সুমিত গাঙ্গুলি
বিশ শতকের মাঝামাঝি ভারতীয় উপমহাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির আকাশে দীপ্তিমান নক্ষত্র হয়ে উঠেছিলেন কিছু মানুষ। নিজের কলমকে তাঁরা হাতিয়ার করে তুলেছিলেন প্রচলিত সমাজের বিপক্ষে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁদের লক্ষ্য ছিল একটাই। আর তা হলো মেহনতি মানুষের সমাজ প্রতিষ্ঠা। সাহির লুধিয়ানভি তাঁদের অন্যতম।
তাঁর প্রকৃত নাম আব্দুল হাই। তবে সাহিত্যজগতে তিনি পরিচিত হন ছদ্মনাম সাহির লুধিয়ানভি নামে। তাঁর জন্ম ১৯২১ সালের ৮ মার্চ লুধিয়ানার করিমপুর জেলায়। তাই ছদ্মনাম ‘সাহির’র সঙ্গে লুধিয়ানভি যোগ করেছিলেন তিনি। ‘সাহির’ শব্দের বিভিন্ন অর্থ হয়। জাদুকর, জাগ্রত, সদা সতর্ক। ইকবালের এক কবিতা থেকে তিনি এই নামটি পেয়েছিলেন। এই কবি তাঁর শব্দ চয়নের জাদুতে সদা সতর্ক ও জাগরিত রেখেছিলেন জনগণকে, যাতে তাঁরা নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াই থেকে বিচ্যুত না হয়।
১৯৩৭ সালে লুধিয়ানা। তখন অবিভক্ত ভারতের অন্যান্য অংশের মতোই ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে অসন্তোষে ফুঁসছিল। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশদের হাতে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে নিহতদের আর্তনাদ তখনও স্পষ্টভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। একই ভারতীয় উপমহাদেশে কমিউনিজমের প্রতি ক্রমবর্ধমান আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল পুঁজিপতি এবং শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব। আজাইব চিত্রকর বলেছিলেন, ‘তিনি (সাহির) কার্ল মার্কসের একজন আগ্রহী পাঠক ছিলেন।’ বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের মেঘ ঘনিয়ে আসছিল। সাহিরের মতো তার চারপাশের সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে যাঁরা সচেতন এবং সংবেদনশীল তাঁরা ভালোই প্রভাবিত হয়েছিলেন।
সাহির কলেজে, তিনি দর্শন এবং ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। যদিও অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে তিনি আগ্রহী ছিলেন। কলেজে ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হন। অর্থাৎ পাঞ্জাব প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন। এই সবকিছুই তাঁর কবিতাকে প্রভাবিত করেন। ‘কীর্তি লেহার’ নামে এক গোপন পত্রিকায় (আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যাগাজিন) সাহিরের কবিতা ‘জহা হ্যায় মজদুর’ কবিতাটি প্রকাশ পায়। কবির জায়গায় নাম ছিল এ এইচ সাহির।
পিপিএসএফ’র দৌলতে সাহিরের এআইএসএফ’র অনেক কর্মীর সঙ্গে দেখা হয়। তাঁরা সকলেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই)’র কর্মী। সাহির এরপরে সংগঠনের সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি ছাত্র ও পার্টিকর্মীদের বিভিন্ন সভায় বক্তৃতা দিতেন এবং রাজনৈতিক কবিতা আবৃত্তি করতেন।
পাকিস্তানের বাসিন্দা বিখ্যাত কবি ও লেখক আজহার জাভেদ লিখেছেন, কলেজের একটি অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ কমিশনার এবং ডেপুটি কমিশনার উপস্থিত ছিলেন। ছাত্ররাও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছিলেন। সাহিরের কবিতা আবৃত্তি করার কথা ছিল। দর্শকদের অভ্যর্থনা জানান তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ এই ইউনিয়ন জ্যাক আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়বে, ততক্ষণ আমার বন্ধুরা বা আমি কেউই অংশগ্রহণ করব না।’
সাহিরকে সরকারি কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। কারণ তাঁর কবিতাগুলিকে কলেজ কর্তৃপক্ষ ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসাবে দেখছিল। দাবি করা হয় সারাভা নামক গ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য শহীদ কর্তার সিং’র মৃত্যু স্মরণে একটি রাজনৈতিক সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন সাহির। সেখানে তিনি একটি কবিতা পড়েছিলেন। এই কারণে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এরপর তিনি দয়াল সিং কলেজে ভর্তি হন। এটি ছিল তাঁর বিএ’-র শেষ বর্ষ। তিনি তখন লাহোর জেলা ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি। এখানেও তিনি কলেজ কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন পদক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ করেন। আবারও সাহিরকে কলেজ ছাড়তে হয়। পরের বছর তিনি লাহোরের ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মোহভঙ্গ হলে তিনি বিএ পরীক্ষা না দিয়েই ইসলামিয়া কলেজও ছেড়ে দেন। এরপরেই ১৯৪৩ সালের শেষের দিকে এবং ১৯৪৪ সালের শুরুতে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তলখিয়াঁ’ (তিক্ততা) প্রকাশিত হয়। তাঁর বয়স তখন মাত্র ২৩।
এরপর সাহির আদাব-এ-লতিফ, শাহকার ও সবেরা নামে তিনটি পত্রিকায় সম্পাদনার কাজ শুরু করেন। তখন তিনি প্রগতিশীল লেখক সমিতির সদস্য এবং কমিউনিজমের প্রবক্তা।
সময়টা ১৯৪০-’র দশকের শেষ। ব্রিটিশ আমলে যে কোনও ‘সুরখা’ অর্থাৎ ‘লাল রঙ’-এর প্রভাবে থাকা বুদ্ধিজীবীকে বিপজ্জনক ধরা হয়। দেশ ভাগের পরে তৈরি হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি অব পাকিস্তান। এদিকে পাকিস্তান তখন মার্কিন তাঁবেতে। তাকে দেখাতেই হবে সে সোভিয়েত বিরোধী ফলে পাকিস্তান সরকার সাহিরকে কারাগারে পাঠাতে খুবই আগ্রহী। তার উপর একটি কবিতা লাহোরে প্রকাশিত হয় সাহিরের। তিনি লিখেছিলেন, ‘দবেগী কব তলক আওয়াজ-এ-আদম হম ভি দেখেঙ্গে/ রুকেঙ্গে কবতলক জজবাত-এ-বহরম হম ভি দেখেঙ্গে’ (কতদিন মানুষের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে থাকে আমরাও দেখবো/ ঐক্যের ইচ্ছা কতদিন আটকানো যায় আমরাও দেখবো)। এই কবিতাটি পরবর্তীকালে ফৈজ আহমেদ ফৈজের ‘হম দেখেঙ্গে’ কবিতার মূল অনুপ্রেরণা। সাহিরের নামে রীতিমত হুলিয়া জারি হয়। তিনি চলে আসেন ভারতের দিল্লিতে। তারপর মুম্বাই অর্থাৎ তখনকার বোম্বেতে।
১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়েছিল। আইপিটিএ সামাজিক দায়িত্ব এবং জাতীয় সংহতি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে থিয়েটারকে জনগণের কাছে নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। আইপিটিএ দ্রুত একটি আন্দোলনে পরিণত হয়। তার সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। সাহিরও ছিলেন এর সদস্য।
তখন বোম্বে আইপিটিএ’র সদস্য কে নয়? বলরাজ সাহানী, একে হাঙ্গল, রাজ কাপুর, পৃথ্বীরাজ কাপুর, চেতন আনন্দ। একে একে যোগ দেন বাংলা থেকে আসা সলিল চৌধুরি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। রুরকি থেকে আসেন শৈলেন্দ্র। তিনি আবার আইপিটি’র পাশাপাশি রেলে এআইটিইউসি’র ইউনিয়নে ছিলেন। এই পরিমণ্ডলে সাহিরের লেখনী আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।
সাহির ছিলেন এমন এক কবি যিনি বিপ্লবের ভাষায় প্রেমের গান লিখতেন। আবার প্রেমের ভাষায় লিখতেন বিপ্লবের কবিতা। তাঁর লেখায় ধরা পড়ত দ্বন্দ্ব। যেমন একটি উদাহরণ, পুরুষটি বলছেন, ‘আচ্ছা নহিঁ হোতা ইয়ুঁহি স্বপ্নোঁ সে খেলনা/ বড়া হি কঠিন হ্যায় হকিকতোঁ কো ঝেলনা (স্বপ্নগুলো নিয়ে খেলা ভালো নয়/ বাস্তবকে সহ্য করা খুবই কঠিন)।’ জবাবে প্রেয়সী বলছেন, ‘আপনি হকিকতেঁ মেরে স্বপ্নোঁ পে ওয়ার কে/ দিল কে সহারে আজা প্যার করে (তোমার বাস্তবতা দিয়ে আমার স্বপ্নকে আক্রমণ করো / নিজের হৃদয় দিয়ে ভালোবাসো।)’ এখানে ‘আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমের’ বা ‘পৃথিবী আমারে চায়’ গানের মত একপক্ষের আশাই শুধু ধরা পড়ে না। সামনে থাকা অপর মানুষটির কথাও ধরা পড়ে। কিংবা ধরা যাক ‘ম্যায় পল দো পলকা শায়র হুঁ’। সমগ্র কবিতা জুড়ে সাহির নিজেকে ‘মুহুর্তের কবি’ বলেছেন। কারণ তিনি জানেন, ‘হর ফসল এক নসল হ্যায় ধরতি কি/ আজ উঠতি হ্যায়, কল কাটতি হ্যায়/ জীবন ওহ মহঙ্গী মুদ্রা হ্যায়, জো কতরা কতরা বটতি হ্যায়...কল কোঈ মুঝকো ইয়াদ করে/ কিউ কোঈ মুঝকো ইয়াদ করে/ মশরুফ জমানা মেরে লিয়ে/ কিউ ওয়াক্ত অপনা বরবাদ করে।’
ব্যস্ত পৃথিবী কেন তাঁকে মনে রাখবে? এটাই ছিল তাঁর বক্তব্য। কিন্তু দ্বান্দ্বিক পরিবর্তনই যেখানে ‘স্থায়ী’ সেখানেই সাহির আসলে ‘হর এক পল কা শায়র’। ঠিক যেমন নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন তিনি ‘হুজুগের কবি’, সেইরকম।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘সবাই যখন শুধায় মোরে কুঁড়ে ঘরে থাকিস কেন? কোঠা যখন গড়তে পারিস নিজে/আমার ঘর কেন যে তবে সবচেয়ে না বড় হবে, তার উত্তর জানি নে আমি নিজে’... খানিকটা সেই পথ ধরেই সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন, ‘বলতে পারো ধনীর বাড়ি তৈরি যাঁরা করছে/ কুঁড়ে ঘরে তারাই কেন মাছির মতো মরছে?’ প্রশ্নের উত্তরও ছিল সঙ্গে –‘বড় লোকের ঢাক তৈরি/ গরিব লোকের চামড়ায়’। বাংলা ভাষা, যা ছিল প্রাক স্বাধীনতা যুগের এমন এক সাহিত্যের ভাষা যা ব্রিটিশ বিরোধী সাহিত্য রচনা শুধু নয়, বৃহত্তর প্রগতিশীল সাহিত্য তৈরি করেছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর সেই ভাষাকে লড়াইয়ে নামানো হলো এমন এক ভাষার বিরুদ্ধে, যে একই রকম প্রগতিশীল ও ব্রিটিশ বিরোধী সাহিত্য তৈরি করেছিল। কারণ, না হলে শাসকদের ‘শাসন ও বিভাজন’-এ সুবিধা হবে না।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আর গালিবের মধ্যে তো কোনও শত্রুতা নেই। ফলে গালিবের উত্তরসূরি সাহিরের মধ্যে দেখা দিল সেই একই ভাব উত্তর সহ। সুকান্তের মতো ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী সাহির লিখলেন-‘উঁচে মহল বনানে ওয়ালে ফুটপাথোঁ পর কিউ রহতে হ্যায়/ দিন ভর মেহনত করনে ওয়ালে ফাকোঁ কে ধুল কিউ সহতে হ্যায়.../খেতোঁ অর মিলোঁ পর অব তক ধনওয়ালোঁ কা ইজারা হ্যায়/ হামকো আপনা দেশ প্যারা, উনহে মুনাফা প্যারা হ্যায়/ উনকে রাজ মে বনতি হ্যায় হর চিজ তিজারত কি খাতির/ অপনে রাজ মে বনা করেগি সব কি জরুরত কি খাতির’। একদিন যে ইকবালের কবিতা থেকে নিজের ‘তখল্লুস (ছদ্মনাম)’ নিয়েছিলেন, সেই ইকবালের ‘সারে জহাঁ সে আচ্ছা’-কে ব্যঙ্গ করে লিখলেন ‘তালিম হ্যায় অধুরী/ মিলতি নহিঁ মজদুরী/ মালুম হ্যায় কিসিকো/ দর্দ-এ-নিহা হমারা....’।
ফিওদোর দস্তয়ভস্কির ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’-এর অবলম্বনে তৈরি ‘ফির সুবহ হোগি’ ফিল্মের আর একটি গানে সরাসরি পুঁজিবাদকে আক্রমণ করে লেখেন ‘বিতেঙ্গে কভি তো দিন আখির/ ইস ভুখ কি অর বেকারী কে/ টুটেঙ্গে কভি তো বুৎ আখির/ দৌলত কি ইজরাদারী কে/...জব এক অনোখী দুনিয়া কি/ বুনিয়াদ উঠাই জায়েগি/ ওহ সুবহ কভি তো আয়েগি...।’
১৯৬৮ সালে গালিবের মৃত্যু শতবর্ষ উপলক্ষে তিনি সরাসরি লিখেছিলেন— ‘যিন শহরোঁ মে গুঁজি থি গালিব কি নবা-বরসো/ আজ উন শহরোঁ মে উর্দু বেনাম ও নিশাঁ ঠহরি/ আজাদী এ কামিল কা আয়লান হুয়া জিস দিন মাতুব জবাঁ ঠহরি/ গদ্দার জবাঁ ঠহরি...।’
মহিলাদের উপর ক্রমবর্ধমান অত্যাচারকে দেখে সাহিরের কলম থেকে বেরিয়েছে অনবদ্য সব কবিতা। যেমন, 'অওরত নে জনম দিয়া মর্দোঁ কো/ মর্দোঁ নে উসে বাজার দিয়া...’ কিংবা ‘মদত চাহতি হ্যায় য়হ হবা (ইভ) কি বেটি/ যশোদা কি হম-জিন্স (সমলিঙ্গ) রাধা কি বেটি/ পয়ম্বর কি উম্মদ, জুলেখা কি বেটি
সনাখোয়ানে তকদিশ-এ-মশরিক কহাঁ হ্যায়।’
দুনিয়ার সবরকম শোষণ থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখা সাহির ও তাঁর অনুগামীদের স্বপ্ন আজও পূর্ণ হয়নি। হবে একদিন। ততদিন না হয় শান্তিতে দিন কাটানো মানুষদের উদ্দেশ্যে সাহিরের ভাষায় বলা যাক—‘মহফিল সে উঠ জানে ওয়ালো তুম লোগোঁ পর ক্যা ইলজাম্ /তুম আবাদ ঘরোঁকে বাসী ম্যায় আওয়ারা অর বদনাম.....’
Comments :0