পীযূষ ব্যানার্জি
মাস্টারের মতো মাস্টার ছিল সে।
লোক এসে শুধু দাঁড়াতো। একবার চোখ বুলিয়ে শরীরটাকে দেখে নিত। তাতেই মাপা হয়ে যেত কাঁধের মাপ থেকে পা। কোমরের সাইজ থেকে হাতের ঝুল।
চোখ বুলিয়ে নেওয়া সেই মাপ তারপর উঠে যেত ছাপানো রসিদ বইতে। ব্যাস কাজ শেষ। গাঁইগুই যে হতো না, তা নয়। হতোই। তখনই মাস্টার যেত রেগে। সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছিল তাঁর। সপাটে বলে দিতেন, ঠিক আছে। কত দাম এই কাপড়ের। সাইজে কোনও গরমিল হলে, ফিটিংস’এ কোনও সমস্যা হলে কাপড়ের দাম আমার কাছ থেকে নিয়ে নেবেন।
সন্দেহ নিয়েই প্রথমবার ফিরতেন অনেকেই। তারপর?
সে এক অন্য গল্প। নতুন জামা প্যান্ট যেমনটা শরীরের সঙ্গে খাপ খায়। ঠিক তেমনইভাবেই তৈরি করা হয়েছে। আহ্লাদে আটখানা হয়ে ফিরে যেতেন খদ্দেররা।
মাস্টার চেনা যায় ডাক্তারের মতো। কাঁধ থেকে স্টেথোস্কোপ ঝোলানো যেমন চিকিৎসক চেনায়। মাস্টার চেনার উপায় কাঁধ থেকে নেমে আসা ফিতে। কিন্তু এই মাস্টারের ফিতে ঝুলতো না দু কাঁধ ধরে। চোখ বুলিয়ে মাপ নেওয়ার সেই মাস্টার এখন কোথায়?
ইউপি থেকে এসেছিল ছেলেটি। বেশ কয়েক বছর ছিল এ তল্লাটে। তারপর চলে যায়। আর খোঁজ পাইনি। মাস্টারের মতো মাস্টার ছিল সে। ‘‘কারিগর একেই বলে। শুধু ফিগার দেখে মাপ নিত। সন্দেহ করলে জেনে নিত কাপড়ের দাম। খারাপ হলে দাম ফেরতের চ্যালেঞ্জ রাখতো সে।’’ বলছিলেন বাবলু সামন্ত।
কোনা এক্সপ্রেস ওয়ে সে সময় কল্পনায় ছিল না এ জনপদের। বিদ্যাসাগর সেতুর জন্য হুগলী নদীর দুই পাড়ে সুউচ্চ খাম্বাও পড়েনি তখন। ঝোপ জঙ্গলে ভরা এলাকায় ৫০ বছর আগে দোকান খুলেছিল বাবলু সামন্ত। টেলারিং শপ। তখন গেস্টকিন কারখানা চালু। স্যাঙ্কি কারখানা খোলা। আর সব কারখানা রমরমিয়ে চলছে।
পুজোর আগে হতো বোনাস। আর দেখে কে। উপচে পড়া ভিড় সামন্ত টেলার্সে। ধর্মতলা থেকে ক্যাটালগ কিনে আনা হতো। বাজার চলতি সব ফিল্মের হিরোদের মতো জামা-প্যান্টের ডিজাইনে ভরা থাকতো সেই ক্যাটালগ। হিট ফিল্মের নায়ক যে প্যান্ট পরে নায়িকাকে নিয়ে গেয়েছেন গান। পুজোর আগে সেই হিট গানের নায়কের পরা বেলবটস প্যান্টই চাই।
সেই ডিজাইন হুবহু ফুটিয়ে তুলতো টেলারিং দোকান। মাপ নিতেন যিনি তিনি মাস্টার। নতুন কাপড়ের ডিজাইন মেনে মাপ অনুযায়ী কাটিং হতো তাঁর হাতেই। তারপর সেই কাপড় সেলাই যাঁরা করতেন তাঁরা হতেন কারিগর।
বিশ্বকর্মা পুজোর আগেই বোনাস হয়ে যেত গেস্টকিনস কারখানায়। বোনাসের আগেই অবশ্য টেলারিং শপে না আসলে পুজোর সময় নতুন জামা-প্যান্ট পরাই মাটি। কেন আবার। কাজের চাপে পুজোর দু’মাস আগে থেকে বন্ধ হয়ে যেত অর্ডার নেওয়া। না হলে যে কাজ শেষ করা যাবে না। মহালয়ার পর থেকে যে নতুন জামা কাপড় দোকান থেকে বের হতে শুরু করবে। চলবে পুজোর মধ্যেও।
সে দিন আর নেই। অলস দিন কাটে মাস্টারদের। সেলাই মেশিন থেকে মুখ তুলতে না পারা কারিগররাও এখন দলে দলে কাজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। টেলারিংয়ে প্রশিক্ষিত হাত এখন টোটোর স্টিয়ারিং ধরে রাস্তায়। হারিয়ে যাচ্ছে এদেশের এরাজ্যের কারিগরদের মাস্টারদের শিল্পকলা।
কাজই তো নেই। পুজোর দু’মাস আগে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হতো অর্ডার নেওয়া। আর এখন কোনোরকমে দোকানটা খুলে রেখেছি। আক্ষেপ সামন্ত টেলার্সের মাস্টারের। রাত পার হলেই শুরু দেবীপক্ষের। মহালয়ার আগের সকালে দোকানে এলেন এক বৃদ্ধ। সাদা কাপড় নিয়ে। একটা পায়জামার মাপ দিতে। জিকেডব্লিউ (গেস্টকিনস) কারখানার জেনারেটর ডিপার্টমেন্টের শ্রমিক বাধ্য হয়েছেন স্বেচ্ছাবসরে। ফিরে যান অতীতে। ‘‘এক সময় পুজোর জামা কাপড় তো এখান থেকেই তৈরি করিয়ে নিতাম। দেড় মাস আগে বন্ধ হয়ে যেত অর্ডার নেওয়া। দেড়-দু’মাস আগে এসেও তো ২০জনের পিছনে দাঁড়াতে হতো। এক করে আসতো শুধু মাপ নেওয়ার লাইন।’’
এক এক করে নাম বলে যায় যুবক। মাসুম, রয়াল, সোসাইটি, রূপ মিলন, রূপায়ণ, এ-ওয়ান, ফ্যান্সি, ডায়মন্ড, ফেমাস, সেরা ...। গুনতিতে শেষ হতো না টেলারিং-এর দোকান। আজ কোনোরকমে টিকে আছে শুধু রয়াল, আর সোসাইটির মতো দু’-একটা।
বাকি সব উঠে গেছে। মাস্টার থেকে কারিগর সব উবে গেছে। কোথাও নেই। কেউ খোঁজ রাখেনি তাঁদের। কোথায় হারিয়ে গেল প্রশিক্ষিত, দক্ষতা নির্ভর এই মানুষগুলি!
এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত চটকল সাঁকরাইলের ন্যাশনাল জুটমিলকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল একের পর এক টেলারিং দোকান। পুজো থেকে ঈদ— যে কোনও পার্বনে রমরম করতো দোকান। এখন হারিয়ে গেছে দোকান।
১৯৯৪-১৯৯৫ সাল থেকে রাজগঞ্জের ন্যাশনাল জুটমিলের দোরগোড়ায় দোকান তৈরি করেছিলেন মহম্মদ সুফিয়ান। বাবা ছিলেন চটকল শ্রমিক। চার ভাই, দুই বোনের সংসারে বেশিদূর লেখাপড়া এগতে পারেননি। ছোট্ট বয়স থেকে শিখেছিলেন টেলিরিং’এর কাজ। ক্রমে হয়ে ওঠেন মাস্টার।
পুজোর আগে শিল্পাঞ্চলের মানুষ এসে ভিড় করতেন সুফিয়ানের রয়াল টেলার্সে। মাপ নিয়ে ফুরসত মিলতো না তখন। রয়াল টেলার্সের ছাপানো ১০০ পাতার রসিদ ভরে উঠতো মানুষের জামা প্যান্টের মাপে। কাঁচি দিয়ে কাটা কাপড়ের খণ্ডাংশ রসিদ বইতে স্টেপল করে দেওয়া হতো। ১০০ পাতার রসিদ বই তখন ২৫০০-২৬০০ করে কাটা হয়ে যেত। দু’মাস আগে অর্ডার নেওয়া বন্ধ করতো রয়াল টেলার্স। আর এখন?
১৭টি সেলাই মেশন থেকে দাঁড়িয়েছে ছয় থেকে সাতটি। তাও সব একসঙ্গে চালানোর মতো কাজ নেই। তিন-চারটা মেশিন এমনিই পড়ে থাকে। লোহার মেশিন পড়ে থাকলে জং খেয়ে নেবে তাই লোহার দরে কবেই বিক্রি হয়ে গেছে। এদিনও রসিদ বই’তে নেওয়া মাপ দেখে প্যান্টের কাপড় টেবিলের ওপর ফেলে স্কেল দিয়ে মাপ মিলিয়ে কাটছিলেন মহম্মদ সুফিয়ান।
কত কাজের অর্ডার আছে?
ছাপানো রসিদ বইতে চোখ বুলিয়ে সুফিয়ান জানায়, ‘‘১২৯ সিরিয়াল চলছে। কতই আর হবে ২৫০ সিরিয়াল পর্যন্ত আছে।’’ দীর্ঘশ্বাস পড়ে যুবকের। এক এক করে টেলারিং’এর দোকানের নাম বলে উঠে যাওয়ার তথ্য তাঁরই দেওয়া। আর সেইসঙ্গে ৫-১০ কিলোমিটারের মধ্যে এক একটি কারখানার নাম উঠে আসে তাঁর মুখ থেকেই। মানিকপুরের ডেল্টা জুটমিল, সাঁকরাইলের ন্যাশনাল জুট, নাজিরগঞ্জের শালিমার পেন্ট, আরও একটু এগিয়ে হুগলী ডক, গেস্টকিনস— সব কারখানাই তো বন্ধ এখন।
মন ভালো নেই তাই সুফিয়ানের। কাজের সঙ্কটের সঙ্গে পালটে যাওয়া মানুষজনকে দেখে আরও ভারাক্রান্ত তাঁর হৃদয়। তিন দশক ধরে চালিয়ে যাওয়া একটা ব্যবসা, কত মানুষের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করে। কত নতুন বন্ধু আত্মীয়তা। ‘‘দোকানে যে আসছে তাকে তো লক্ষ্মী মানতেই হবে। ইমানদারির সঙ্গে চলতে হবে। কিন্তু এখন যেন সবকিছু কেমন অচেনা হয়ে উঠেছে।’’ জানায় সুফিয়ান।
পুজোর পোশাকের জন্য সুফিয়ানের হাতের ছোঁয়া না হলে পুজোটাই যে বরবাত। কেতাদুরস্ত সেজে রাত জেগে ঠাকুর দেখার জন্য রয়াল টেলার্সের জুড়ি নেই। আজকের মতো বিভাজন তখনও গ্রাস করেনি এ তল্লাটের মাটিকে। পুজোর পোশাক ‘ওদের’ কাছে কেন? এই প্রশ্ন কারো মাথায় সেদিন আসেনি। তাই তো ফি বছর দোকানে আসা মানুষজনের বাড়িতে ডাক পড়তো রান্না পুজোয়, বিশ্বকর্মা থেকে বিজয়ার নিমন্ত্রণে। ‘‘মাস্টার, আমার বাড়িতে রান্না পুজো আছে। যেতে হবে। কতজন এসে বলে যেত। আরে বাবা কত জায়গায় যাবো! সব জায়গায় যেতে পারতাম না।’’ বলেন সুফিয়ান।
এবার সেই পুজোর নিমন্ত্রণের ডাক একটাও আসেনি। কাজের সঙ্কট থেকে অবিশ্বাসের পরিবেশ ভাবায় সুফিয়ানদের। আগে গ্রাম গঞ্জের মেয়েরা আসতো। সালোয়ার কামিজ বানাতে। নির্দ্ধিধায় মাপ নিয়ে নিতে পারতো। এখন সেই কাজ করতে ভয় লাগে। ইউটিউব খুললে যে দেখে ‘মব লিঞ্চিং’!
সর্বগ্রাসী এই সঙ্কটের শুরু হয়েছে রেডিমেড পোশাকের রমরমার সময় থেকে। তারপর অনলাইন বিক্রিবাটা সেই সঙ্কটকে তীব্র করেছে বলেই টেলারিং শিল্পের কারিগরদের মত। এটা ওঁরা মানেন একটা জামার কাপড় কিনে হাফ সার্ট তৈরি করতে শুধু মজুরি পড়ে যায় ২৭০ থেকে ৩০০ টাকা। এখন সেই মজুরির দামেই অনলাইনে একটা জামা কিনে নেওয়া যায়। ফলে মানুষ তো সেদিকেই ছুটবে। উৎপাদিকা শক্তির এহেন ক্রমবিকাশ সম্পর্কে তাঁরা ওয়াকিবহাল। কিন্তু প্রশ্ন তাঁদেরও আছে। তা হলো, একটা জামা তৈরি করে ব্যবহার করা যায় বহু বছর। সেখানে অনলাইন পোশাকের আয়ু সাকুল্যে এক বছরের কিছু বেশি।
রেডিমেড পোশাকের কারিগররাও কী সুখে আছে? এরাজ্যের মেটিয়াব্রুজ, মহেশতলা, থেকে হাওড়ার ডোমজুড়, সলপ, নিবড়ার বিস্তীর্ণ এলাকার দর্জি মহল্লাও এখন অর্ডারের অভাবে ধুঁকছে। সেখানেও কারিগরদের হাতে কাজ নেই। পাঞ্জাবীর কাজের দক্ষ কারিগর এখন কাজের অভাবে অসংগঠিত শিল্প শ্রমিক।
রেডিমেড পোশাকের চাহিদার পরিবর্তনের সঙ্গে মোবাইলের মাধ্যমে অনলাইন কেনাকাটাই তাঁদের জীবিকাকে শেষ করেছে বলে মত দেন টেলারিং শিল্পের মানুষজন। ক্ষোভ এতটাই যে অনলাইনে কেনা প্যান্ট দোকানে সাইজ ঠিক করতে এলে ক্ষুব্ধ বাবলু সামন্ত সেই কাজ করেন না। ‘‘জামা কিনে অসুবিধা হলে তখন আমাদের কাছে আসে। আমি সেই কাজ করি না। যারা করেছে, তাদের কাছে যাও বলে দিই। কাজ করবো না। বসে থাকবো। তবু অনলাইনে কেনা কাপড় জামার কাজ করবো না।’’ বলে দেন বাবলু সামন্ত। তাঁর ক্ষোভ পড়ে সাধারণ ক্রেতাদের ওপর।
সুফিয়ানকে ভাবায় অন্যপথে। তাঁদের ব্যবসা তো শেষ হওয়ার পথে। কিন্তু এখন তো পাড়ার মধ্যেই চলে আসছে বিপণন সংস্থার সব গাড়ি। কী নেই তাতে? চাল, সাবান, তেল, নুন থেকে শাক- সবজি পর্যন্ত। মোবাইল থেকে তো এখন এইসবও কেনা যাচ্ছে।
বাঁচবে তো পাড়ার মুদিখানার দোকান! নিজের মতোই শঙ্কিত হয় পড়শি ব্যবসায়ীর কথা ভেবে।
Comments :0