Ektu sore bosun

কমেডির ছ‍‌লে সময়ের কথা

রাজ্য বিশেষ বিভাগ ফিচার পাতা

শান্তনু চক্রবর্তী
 

ছবি: একটু সরে বসুন
অভিনয়ে: ঋত্বিক চক্রবর্তী, ইশা সাহা, পাওলি দাম, রজতাভ দত্ত, পায়েল সরকার, খরাজ, মানসী, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
পরিচালনা: কমলেশ্বর মু‍‌খোপাধ্যায়।
 

ছবির টাইটেল কার্ডে গ্রাফিক্সের খেলায় ‘একটু’ আর ‘বসুন’ শব্দ দুটোকে গুঁতোগুঁতি করে ঠেলে সরিয়ে, মাঝখানে ‘সরে’ শব্দটা বসে যায়। একইভাবেই বিরতির সময় ‘একটু আসুন’-কে দু’দিকে ধাক্কা মেরে ঢুকে যা‌‌‌য় দর্শক-ফ্রেন্ডলি ‘ঘুরে’ সবটা দর্শকের জন্য ব্রেক-এর নির্দেশিকা — ‘একটু ঘুরে আসুন’। আর সেই তালে তাল মিলিয়েই ছবির শেষে বাঁধাধরা ‘সমাপ্ত’-র বদলে ‘একটু’ আর ‘দেখুন’-কে পটকে দিয়ে গ্যাঁট হয়ে চিপকে যায় ‘ভেবে’। এটাই তো ছবির আসল বটম লাইন— ‘একটু ভেবে দেখুন’! আসলে ভাবাতেই তো চেয়েছেন কমলেশ্বর। তিনি চেয়েছিলেন দর্শক ছবি দেখতে দেখতে হাসুন— আর হাসতে হাসতে ভাবুন। বাংলা ছোট গল্পের সত্যিকারের গুণী শিল্পী বনফুলের যে ‘পাশাপাশি’ গল্পটার অনুপ্রেরণায় এই ছবি সেটা আ‍‌ড়ে-বহরে সাকুল্যে সাড়ে তিন পাতারও কম। তো সেই গল্পের ভিতের ওপর প্রায় ঘণ্টা আড়াই ছুঁইছুঁই একটা সিনেমা বানাতে গেলে চিত্রনাট্য কতটা কারিকুরি দরকার, বুঝতেই পারছেন। তাছাড়া ‘বনফুল’ তথা ডাক্তার বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের (ছবির ক্রেডিট টাইটেলে কাহিনিকারের পরিচয়টা এভাবেই দেওয়া আছে) গল্পটা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কলমে আগাগোড়া সরস হলেও, সেটাকে ঠিক ‘হাসির গল্প’ বলা যাবে না। বরং শেষের মোচড়টায় একটা শুকনো, কষ্টা কালো কমেডির স্বাদ আসে।


‘একটু সরে বসুন’-এর চিত্রনাট্যকার-পরিচালক ডাক্তার কমলেশ্বরও ‘কহানি মে’ এই ক্লিনিক্যাল টুইস্ট-টার পৌঁছানোর জন্যেই সেই বাঁকুড়ার বেগুনবাগিচা গ্রাম থেকে কলকাতা শহর অবধি কমেডির গুটি সাজিয়েছেন। উত্তম পুরুষে বলা বনফুলের গল্পে সেভাবে চরিত্র বলতে ছিল দুটি। বাবার রূপোর গড়গড়া বন্ধক রেখে কলকাতায় চাকরির খোঁজে যে আসছে, সেই কথক বা লেখক আর অতি-অতি দূর-সম্পর্কের যে আত্মীয়ের বা‍‌ড়িতে সে উঠছে, সেই ভদ্রলোক। কাহিনির এই সূত্রটা ছবিতেও আছে। তবে সেইসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই ছবির প্রয়োজনেই সেখানে ঢুকে পড়েছে অনেকগুলো চরিত্র। তারা সবাই যে সমান মজাদার তেমনটা নয়। কিন্তু তাদেরকে কোথায়-কিভাবে-কতটা জায়গা দেওয়া যাবে, তাই নিয়েই চিত্রনাট্যে জট পেকেছে নানারকম। ওই বেগুনবাগিচা গ্রাম থেকেই ‍‌তিনি বেশ আকর্ষণীয় কিছু চরিত্র তৈরি করতে করতে এগিয়েছেন। যেমন ছবির নায়ক গুড্ডু। সংস্কৃতে এমএ, শখের ম্যাজিশিয়ান এবং বেকার। পূর্বপুরুষের সিন্দুক ঘেঁটে একখানা রূপোর গড়গড়া বেচে, ৬০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে সে চাকরির খোঁজে কলকাতায় পালায়। ‘পুকুরচুরি’-র টাকা নিয়ে পালানো (ইঙ্গিতটা অবশ্যই পরিষ্কার) দুষ্কৃতীদের ধরে ফেলে রাতারাতি দুর্নীতি সাফাইকারী ‘নতুনভাই’ বলে যায়। টিভি চ্যানেলে-চ্যানেলে সে নায়ক! সামাজিক মাধ্যমে তাকে নিয়ে কত ‘পোস্ট’, ‘রিলস’! ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে কত কত ফলোয়ার্স! ছবিতে এই সময়ের অনেকগুলো সমস্যাকে একসঙ্গে ছুঁয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে। সূক্ষ্ম, নিচুপর্দার ঝকঝকে চোখা সংলাপে ক্ষমতার কেন্দ্র ‘১৪ তলা’, নি‍‌য়োগ-দুর্নীতি, সিন্ডিকেট-প্রোমোটার রাজ অনেক প্রসঙ্গ উ‍‌ঠে এসেছে। ছবির শেষকালে এসে মূল কাহিনির সূত্র ধরেই পথ মিলেছে। সেখানে একই পুঁজির খেলায় চাকরি না পাওয়া বেকার যুবক গুড্ডু আর কোম্পানির অর্ডার-মাফিক অধস্তন ছাঁটাই করতে রা‍‌জি না হয়ে চাকরি ছেড়ে দেওয়া কর্পোরেট-সাহেব ফট্কেদা সমান-সমান জমিতে এসে দাঁড়ায়। একেবারে শেষ দৃশ্যে গুড্ডুর ম্যাজিক-আশীর্বাদও সেখানে ততটা বেমানান লাগে না।


এ ছবির সবচেয়ে জোরের-জায়গা অবশ্যই অভিনয়। গুড্ডু চরিত্রটা প্লেসমেন্ট এজেন্সির মালকিন রোকেয়া চরিত্রে দুর্বলতাও পাওলি দাম অনেকটাই সামলে দি‍‌য়েছেন। আর যোগেন মাস্টার ও তার প্রাক্তন প্রেমিকার ভূমিকায় যখন খরাজ মুখোপাধ্যায় আর মানসী সিংহ, তখন কমেডি সংলাপের হাতবোমাকেও তাঁরা হাসির অ্যাটম কবোম বানিয়ে ফেলতে পারেন, স্রেফ টাইমিং-এর গুণে। বুদ্ধিদীপ্ত হাসির ছবি তো টলিউডের বক্সঅফিস থেকে উঠেই গেছে। সেখানে কমলেশ্বর সেই অভাব মেটাতে কিছুটা অন্তত এগিয়ে এলেন। সেজন্যে অবশ্যই ধন্যবাদটা তাঁর প্রাপ্য।
 

Comments :0

Login to leave a comment