শ্যামল কুমার মিত্র
এবছর রাজ্যের ৪৫,০০০ পূজা কমিটিকে ১,১০,০০০ টাকা করে সরকারি অনুদান দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মোট খরচ ৪৯৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সাল থেকে সরকার এই খাতে খরচ করেছে মোট ১,৯৫২ কোটি টাকা। এর উপরে বিদ্যুৎ বাবদ ছাড়, পৌরসভা ও দমকলের ফি মকুব, হোর্ডিং বাবদ বিজ্ঞাপনের কর মকুব ধরলে প্রকৃত সরকারি ব্যয় উপরোক্ত অর্থাঙ্কের অনেক অনেক বেশি। এ বছর যে সব পুজোর বাজেট ৫ লক্ষ টাকা, তারা সরকারি অনুদান ও ছাড় মিলিয়ে মোট সুবিধা পাচ্ছে ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার। যে পুজোর বাজেট ২৫ লক্ষ টাকা তাদের অনুদান ও ছাড় বাবদ মোট সরকারি সুবিধার পরিমাণ ২ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকার। এইভাবে পুজোর বাজেট যত বেশি, প্রাপ্য সরকারি অনুদান তত বেশি।
আমাদের দেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে, মৌলিক অধিকারের ২৮ নম্বর ধারায় বলা আছে, (১)সরকারি অর্থে চলে, এমন কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া যাবে না। (২) যদি কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি সাহায্য/স্বীকৃতি নেয়, তবে সে প্রতিষ্ঠানে পাঠরত কাউকে ধর্মীয় শিক্ষায় অংশ নিতে বাধ্য করা যাবে না। ২৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, "কোন ব্যক্তিকে এ রকম কোনো কর দিতে বাধ্য করা যাবে না, যা কোনও একটি ধর্মের/ধর্মীয় গোষ্ঠীর উন্নয়ন/রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যয়িত হবে।" অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে মানুষের করের টাকা কোনও এক বা একাধিক ধর্মের মানুষের ধর্মীয় অনুষ্ঠান/উপাসনালয় তৈরি/রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যয় করতে পারে না সরকার। জনগণের করের অর্থ থেকে কোনও একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আচার পালনকারীদের অর্থিক সাহায্য সংবিধানের সাম্যের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত ১৪, ১৫ এবং ১৬ নম্বর ধারারও বিরোধী। এরপরেও সরকার ইমাম, মুয়াজ্জিন, পুরোহিতদের সরকারি অর্থে ভাতা দিচ্ছে,মন্দির নির্মাণ করছে, ২০১৮ সাল থেকে দুর্গাপূজায় অনুদান দিচ্ছে। এগুলির প্রত্যেকটি স্পষ্টতই সংবিধান বিরোধী।
২০১১ সালে পূর্বতন সরকার ১,৯২,০০০ কোটি টাকা ঋণ রেখে গিয়েছিল যার মধ্যে ৭৯,০০০ কোটি টাকা 'স্বল্প সঞ্চয়' বাবদ বাধ্যতামূলক ঋণ। অর্থাৎ ১৯৪৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পূর্বতন সরকারগুলি স্বেচ্ছায় যে ঋণ নিয়েছিল এবং শোধ করেছিল তার পরে মোট ঋণভার ছিল ১,১৩,০০০ কোটি টাকার। ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের শুরুতে রাজ্যের ঋণভারের পরিমাণ ৭,৭১,৬৭০ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রতি পশ্চিমবঙ্গবাসীর মাথার উপর কমবেশি ৭৫,০০০ টাকার ঋণ রাজ্যের সরকারের ঋণগ্রহণের কারণে। বেপরোয়া গতিতে মাত্র ১৪ বছরে রাজ্য সরকার ৫,৭৯,৬৭০ কোটি টাকার (বছরে গড়ে ৪১,৪০৫ কোটি টাকা) ঋণভার বৃদ্ধি করেছে এবং গৃহীত ঋণের সিংহভাগ টাকা অনুৎপাদক খাতে ব্যয় করে রাজ্যকে 'ঋণের দুষ্টচক্র'এ ফাঁসিয়ে দিয়ে রাজ্যের আর্থিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে রাজ্যের নিজস্ব আয় ১,১২,৫৪৩ কোটি টাকা। গত(২০২৪-২৫) অর্থবর্ষে সরকার ঋণ নিয়েছিলেন ৬৫,১৩৯ কোটি টাকা। এবছর গৃহীত ঋণের অঙ্ক আরও বেশি হওয়ারই প্রবণতা। বর্তমান অর্থবর্ষে ঋণ শোধ বাবদ ব্যয় হবে ৮১,৫১০ কোটি টাকা। রাজস্ব ঘাটতি ৩৫,৩১৫ কোটি টাকা। দুটি মিলিয়ে ১,১৬,৮২৫ কোটি টাকা।
এই অবস্থায় পুজো অনুদানের নামে বিরাট অর্থাঙ্কের ব্যয়ও করা হচ্ছে ঋণের টাকায়। অথচ এরাজ্যে পঞ্চায়েতের কর সংগ্রাহক, মিড ডে মিল কর্মীদের বেতন যথাক্রমে মাসে ৬০০ টাকা ও ১২৬৬ টাকা। জীবিকাসেবকদের বেতন ৮ বছর ধরে বন্ধ। সরকার স্থায়ী পদে নিয়োগ না করে নাম মাত্র বেতনে, কোনোরকম সামাজিক সুরক্ষা ছাড়াই, রাজ্যের শিক্ষিত কর্মপ্রার্থীদের বেকারির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে, 'ক্রীতদাস মালিক'-এর ঢঙে সরকারি কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বহু পৌরসভায় চুক্তিনিযুক্ত কর্মীরা বেতন পাচ্ছেন না দীর্ঘদিন ধরে। কর্মী ও পেনশনারদের ডিএ/ডিআর দিচ্ছে না সরকার। মিড ডে মিলে পড়ুয়া পিছু বরাদ্দ ৬.৭৮ টাকা। সরকারি হাসপাতালে রোগী পিছু ৩ বেলার খাবার পিছু বরাদ্দ ৫৬.৬০ টাকা। রাস্তাঘাট চলাচলের অনুপযুক্ত। এরবেলা সরকারের অর্থসঙ্কটই নাকি দায়ী। উলটোদিকে সরকার মন্ত্রীদের বেতন ১২,০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১,৫০,০০০ টাকা, বিধায়কদের বেতন ৯,০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১,২৫,০০০ টাকা করেছে, সঙ্গে চিকিৎসার নামে রাজকোষ লুটের হরেক সুবিধা।
সরকার ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত ৫ বছরে এনজিও গুলিকে ১,১৭,৬৭৬ কোটি টাকার অনুদান দিয়েছে। এই সরকারি অনুদান সিএজি/রাজ্য সরকারি অডিট এর আওতার বাইরে। এমন কি কোন খাতে সংশ্লিষ্ট এনজিও সরকারি অনুদান খরচ করেছে, তা জানতে চাওয়া হচ্ছে না। অনুদান প্রাপ্ত প্রায় সব এনজিও’র পরিচালক তৃণমূলের নেতারা। অর্থাৎ সরকার এই ১,১৭,৬৭৬ কোটি টাকা ঘুরপথে শাসকদলের নেতাদের হাতে তুলে দিয়েছে। ক্লাব ও পুজো কমিটিগুলোকে অনুদানের নামে বিপুল অর্থাঙ্কের অনুদান আসলে তাদের কেনার জন্য যাতে আসন্ন নির্বাচনে তারা তৃণমূলে অনুকুল ভূমিকা পালন করে। আগেও রাজ্যে দুর্গাপূজা হতো, সরকারি অনুদান ছাড়াই হতো, মানুষ পুজোর ৪ দিন মণ্ডপে ধর্মাচরণ ও উৎসব পালন করত নিশ্চিন্তে। সরকার অনুদান দেওয়ার পর থেকেই চিত্রটা বদলে গেছে। তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা মনে করেন এই সরকারি অনুদান তাদের দয়ার টাকা। ফলে পুজোকমিটিগুলোর নিয়ন্ত্রণ অলিখিত ভাবে চলে গেছে তৃণমূলের হাতে। একটা সামাজিক অরাজনৈতিক উৎসব আজ তৃণমূলের দলীয় রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে পর্যবসিত হয়েছে। এর সামাজিক প্রভাব যথেষ্ট ক্ষতিকর। দীঘায় মুখ্যমন্ত্রী সরকারি খরচে জগন্নাথ মন্দির বানিয়েছেন। সরকারি খরচে মসজিদ বানানোর দাবিও উঠে গেছে। সরকারের কাজ কি মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরুদ্বার বানানো, নাকি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, শিল্পায়ন ও পরিকাঠামো উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ? রাজ্যবাসীকে অবশ্যই ভাবতে হবে।
Mamata Puja Grant
ধর্মীয় উৎসবে সরকারি অনুদান কার টাকা, কে বিলোয়!

×
Comments :0