এদিনই কলকাতায় পা রাখেন আলেইদা এবং এস্তেফানিয়া। তাঁদের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছনোর কথা ছিল দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ। রাস্তায় যানজটের ফলে তাঁদের পৌঁছতে কিছুটা দেরি হলেও সাধারণ মানুষের উৎসাহে কোনও ভাঁটা ছিল না। বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা থেকেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তাঙ্গন বা ওপেন এয়ার থিয়েটার(ওএটি)তে ভিড় জমতে শুরু করে। চে’র কন্যাকে স্বাগত জানাতে মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে পৌঁছন যাদবপুর এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বামপন্থী কর্মী সমর্থকরা। ঘড়ির কাঁটা দুটো ছুঁতেই ভিড় বাড়তে শুরু করে ওএটিতে।
আলেইদা এবং এস্তেফানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছন বিকেল চারটের কিছু পরে। তাঁদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসেন যাদবপুর অঞ্চলের যুবকর্মীদের বাইক মিছিল। গাড়ি থেকে নেমে মঞ্চ অবধি ওঠার সংক্ষিপ্ত পথ তখন মানুষের ভিড়ে ছয়লাপ। চে’র উত্তরাধিকারকে একবার চোখের দেখা দেখতে উন্মুখ হাজার জনতার ভিড়।
আলেইদা এবং এস্তেফানিয়া মঞ্চে আসন গ্রহণের পরেই শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ‘তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে’র সুরে তাঁদের স্বাগত জানান তৈষী। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় এবং রঙ্গন চক্রবর্তী। তৈষীর গানের পরে কমলেশ্বর কবিতা পাঠ করেন।
এরপর মঞ্চে আসেন দেবদীপ মুখার্জি। তাঁর ‘হয়নি আলাপ’ এবং ‘ঘুম নেই’র সুর উত্তাপ ছড়ায় মঞ্চে। সেই শুরু। দেবদীপের রেশ বজায় রেখে উপস্থিত জনতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন অর্ক মুখার্জি। যদিও তার আগে সঞ্চালকদের তরফে মঞ্চে ডেকে নেওয়া হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ উপাচার্য চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য, প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসু এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সঞ্জয় গোপাল সরকারকে। একইসঙ্গে মঞ্চে আসেন এদিন অনুষ্ঠানের অন্যতম দুই মূল উদ্যোক্তা তথা এআইপিএসও’র নেতৃত্ব অঞ্জন বেরা এবং বিনায়ক ভট্টাচার্য।
তাঁরা আসন গ্রহণের পরে শুরু হয় আবৃত্তি- ‘‘ চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।’’
গোটা ওএটি তখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তন্ময় হয়ে সেই শব্দতরঙ্গের উত্তাপ সংগ্রহ করছে। সেই ওমের রেশ মেখেই মঞ্চে আসেন অর্ক মুখার্জি। এদিন তিনি শুরু করেন ‘ওয়াহিদা গুয়ান্তানামেরা’ দিয়ে। সেখান থেকে সাবলীল ভাবে তাঁর বিচরণ শুরু হয় ‘ ভালোবাসি জোৎস্নায় কাশবনে ছুটতে।’ সেখান থেকে সুরের নৌকা পাড়ি দেয় ‘কমানদান্তে চে গুয়েভারা’য়। আর দর্শক আসনে তখন শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিউতি মেক্সিকান ওয়েভ। শীতের কলকাতার পড়ন্ত আলোকে সাক্ষী রেখে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে, মেক্সিকান ওয়েভের তালে তালে কলকাতা তখন স্বাগত জানাচ্ছে লাতিন বিশ্বকে। স্টেজ থেকে ঠিকরে ঠিকরে আসা আলোর দমক এসে পড়ছে ওএটি’র মাঝ বরাবর চে এবং ফিদেলের ঝুলতে থাকা কাটআউটের উপরে। মানবমুক্তির লড়াইয়ের শপথ তখন একসুতোয় বেঁধে দিয়েছে গ্লোবাল সাউথের দুই ভূখন্ডকে।
এরপর দুর্নিবার সাহার ‘রানার’ কবিতা পরিবেশন করেন দর্শকদের জন্য। তারপর শুরু হয় গণসংবর্ধনা জ্ঞাপন অনুষ্ঠান। এইপিএসও’র তরফে আলেইদা এবং এস্তেফানিয়াকে সংবর্ধনা জানান অঞ্জন বেরা, বিনায়ক ভট্টাচার্য এবং পরিমল দেবনাথ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সংগঠন জুটার তরফে সংবর্ধনা দেন পার্থপ্রতিম বিশ্বাস এবং পার্থপ্রতিম রায়। অতিথিদের হাতে বই তুলে দেন সুনন্দন চক্রবর্তী এবং অশোক ভট্টাচার্য। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের ছাত্র সংসদ আফসু’র তরফে আলেইদা এবং এস্তেফানিয়াকে পুষ্প স্তবক দিয়ে সংবর্ধনা জানানো হয়। গোটা অডিটোরিয়াম তখন গলা মেলাচ্ছে ‘পিপল ইউনাইটেড শ্যাল অলওয়েজ বি ভিক্টোরিয়াস’ স্লোগানে। সেই স্লোগান গিয়ে মিশছে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ এবং ‘চে গুয়েভারা লাল সেলাম’। এরপর ফ্রেন্ডস অফ লাতিন আমেরিকার তরফে সংবর্ধনা জানানো হয় আলেইদা এবং এস্তেফানিয়াকে। এসএফআই কেন্দ্রীয় কমিটির তরফে ময়ূখ বিশ্বাস এবং প্রতীক উর রহমান ‘এডুকেশন এক্সক্লুশন’ বইটি তুলে দেন অতিথিদের হাতে।
সংবর্ধনা জ্ঞাপনের পরে আলেইদা গুয়েভারাকে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখার অনুরোধ করেন উদ্যোক্তারা। মিনিট পাঁচেকের বক্তব্যের আলেইদা জনান, হোসে মার্তির আদর্শে বড় হয়েছি আমি। আমি কিউবার বাসিন্দা। কিন্তু গোটা বিশ্বই আমার পরিবার। মানুষের ভাল করার পক্ষে যে চিন্তা, তা নিয়েই বড় হয়েছি আমি। চে নিছকই টি-শার্টে আঁকা ছবি নয়, বরং তাঁর জায়গা হৃদয়ে। মানব মুক্তির জন্য চে'র লড়াই, সেই লড়াইকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাদের। একইসঙ্গে তাঁর আহ্বান, মানুষের সঙ্গে থাকুন, মানুষের পাশ থেকে কখনও সরবেন না।
আলেইদা স্প্যানিশ ভাষায় নিজের বক্তব্য রাখেন। দর্শকদের জন্য স্প্যানিশ থেকে বাংলায় আলেইদার বক্তব্যের তর্জমা করেন শুভেন্দু সরকার।
এরপর মঞ্চে আসেন পূরবী মুখোপাধ্যায়। বিকেল ৬টা নাগাদ যাদবপুর থেকে বিদায় নেন আলেইদা এবং এস্তেফানিয়া। তাঁদের কনভয় বিদায় নেওয়ার সময় মঞ্চ থেকে ভেসে আসছে ‘বর্ণ অনন্য’র ‘আজ লালে লাল তোমার জন্মদিনে!’
এস্তেফানিয়া এবং আলেইদা বিদায় নেওয়ার পরেও সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান চলতে থাকে। অংশ নেন সুমন মুখোপাধ্যায়, তিতুমীর কালেক্টিভ, গৌতম ঘোষাল, লোপামুদ্রা মিত্র, পটা, ভাস্কর রায়, আকাশ চক্রবর্তী প্রমুখ সঙ্গীত শিল্পী। এদিন তাৎক্ষণিক আঁকা চে’র স্কেচ আলেইদার হাতে তুলে দেন পার্থপ্রিয় চ্যাটার্জি।
Comments :0