‘চিরকুট’ ছিল?
মমতা ব্যানার্জির দাবি, ছিল। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে তাতে চাকরি হতো। কিন্তু সেই তিনি তেমন চিরকুট হাতে পাননি। কখনও দেখেননি। প্রায় ১২ বছর মুখ্যমন্ত্রী হয়েও চিরকুট বের করতে পারেননি। এবার চিরকুট-সন্ধানের দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছেন ব্রাত্য বসুকে। ব্রাত্য শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালেই অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। তাই তৃণমূলের নেতা, মন্ত্রীদের একাংশের আশা, ব্রাত্য পারবেন। ব্রাত্য দাবি করে বসেছেন, তিনি সেই চিরকুট শুধু খুঁজে আনবেন না, তার শ্বেতপত্র প্রকাশ করে ক্ষান্ত হবেন।
এরই মধ্যে সিপিআই(এম) নেতা সুজন চক্রবর্তীর স্ত্রী, মহিলা নেত্রী মিলি চক্রবর্তীর নিয়োগপত্রকে ‘চিরকুট’ বলে চালাতে গিয়ে একপ্রস্থ বিপাকে পড়েছে তৃণমূল। তবু এই বামফ্রন্ট আমলের ‘চাকরির চিরকুট’ই এখন তৃণমূলের ভরসা। চুরি, তোলা আদায়, কাটমানির প্রমাণে প্রমাণে বিধ্বস্ত তৃণমূল। ব্রাত্য বসু সেই চিরকুট খুঁজে এনে দিতে পারেন কিনা, সেদিকে তাকিয়ে পিসি-ভাইপোর তাবড় বাহিনী।
ব্রাত্য নেমেছেন সেই কাজে। হঠাৎ পথে জল ঢেলে দিয়েছেন ফিরহাদ হাকিম। তিনি মন্ত্রী, কলকাতার মেয়রও। মমতা ব্যানার্জিকে ব্রাত্যর অনেক আগে থেকে চেনেন ‘ববি’ হাকিম। সেই ববি শনিবার বলেছেন, ‘‘চিরকুটে কোনোদিন লোক ঢোকানো যায় না। একটা অ্যাপ্লিকেশন লাগে।’’
মেয়র একথা বললেন ‘টক টু মেয়র’র ভাষণে। নাগরিকরা অনেকেই তার কলে শুনতে পেলেন। ববি হাকিম আরও বললেন, ‘‘আগে যখন সার্ভিস কমিশন বা রিক্রুটমেন্ট রুলস ছিল না, তখন আমাদের স্কুলগুলিতে দেখেছি, গভর্নিং বডি নিয়োগ করত। একটি প্যানেল তৈরি করত। সেটা ৭০-র দশকে আমরা দেখেছি।’’
অর্থাৎ ‘বামফ্রন্ট আমলে চিরকুটে চাকরি হতো’, ফিরহাদ হাকিম স্বীকার করলেন না।
এখানেই থামেননি মেয়র। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালেই, ২০১০-এ ফিরহাদ কলকাতার মেয়র পরিষদ সদস্য হয়েছেন। কাউন্সিলর হয়েছেন বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে। কারণ, বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে মানুষ ভোট দিয়ে বামফ্রন্ট বিরোধীদেরও জয়ী করতে পারতেন। তাই ফিরহাদ বামফ্রন্ট সরকারের সময়েই তৃণমূলের কাউন্সিলর হয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময়েও তিনি চিরকুটে চাকরি করে দিতে পারেননি বলে সাফ জানিয়েছেন।
এদিন তিনি জানান, ‘‘আমি যখন কাউন্সিলর, তখন অনেকে বলতেন, এক জনকে কর্পোরেশনে ঢুকিয়ে দাও না। ছেলেটা বসে রয়েছে। আমি বলতাম, ‘দিদি, কর্পোরেশনে ওভাবে লোক ঢোকানো যায় না।’ যখন থেকে ‘রিক্রুটমেন্ট রুলস’ তৈরি হলো, তখন থেকে এ ভাবে আর লোক ঢোকানো যায় না।’’
এই ‘রুলস’ বামফ্রন্ট সরকার তৈরি করেছিল নিয়োগে স্বচ্ছতার জন্য। যা মমতা ব্যানার্জির আমলে খান খান হয়ে গেছে। প্রমাণ পার্থ চ্যাটার্জি সহ একাধিক তৃণমূলের নেতা, বিধায়কের গ্রেপ্তার এবং জেলযাপন।
ফিরহাদ হাকিম হঠাৎ চিরকুট নিয়ে বললেন কেন?
কারণ তৃণমূলের আর এক মন্ত্রী, দিনহাটার বিধায়ক উদয়ন গুহ। তাঁর বাবা, কমল গুহ ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা, বামফ্রন্ট সরকারের কৃষি মন্ত্রী। সেই বাবাকে জড়িয়ে এদিন উদয়ন গুহ বলেন, ‘‘দলের স্বার্থে তিনিও (তাঁর বাবা) দুর্নীতি করেছেন। এটাকে দুর্নীতি বলব আমি। ৫ টাকা নিলে দুর্নীতি, ৫০ হাজার টাকা বা ৫ লাখ টাকা নিলেও দুর্নীতি। এটা হতে পারে না। আমি এখন আমার বাবাকে বাঁচানোর জন্য বলব যে, বাবা যেটা করেছেন সেটা সঠিক করেছেন, আর এখন অমুক যেটা করছেন, সেটা ভুল করছেন বা সিপিএম’র বিধায়ক যেটা করেছিলেন সেটা ভুল? বাবাও তো অনেককে চাকরি করে দিয়েছিলেন।’’
উদয়ন আরও বলেছেন। তাঁর দাবি, ‘‘বাবার সামনে বসে তালিকা হয়েছিল। বাবা সেই তালিকা এনডোর্স করে দিয়েছিলেন। সেখানে যোগ্য ব্যক্তিদের তো বঞ্চিত করা হয়েছিল। এটা দুর্নীতির অঙ্গ। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। যারা আজ যোগ্যদের বঞ্চিত করা হয়েছে বলছে, তাদের পূর্বসুরীরা যোগ্যদের বঞ্চিত করেই চাকরি দিয়েছে।’’
উদয়নের এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ‘টক টু মেয়র’ অনুষ্ঠানে এক নাগরিক প্রশ্ন করেন। জবাবে ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘ও (উদয়ন গুহ) কী পাগলের মতো বকছে, আমার জানা নেই। এটা নিয়ে আমার কোনও বক্তব্যই নেই। কারণ চিরকুটে কোনোদিন লোক ঢোকানো যায় না। একটি আবেদনপত্র লাগে।’’
প্রশ্ন উঠছে ফিরহাদ হাকিমের গলায় হঠাৎ ভিন্ন সুর কেন? ব্যাখ্যা আছে তৃণমূলে। তৃণমূলের নেতা, এক মন্ত্রীর কথায়, ব্রাত্য বসু অভিষেকের বশংবদ। উদয়নও চেষ্টা করছেন অভিষেকের ঘনিষ্ঠ হওয়ার। এই অবস্থায় মমতা ব্যানার্জির পুরানো সৈনিকরা দলে ব্রাত্য হচ্ছেন। ফিরহাদ হাকিম তাঁদের অন্যতম। এই পরিস্থিতিতে অভিষেক টিমের কাজকে ঘনিষ্ঠ মহলে ‘ভুলভাল’ কাজ বলেছেন ফিরহাদ। চিরকুট নিয়ে নিজের মতো বলে সেই বিরোধিতাই জানিয়ে রাখলেন ফিরহাদ।
Comments :0