গল্প — মুক্তধারা
তাই তো জেগে রই
ময়ূরী মিত্র
সেবার বেশ শীত পড়েছে ৷ শীতের সঙ্গে মেঘের একটানা দ্রবণে চারদিকে কেমন এক শীতল - পিচ্ছিল ভাব ৷ রোদ উঠছিল না কদিন ধরেই -সঙ্গে পাখির পালকের মতো পলকা একটা হাওয়া ৷ শীতের দিনে মেঘের মিশেলে এমন চপল হাওয়া দিলে দেশ গাঁয়ের লোক বলত ---ওহ আজ হাওয়া কী " চালছে " ! মানে হল গিয়ে আপনার -- হাওয়া চলছে ৷ এমন হাওয়া চলল , মানে গাঁ ঘরের ফচকে খুকিরা তিড়বিড় করে ছুটবে এর ওর বাড়ি -- তাদের ফালতু কথার ফুলুরি নিয়ে ৷ গৃহস্থের আবশ্যক কম্ম যেটুকু না করলে নয় সেটুকুই করবে সেসব দিনে ৷
আমি যেদিনের কথা বলছি - সেদিনও হাওয়া ছুটন্ত তীর হয়ে আমার ও আমার বাচ্চাদের চামড়া ফাটাচ্ছিল ৷ তার মধ্যে একটি ছিল অটিস্টিক ৷তাকে দেখলাম --জগত সংসার ভুলে একবার হাত দুলিয়ে হাওয়া বোঝার চেষ্টা করছে --সঙ্গে সঙ্গেই আবার নিজের কুঁচকে যাওয়া চামড়ায় হাত বুলিয়ে নিচ্ছে ৷ বাচ্চাটি একসময় ভাবুক হয়ে গেল --তখন তার চোখ ভূমির ওপর বয়ে যাওয়া হাওয়া ছেড়ে আকাশের মেঘে ঘুরতে লাগল ৷ বুঝলাম -সাধারণভাবে একমনে থাকা বাচ্চাটা মেঘ ,হাওয়া ও নিজের ছোট্ট শরীরটার মধ্যে সংযোগ বোঝার চেষ্টা করছে ৷ একটা প্রাণের চেষ্টা ৷ একসময় বুঝতে না পেরে সে কেঁদে ফেলল ফুঁপিয়ে ৷ তখন আকাশে একটুকরো রোদ উঠছে ৷ ঠাণ্ডা আরো বাড়ছে ৷ বুঝলাম --কথা দিয়ে এ বাচ্চাকে বোঝান যাবে না ৷ পাঠকদের বলে রাখি --Autistic বাচ্চা অন্যের ভাবনা নিজের ঘাড়ে চাপাতে একেবারেই চায় না ৷ চাপাতে গেলে বিরক্ত হয় ৷ এরা নিজে ভাবতে চায় ৷ ভাবনায় ডুবে থাকতেও পারে ৷
একটিও কথা না বলে তাকে আলতো করে ঠেলে দিলাম উঠোনের এমন একটি জায়গায় যেখানে শীতল হাওয়ার সঙ্গে সদ্য ওঠা রোদ এসে পড়েছে ৷
----এই জায়গায় দাঁড়িয়ে তোর যা ভালো লাগে খেল ৷ তবে খেলতে হবে এই জায়গায় দাঁড়িয়েই ৷ --যতদূর মনে পড়ছে এমন ধরণের কিছু কথা বলেছিলাম তাকে ৷
আমার কথা শুনে অনেকক্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে রইল সে ৷ মনে হল --বনের মাঝে কোনো ঋষির ছেলে আকাশে পুষ্প ছুঁড়ছে তার চোখ দিয়ে ৷ মেঘ থেকে রোদ -- প্রকৃতির এই অপরূপ পরিক্রমা এমনই গভীর ও উজ্জ্বল করে তুলছিল তাকে ৷ তার চোখে অক্ষর লেখা হচ্ছিল ৷ তবে মেঘ না রোদ --কে সে অক্ষর তৈরী করছিল তা জানি না ৷
হঠাৎ বাচ্চাটা পাখির মতো দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে দৌড়োতে শুরু করল - ৷ এত জোর ছিল সে দৌড়ে - মনে হল স্কুলের গেটে দড়াম শব্দ অন্যদিনের চেয়ে অনেকগুণ বেশি হয়েছিল ৷ প্রথমবার বাঁকা হাতে গেট খুলতে ব্যর্থ হয়ে দ্বিতীয়বার দড়াম করল ৷ এসব তাকে নিয়ে আমার ভালোবাসায় মেতে থাকার ভুল কিনা তা অবশ্য বলতে পারব না ৷
অনেকটা তফাতে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছি --আকাশের পাখি দেশান্তরে যাওয়ার সময় যেমন পথ পরিবর্তন করে নিজের ডানা বাঁকিয়ে - ঠিক সেভাবে নিজের সামান্য বেঢপ শরীরটাকে কাত করে সামনে পিছে ডাইনা বাঁয়ে নাচিয়ে যাচ্ছে সে ৷
----- এই শোন না ! তাকা আমার দিকে ? এমন করে নাচ্ছিস ক্যানো ? নাচবি যদি -ক্যাসেট বাজাচ্ছি --গানের সঙ্গে নাচ ৷
--------নাচিনি তো ৷ আমি Bird হয়েছি ৷
--- সে আবার কী রে? তুই তো তোর মায়ের বাচ্চা --তুই আমার বাচ্চা ৷ তুই পাখি হবি কী করে ?
---- কী হাওয়া মিস কী হাওয়া ৷ ও মিস
হাওয়া আমায় পাখি করে দিল ৷
---- দেখি - হাওয়া তখন তেমন না চললেও সে বাচ্চা নিজের পাতলা শরীরটাকে কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে আরো আরো হাওয়া কল্পনা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে ৷
আমি চুপ ৷ ছোট মানুষের সৃষ্টিকর্মকে বোধহয় সবচেয়ে মর্যাদা দিতে হয় ৷ কারণ তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য বিধেয় সে নিজেই জানে না ৷ তখন তার মন এতটাই স্ফূর্ত হয় ৷
যথারীতি আমাকে চুপ দেখে তার কথা বাড়ল - --
--- দেখো না বাতাস কেমন নখ দিয়ে আমার লোমগুলো খুঁচিয়ে দিচ্ছে ! এই দেখো -- ওহ --এই দেখো আমার লোমগুলোও পাখি হয়ে গেছে ৷ লোমও কি আকাশে উড়ে যাবে মিস ?
বোকা মুখ করে বললাম --আচ্ছা তাই ? তো হাওয়াটা কেমন বল দেখি ?
---- কেমন আবার ! K F C এর প্লাস্টিক প্যাকেটের মতো ৷ একদম প্লাস্টিক হাওয়া ৷
--- ধুর ! প্লাস্টিক আবার হাওয়া হয় নাকি ? আর K F C এর মুরগির ঠ্যাং কি এ হাওয়ায় ঘুরছে ? কই -আমি দেখতে পাচ্ছি না তো ৷ শিগগির দেখা আমায় ৷
---- আরে হয় ---হয় গো ৷ এই দেখো না --পিড়িং পিড়িং লাফ দিচ্ছি ৷
--- কী আজে বাজে বলছিস ? প্লাস্টিক হাওয়া হঠাৎ পিড়িং পিড়িং হাওয়া হয়ে গেল ? ওমা ! তোর হাওয়া বুঝি মুরগি থেকে পিড়িং শাক হয়ে যায় ?
--- ও মিস৷ প্লিজ প্লিজ ও মিস ৷ একটু শোনো --৷ মা যখন আমার গায়ে সেন্ট দেয় তখন সেন্টের শিশির মুখের স্প্রে স্প্রে হাওয়া ৷ এবার -- এবার ঠিক বলেছি মিস ? বল না ?
দুপুর এল ৷ তবু তার হাওয়ার গল্প থামল না ৷
হাওয়ার বর্ণনায় তার সেই "রকম " আর "মতো" গুলো পাকসাট দিতে লাগল স্কুলের গলিতে ৷
শিক্ষক বুঝতে পারছে না --হাওয়া এখনো বইছে ৷
ছাত্র তখনো উড়ছে ৷
অনুভূত না হলেও বাতাস থেকেই যায় --জীবের শ্বাস অটুট রাখার জন্য ৷
Comments :0