ঈশিতা মুখার্জি
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতরমন পেশ করলেন তিন নম্বর মোদী মন্ত্রীসভার দু’নম্বর বাজেট। এর আগে তিনি ছয়টি বার্ষিক বাজেট এবং দুটি অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট পেশ করেছেন। তাঁর পেশ করা বাজেটের ধর্ম হলো যে, তিনি আপাত শুনতে কিছু মনোমোহিনী কথা ঘোষণা করেন, কিন্তু পরের বছর তিনি যখন বাজেট পেশ করেন, গতবারের ঘোষণার কি ফল হলো, সরকার যা বাজেট বরাদ্দ ঘোষণা করেছিল, তার কতটা করা গেল, সে সম্পর্কে কোনও দায়িত্ব তিনি ও তাঁর বাজেট নেয় না। সে সম্পর্কে বাজেটের তথ্যে ছাড়া আর কোথাও কোনও উল্লেখ থাকে না। তাই তাঁর বাজেট বক্তৃতার আক্ষরিক অর্থে কোনও গুরুত্ব নেই। যেমন, বর্তমান বাজেটে এবার তিনি বক্তৃতায় বলেন যে, সরকার অগ্রাধিকার দিয়েছে গরিব, যুব, অন্নদাতা এবং নারীদের উপর। বাজেটের তথ্যে কিন্তু বাজেট বরাদ্দে এই চার গোষ্ঠীর মানুষের জীবন যাপনে সুবিধা হয়, এরকম কোনও কিছুর হদিশ পাওয়া যায় না, বরং যা পাওয়া যায় তা এই অগ্রাধিকার কমিয়ে দেওয়ার তথ্য! গতবারও একইভাবে তিনি অগ্রাধিকার ঘোষণা করেছিলেন এবং এক বছর পরে তার বাজেটের ফলে দেশে কি অগ্রগতি হলো তা বলার কোনও দায়িত্ব তিনি বোধ করলেন না। গতবারের অগ্রাধিকার দেওয়া সত্ত্বেও প্রস্তাবিত বাজেট বরাদ্দ থেকে কিভাবে আসল বরাদ্দ কমে গেল, তার কোনও খতিয়ান, ব্যাখ্যা অর্থমন্ত্রী দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না। ঠিক এই ঔদ্ধত্যই নজরে পড়েছে এই বছরের বাজেট জুড়ে। জনসাধারণকে গতবারের দেওয়া কথার যে ফারাক হয়ে যাচ্ছে, তার ব্যাখ্যা দেওয়ার কোনও দায় তিনি নিলেন না। এক কথায় এই বাজেট উদাসীন মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে। সরকারকে যারা ক্ষমতায় আসীন রেখেছে, সরকারের মাথাব্যথা একমাত্র সেই কোটিপতি কর্পোরেটদের নিয়ে, এই বাজেট তা ভালোভাবে আরেকবার বুঝিয়ে দিল। তাই সরকারি বিনিয়োগের ধারেপাশে না গিয়ে বিমা ক্ষেত্র ১০০% বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করে দিল সরকার।
বাজেট পেশের একদিন আগে পেশ করা হয়েছে আর্থিক সমীক্ষা, এই সমীক্ষায় দেশের আর্থিক স্থিতির খতিয়ান থাকে। এই সমীক্ষা সরকারি তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে তৈরি হয়। এই বছরের সমীক্ষা এক মারাত্মক প্রবণতার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। তা হলো দেশে পড়ে যাওয়া আর্থিক বৃদ্ধির হারের সঙ্গে সঙ্গে কর্পোরেটের মুনাফা ভীষণভাবে বেড়ে চলেছে এবং শ্রমজীবীদের মজুরির অংশ একই জায়গায় স্থির হয়ে আছে। কিছুদিন আগে ভোগ্যপণ্যের ব্যয়ের যে পরিসংখ্যান বেরিয়েছে, তাতে স্পষ্ট হয়ে গেছে দেশের মানুষের ব্যয় কমছে। কারণ তো খুবই সহজ— মানুষের হাতে টাকা নেই। বেকারত্ব, ক্ষুধা যে আমাদের দেশকে পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, দেশের সরকার কি এই বিষয়টা জানে না? দেশের সরকার কি এই বিষয়টাও জানে না যে দেশজোড়া কৃষক আন্দোলন আমাদের কৃষি বিপন্নতার দিকে বারে বারে ইঙ্গিত করেছে?
এই সব ইঙ্গিতকেই অবজ্ঞা করেছে এইবারের বাজেট। এই বারের বাজেটের কাছ থেকে দেশের মানুষের আশা ছিল কর্মমুখী প্রকল্পের, জিনিসপত্রের দাম কমানোর নীতির, শ্রমজীবী মানুষের মজুরি আয় বাড়ানোর নীতি, খাদ্য সুরক্ষার নীতি। সেই সবের কোনও তোয়াক্কা করেননি অর্থমন্ত্রী।
একটি একটি করে তার অগ্রাধিকারগুলির দিকে তাকানো যাক। তিনি অন্নদাতাদের অর্থাৎ কৃষিজীবী মানুষদের উপর জোর দিয়েছেন বলে বলেন। এবারে বাজেট বরাদ্দের দিকে তাকানো যাক। কৃষি দপ্তরের বাজেটের দিকে তাকালে কৃষি এবং কৃষকের উন্নয়নে যে প্রকৃত ব্যয় গতবছর হয়েছিল, তা ছিল ১.৩ লক্ষ কোটি টাকা। এ বছরে সেই বরাদ্দ কমিয়ে করা হয়েছে ১.২ লক্ষ কোটি টাকা। গতবছর যা খরচ হয়েছিল, তার চেয়ে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হলো। সারের ক্ষেত্রে গতবছরের বরাদ্দ ছিল ১.৬ লক্ষ কোটি টাকা; তা কমিয়ে দিয়ে এবারে করা হলো ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা। মূল্যবৃদ্ধির হার ধরলে তো আসলে এই বরাদ্দ কমে গেছে। এ ছাড়া বিজ্ঞাপনে ভরে গেছে যে প্রকল্পের তা হলো প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা। এই প্রকল্পে ফসলের বিমা গতবছরের ১৫,৮৬৪ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১২,২৪২.২৭ কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়া হলো।
অন্নদাতাদের ছাড়াও গুরুত্ব দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী যুব এবং নারীদের উপর। সরকারের কাছে যুবদের এই মুহূর্তে দাবি কর্মসংস্থানের। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় “ কর্মসংস্থান” শব্দটি নয়বার উচ্চারিত হয়েছে। প্রসঙ্গগুলি খতিয়ে দেখা যাক অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে কি বলেছেন বাজেটে। পর্যটনে, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে, সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে উদ্যোগী বানিয়ে জুতো এবং চর্মশিল্পে কর্মসংস্থানের কথা বলেন তিনি। কিভাবে বাছলেন এই কয়টি ক্ষেত্র অর্থমন্ত্রী? এইভাবে ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্পে উদ্যোগী বানানো হবে যুবদের। কিন্তু প্রশিক্ষণ ও উদ্যোগী বানানোর প্রকল্প যা অতীতে ছিল, সেখানে তো এই বাজেটে কোনও বরাদ্দই নেই। মনরেগা বা একশো দিনের কাজ প্রকল্প যা এখন গরিব বেকার মানুষের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে, সেই প্রকল্পে বরাদ্দ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ৮৬,০০০ কোটি টাকা। এই ধরনের নীতি সরাসরি মানুষের জীবন যন্ত্রণায় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। সরকার ভালোভাবেই জানে যে এই প্রকল্পের দাবি আছে গ্রামীণ মানুষের মধ্যে, তাই এই চাহিদাকে একেবারেই অবজ্ঞা করা হয়েছে এই বাজেটে এমন সিদ্ধান্তে আসা কি অমূলক নয়? রেল সাধারণ মানুষের একমাত্র গণপরিবহণ। সেই রেল আজ বেসরকারিকরণের পথে। বাজেট বরাদ্দ ২.৬২ লক্ষ কোটি থেকে কমিয়ে ২.৫৫ লক্ষ কোটি করা হয়েছে।
গরিব মানুষের পেটে ভাতের কথা কি আছে বাজেটে? খাদ্য এবং গণবণ্টনে গত বছর বরাদ্দ ছিল ২.১ লক্ষ কোটি টাকা, আসলে ব্যয় হয়েছে ২ লক্ষ কোটি টাকা এবং এবারে বরাদ্দ সেই ২.১ লক্ষ কোটি টাকা। তাহলে দেশ যে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ক্রমাগত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে, সে বিষয়ে সরকারের কোনও দুশ্চিন্তার প্রকাশ আমরা দেখলাম কি এই বাজেটে? অর্থমন্ত্রী মৎস্যচাষের গুরুত্বের কথা বলেছেন তাঁর বক্তৃতায়। এ বিষয়ে বরাদ্দ ৪৫২১.২৪ কোটি টাকা ছিল গত বছর; আসলে খরচ হয়েছে ৩৮৩৯.২৫ কোটি টাকা। এই বছর বরাদ্দ হয়েছে ৪৮৪০.৪০ কোটি টাকা। মূল্যবৃদ্ধির হার ধরলে আদৌ বরাদ্দ বাড়ল কি? যে আবাস যোজনা নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বিক্ষোভ আমরা দেখলাম, তাতে তো এই কথা প্রমাণিত যে আমাদের দেশে গৃহহীন রয়েছে বহু মানুষ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় শহরে গতবছর বরাদ্দ ছিল ৩০১৭০.৬১ কোটি টাকা, তা কমে আসলে ব্যয় হয়েছিল ১৩৬৭০ কোটি টাকা, অর্থাৎ অর্ধেকের কম ব্যয় করা হয়েছিল। এবারে সেখানে বরাদ্দ কমে হয়েছে ১৯৭৯৪.০০ কোটি টাকা। স্বচ্ছ ভারত মিশনেও বরাদ্দ বাড়েনি, রয়ে গেছে ৫০০০ কোটি টাকা। এবারে দেখা যাক গ্রামীণ পানীয় জল সরবরাহ প্রকল্প জল জীবন মিশন যা নিয়ে আমরা বিজ্ঞাপন দেখে থাকি, সেই প্রকল্পের কথা। এই প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ গতবছর ছিল ৭০১৬২.৯০ কোটি টাকা। এই বছর তা কমে ৬৭০০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। এরকম জনসাধারণের প্রতিদিনের জীবনের প্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলির বরাদ্দ হয় একই রেখে দেওয়া হয়েছে, নয়তো আদতে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে এইভাবে বরাদ্দ একচুলও বাড়েনি যেমন সমাজকল্যাণ, গ্রামোন্নয়ন, নগরায়ন এরকম কয়েকটি ক্ষেত্রে। এইভাবে মানুষের মৌলিক চাহিদা রয়েছে এরকম ক্ষেত্রে প্রকৃত বরাদ্দ আসলে কমিয়ে দেওয়া হলো।
দেশের মানুষের জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে কয়েকটি স্পর্শকাতর ক্ষেত্র রয়েছে, যে ক্ষেত্রগুলি গত কয়েকবছরে নানাভাবে আক্রান্ত হয়েছে। এরকম কয়েকটি ক্ষেত্রের বাজেট বরাদ্দ দেখা যাক। সংখ্যালঘু দপ্তরের বাজেট বরাদ্দ গতবছর ছিল ৩১৮৩.২৪ কোটি টাকা; কিন্তু আসলে ব্যয় করা হয়েছিল ১৮৬৮.১৮ কোটি টাকা-বরাদ্দের চেয়ে বেশ খানিকটা কম। এই বরাদ্দ এইবছর হয়েছে সামান্য বেড়ে ৩৩৫০ কোটি টাকা। প্রতিবন্ধী মানুষজনের ক্ষমতায়নের জন্য গতবছর বরাদ্দ ছিল ১২২৫.২৭ কোটি টাকা; কিন্তু আসলে খরচ হয়েছে ১১৬৭.২৭ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে এবার বরাদ্দ ১২৭৫.৫০ কোটি টাকা। এই দুটি ক্ষেত্রেই মূল্যবৃদ্ধির হার ধরলে বরাদ্দ কমে গেছে। সরকারের সংবেদনহীন মনোভাব আরেকবার মানুষের সামনে চলে এল।
বাজেটে খুব ফলাও করে বলা হয়েছে স্কুলে ইন্টারনেট দেওয়ার কথা। কিন্তু নয়া শিক্ষানীতির বেসরকারিকরণের চাপে যে বহু স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে তার হদিশ কি রেখেছে সরকার? স্কুল শিক্ষা এবং সাক্ষরতা ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৭৩০০৮.১০ কোটি টাকা; কিন্তু এখানেও আসলে ব্যয় হয়েছে ৬৭৫৭১.২০ কোটি টাকা! এবারে বরাদ্দ ৭৮৫৭২.১০ কোটি টাকা। ঐ সামান্য বৃদ্ধিতে কি খরচে কুলিয়ে যাবে স্কুলে স্কুলে ইন্টারনেট পরিষেবা? উত্তর দেওয়ার কোনও দায় নেই সরকারের। নানা ক্ষেত্রে যে বাজেট বরাদ্দের চেয়ে প্রকৃত ব্যয় কম হয়েছে, তার কোনও উত্তর পাওয়া যাবে না বাজেটে। উচ্চশিক্ষায় নতুন আইআইটি স্থাপনের কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু আমরা দাঁড়িয়ে আছি একটি তথ্যের সামনে। ২০২৩-২৪ সালে সরকার উচ্চশিক্ষায় ব্যয় করেছিল ৫৩৮৫.৩৬ কোটি টাকা আর এই বছর বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে ৫০০৭৭.৯৫ কোটি টাকা। শিক্ষায় জাতীয় উৎপাদনের ৬% বরাদ্দ এখনও অনেক দূরে।
মহিলাদের জন্য বরাদ্দ যা ২০০৫ সাল থেকে জেন্ডার বাজেটের মাধ্যমে বাজেটে দেখানো বাধ্যতামূলক, সেখান থেকে জানা যায় যে এই বরাদ্দ আসলে জাতীয় উৎপাদনের মাত্র ১.৬১%। মহিলা ও শিশু সুরক্ষা দপ্তরের বাজেট বরাদ্দ মোট বরাদ্দের মাত্র ০.৫৩%। শুধুমাত্র মহিলাদের প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ এ বছর বাজেট বরাদ্দের মাত্র ২%। অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ২১২০০ কোটি টাকা; এ বছর হয়েছে ২১৯৬০ কোটি টাকা। এই প্রকল্পেও প্রকৃত বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হলো। নির্ভয়া ফান্ড বৃদ্ধি করা হয়েছে, কিন্তু শুরুর বছর থেকে বরাদ্দ ক্রমশ কমে এসেছে।
সরকার আয়করের কিছু তারতম্য করে বেতনভোগী কিছু মানুষের করের বোঝা কমিয়েছে। কিন্তু এই সংখ্যা খুবই কম। আয়ের বৈষম্য আমাদের দেশে এতই বেড়েছে যে উচ্চ আয়ের মানুষের উপর করের হার না বাড়ালে এর কোন সুফল দেশের ভোগ্যপণ্যের ব্যয়ের উপর বা দেশের আর্থিক বৃদ্ধির উপর পড়ে না। উচ্চ আয়ের মানুষের উপর করের হার একচুলও বাড়েনি। ফলে গতবছরের কর সংগ্রহের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে আয়করের থেকে সরকারের যা রাজস্ব আয়, তার চেয়ে পণ্য পরিষেবা করের থেকে রাজস্ব আয় বেশি। সরকার সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা নিয়ে আদৌ ভাবে না এ কথা স্পষ্ট। বাজেটে আয় কম, ব্যয়ও কম- মানুষের জীবনে এই বাজেট কয়েকটি সংখ্যা ছাড়া কিছু নয়।
Comments :0