Abhishek Banerjee

দলের নেতা, ধৃতদের বয়ান থেকেই প্রশ্ন অভিষেককে

রাজ্য

সাড়ে নয় ঘণ্টার জেরায় ৯০ শতাংশ প্রশ্নই ছিল ‘বোগাস’, ‘সময় নষ্ট’। শনিবার রাতে জেরা শেষে বেরিয়ে নিজাম প্যালেস চত্বরে সাংবাদিকদের সামনে এমনটাই দাবি করেছিলেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতা, সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জি।
অন্যদিকে নিয়োগকাণ্ডের তদন্তেই ১৫ ঘণ্টা ধরে তাঁর বাড়িতে তল্লাশির পরে শনিবার রাতে সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে কালীঘাটের কাকু দাবি করেছেন, কিছুই পায়নি ইডি। আসলে অনেক সব ডকুমেন্ট, পাতা ধরে ধরে তাতে সই করতেই সময় লেগেছে। ওনারা হয়তো খড়ের গাদায় সূচ খুঁজছেন!
তাই কী? দুই তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই ও ইডি’র একটি সূত্রের দাবি যদিও সম্পূর্ণই আলাদা। 
কেবল মাত্র প্রাথমিকের দুর্নীতি নয়, এসএসসি, নবম-দশমে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়েও দফায় দফায় জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল ভাইপো সাংসদকে। গত ১৫ মার্চ নিজাম প্যালেসেই নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে সিবিআই জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল কালীঘাটের কাকুকে। এই কালীঘাটের কাকুর কাছেই চাকরি দেবার নামে তোলা কোটি কোটি টাকার ভাগ পাঠাতে হতো, এমন কথাই জানিয়েছিল নিয়োগকাণ্ডেই ধৃত কুন্তল ঘোষ, আরেক ধৃত তাপস মণ্ডলের কাছে। সুজয় ভদ্রকে কেন বছরের বছরের পর প্রাইমারি থেকে এসএসসি’র নিয়োগ দুর্নীতিতে থেকে তোলা কোটি কোটি টাকা দিতে হতো? সুজয় ভদ্র নিজে সেই টাকা নিতেন নাকি কারো হয়ে সেই টাকা তিনি সংগ্রহ করতেন ? তা জানতেই তাঁকে জেরা করেন গোয়েন্দা আধিকারিকরা। জানা যায় সেদিন একাধিক নাম মিলেছিল সুজয় ভদ্রের কাছ থেকে যাদের সঙ্গে প্রাইমারি নিয়োগ প্রক্রিয়ার যোগ ছিল। টাকার লেনদেনের যোগও ছিল। 
সিবিআই সূত্রে জানা গেছে সেই কালীঘাটের কাকুর দেওয়া নামের তালিকা ধরেও জেরা করা হয়েছিল অভিষেক ব্যানার্জিকে। যদিও জেরায় অভিষেক ব্যানার্জি সাম্প্রতিক সময়ে সুজয় ভদ্রের সঙ্গে তাঁর যোগ নেই বলে দাবি করেছেন, জানা গেছে একটি সূত্রে। তবে শুধু মাত্র সুজয় ভদ্র নয়, নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত কুন্তল ঘোষ থেকে শান্তনু ব্যানার্জি, বড়ঞার তৃণমূল বিধায়ক জীবন কৃষ্ণ সাহা থেকে ধৃত মানিক ভট্টাচার্যের বয়ান ও ইতিমধ্যেই হাতে আসা একাধিক সাক্ষীর বক্তব্য সামনে রেখেই জেরা করা হয় অভিষেক ব্যানার্জিকে। অভিষেক ব্যানার্জি দাবি করেছিলেন যে সমস্ত লোকজন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে তার মধ্য ৯০ শতাংশই মুর্শিদাবাদ ও পূর্ব মেদিনীপুরের। যদিও তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে শুধু এই দুই জেলা নয়, নদীয়া, বীরভূম, দুই চব্বিশ পরগনার একাধিক ব্যক্তির প্রসঙ্গও উঠে এসেছে তদন্তে। এজেন্ট চক্র তৈরি করেই টাকা তোলা চলছিল। ধৃত কুন্তল ঘোষ ও শান্তনু ব্যানার্জির সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের সূত্র নিয়েও বারেবারে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে অভিষেক ব্যানার্জিকে। 
অভিষেক ব্যানার্জির বয়ান খতিয়ে দেখার পরে তদন্তকারীরা পরবর্তীতে তাঁকে তলবের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানা গেছে। ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে এসএলপি দায়ের করেছেন অভিষেক ব্যানার্জি। মূলত কেন্দ্রীয় সংস্থার জেরা থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া অর্থাৎ বিচারপতি অমৃতা সিনহার নির্দেশের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়েই সুপ্রিম কোর্টে ছুটেছেন অভিষেক ব্যানার্জি। সোমবার শুনানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এই আবেদনের ওপরে। এদিকে আগামী সপ্তাহেই জেলে গিয়ে এবার নিয়োগকাণ্ডে ধৃত কুন্তল ঘোষকে জেরা করতে চলেছে সিবিআই। অভিষেক ব্যানার্জির বয়ানকে ধরেই কুন্তলকে জেরা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিবিআই।
এদিকে আরেক কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি’র দাবি, সুজয় কৃষ্ণ ভদ্রের একাধিক সম্পত্তির হদিশ মিলেছে, বেনামেও সম্পত্তি রয়েছে। সুজয় ভদ্রের শ্বশুড়বাড়িতেও হানা দিয়েছিল ইডি, সেখান থেকে বেশ কিছু নথি উদ্ধার হয় বলে জানিয়েছে ইডি। এই কালীঘাটের কাকুর কোম্পানিতে একাধিক রহস্যজনক বিপুল টাকার লেনদেনেরও হদিশ মিলেছে। কালীঘাটের কাকুকে এবার সিজিও কমপ্লেক্সে তলব করতে চলেছে ইডি। 
আর এই জেরা, তল্লাশি পর্বের মধ্যেই দেখা গেল সলিটায়র প্লেসমেন্ট সার্ভিসেস লিমিটেড নামে একটি সংস্থা গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে। এবং সেই সংস্থার বোর্ড অব ডিরেক্টরসের অন্যতম সদস্য অভিষেককে নিজের ‘সাহেব’ বলে মনে করা এই সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র। ২০১০ সালের জুন মাসে তৈরি হওয়া এই সংস্থার বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সদস্য সংখ্যা তিনজন। সুজয় ভদ্র সহ ঐ তিনজনেই ২০১০ সালের ১০ জুন সেই সংস্থায় ডিরেক্টর হিসাবে যোগ দেন।
নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত পেতেই এখন আরওসি’র তথ্য বলছে এই সংস্থার বর্তমান স্ট্যাটাস – ‘ আন্ডার প্রসেস অফ স্ট্রাইক অফ’! অর্থাৎ এই সংস্থা গুটিয়ে ফেলার জন্য, আরওসি’র তালিকা থেকেই সংস্থার নাম তুলে নেওয়ার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। কোম্পানি অ্যাক্ট, ২০১৩’র  ২৪৮ নম্বর ধারায় এই কোম্পানির ‘স্ট্রাইক অফ’ করা যায় যখন কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরস সেই সংস্থা আর জীবিত রাখতে চায় না। 
গোটা প্রক্রিয়ায় নজর রাখছে ইডি। হঠাৎ করে এই কোম্পানি গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে কেন ? কোনও অবৈধ লেনদেনের তথ্য লুকোতেই কি এই পদক্ষেপ?
এর আগে কয়লা পাচারকাণ্ডে দিল্লিতে এবং কলকাতায় ইডি’র দপ্তরে মোট তিনবার জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জিকে। কয়লা পাচার তদন্তেই সামনে এসেছিল অভিষেক ব্যানার্জির ব্রেনচাইল্ড সংস্থা ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’। কয়লার তদন্ত গতি পেতেই দেখা যায় ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস এলএলপি’ সংস্থাই গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে। খাতায় কলমে সংস্থার ডিরেক্টর মুখ্যমন্ত্রীর ভাই, অভিষেক ব্যানার্জির বাবা অমিত ব্যানার্জি ও মা লতা ব্যানার্জি। আরওসি’র সাইট অনুযায়ী সেই সংস্থারও বর্তমান স্ট্যাটাস- ‘ আন্ডার প্রসেস অফ স্ট্রাইকিং অফ’! 
কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার একটি নির্দিষ্ট সূত্রেই জানা গেছে, ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড’ এবং ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ড ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস এলএলপি’- এই সংস্থায় কয়লা পাচারের টাকা ঢুকেছে। ঢুকেছে ঘুরপথে। একটি নির্মাণকারী সংস্থার মাধ্যমে, সেই সংস্থার সঙ্গে আবার সরাসরি যোগ কয়লা মাফিয়া অনুপ মাঝি ওরফে লালার। টাকার পরিমাণ ৪ কোটি ৩৭ লক্ষ।

Comments :0

Login to leave a comment