম আমি, সবসময় সমর্থন পেয়েছি। সততা এবং চমৎকার অর্থনৈতিক নীতির জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’’
মনমোহন সিংয়ের সময়ে ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে যিনি দেশে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন প্রচার মাধ্যমের একটি বড় অংশের সাহায্যে, সেই আন্না হাজারে এদিন শোক জানাতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘উনি ছিলেন দুর্নীতির ঘোরতর বিরোধী। লোকপাল এবং লোকায়ুক্ত নিয়ে তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি দেশের কথাই ভাবতেন। দেশের অর্থনীতিকে এক নতুন অভিমুখ দিয়েছিলেন।’’ মনমোহন সিংয়ের কট্টর সমালোচক আরএসএস-ও শোক জানাতে গিয়ে বলেছে, ‘‘ওঁর অবদান চিরকাল মনে রখবে ভারত।’’ সংগঠনের প্রধান মোহন ভগবত এবং সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবালে শোক জানিয়ে বলেছেন, ‘‘ওঁর মৃত্যুতে গোটা দেশ শোকস্তব্ধ।’’ সংগঠনের তরফে দিল্লিতে মনমোহন সিংয়ের মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান যুগ্ম সম্পাদক অলোক কুমার।
কর্নাটকের বেলাগাভিতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত অধিবেশন চলছিল। বৃহস্পতিবার রাতে মনমোহন সিংয়ের মৃত্যুর খবর পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে ওখান থেকে দিল্লি চলে আসেন রাহুল গান্ধী, মল্লিকার্জুন খাড়গে, জয়রাম রমেশ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। শুক্রবারের ‘জয় ভীম, জয় বাপু, জয় সংবিধান’ সমাবেশও বাতিল করে দেওয়া হয়। এদিন নয়াদিল্লিতে দলের সদর দপ্তরে দ্রুত বৈঠকে বসে প্রয়াত নেতাকে স্মরণ করে শোকপ্রস্তাব নেওয়া হয়। সদর দপ্তরে প্রয়াত মনমোহন সিংয়ের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান মল্লিকার্জুন খাড়গে, সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, জয়রাম রমেশ এবং কে সি বেণুগোপাল। দলের তরফে শোকপ্রস্তাবে মনমোহন সিং-কে ‘একজন প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘‘ওঁর জীবন এবং কাজকর্ম ভারতের ভবিষ্যৎকে প্রগাঢ় রূপ দিয়েছে।’’ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘ভারতের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মানচিত্রে এক জন স্বনামধন্য ব্যক্তি ছিলেন ড. মনমোহন সিং। তাঁর অবদানে রূপান্তর ঘটে দেশের, যা প্রশংসা পায় গোটা বিশ্বের। তিনিই হলেন নয়া উদারবাদী অর্থনীতির স্থপতি। অতুলনীয় দূরদর্শিতায় তিনি একাধিক সংস্কারের নীতি গ্রহণ করে লেনদেন ভারসাম্যের সঙ্কটের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন দেশকে। তিনি বিনিয়ন্ত্রণ, বেসরকারিকরণ এবং বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহ জোগানের নীতি গ্রহণ করায় দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক বিকাশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। তাঁর নেতৃত্বেই ভারত বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুততম বিকাশশীল অর্থনীতির দেশ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী মন্দার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।’’ এরই পাশাপাশি তাঁর এক দশকের শাসনকালে কেন্দ্রের সরকার কী কী জনমুখী নীতি নিয়েছিল, তার তালিকা তুলে ধরা হয়েছে বিবৃতিতে।
বস্তুত মনমোহন সিংয়ের সবচেয়ে বড় পরিচিতি হলো অর্থনীতিবিদ হিসাবে। কেমব্রিজ এবং অক্সফোর্ডের কৃতী পড়ুয়া হিসাবে তাঁর সুনাম ছিল যথেষ্ঠই। পরবর্তীকালে তিনি আসেন রাজনীতিতে। তাঁর মৃত্যুতে স্বাভাবিকভাবেই শোক প্রকাশ করেছেন দেশ-বিদেশের অর্থনীতিবিদ থেকে শিক্ষাজগতের মানুষজন। আইএমএফ’র অন্যতম প্রাক্তন শীর্ষকর্তা তথা অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ এক্স হ্যান্ডেলে বলেছেন, ‘‘ড. মনমোহন সিংয়ের ১৯৯১ সালের বাজেট ভারতীয় অর্থনীতির বাঁধন খুলে দেয়। এর ফলেই তৎপর্যপূর্ণভাবে ভারতের লক্ষ লক্ষ জনগণের আর্থিক বিকাশের পথ সুগম হয়। তাঁর ভাবনার সংস্কার আমার মতো তরুণ অর্থনীতিবিদকে উৎসাহিত করেছে।’’ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন বলেছেন, ‘‘তিনি ছিলেন এক জন চৌখস অর্থনীতিবিদ। ভারতের ক্ষমতা সম্পর্কে ছিল সম্যক ধারণা, এর সঙ্গে মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন রাজনৈতিক সম্ভাব্যতাকে।’’ বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলেছেন, ‘‘মনমোহন সিংয়ের ছিল ধারালো বুদ্ধিমত্তা, সহজাত বিনয় এবং ব্যক্তিগত সততা— যা রাজনীতির জগতে বিরল। এই কারণেই শুধু দেশ নয়, গোটা বিশ্বের কাছেই তিনি সমাদৃত হন।’’
রজনীকান্ত, কমল হাসান, চিরঞ্জীবী, মনোজ বাজপেয়ী, মাধুরী দীক্ষিত, সানি দেওল, অনুষ্কা শর্মা, অনিল কাপুর, দিলজিৎ দোসাঁঝরা, স্বরা ভাস্কর, আয়ুষ্মান খুারানা সহ একাধিক বলিউডের তারকা প্রয়াত মনমোহন সিংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁকে একজন ‘স্বপ্নদর্শী’ এবং ‘অর্থনৈতিক সংস্কারের মহান ব্যক্তিত্ব ও রাষ্ট্রনায়ক’ বলে অভিহিত করেছেন।
Comments :0