অপূর্ব মণ্ডল: বুনিয়াদপুর
কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না, সেটা ভোলাতে মগজে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে শাসকরা। শনিবার দক্ষিণ দিনাজপুরের বুনিয়াদপুরে সারা ভারত কৃষকসভার জেলা সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশে একথা বলেছেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তিনি বলেছেন, দেশপ্রেমিক সেজে যুদ্ধজিগির তুলে কৃষকদের সমস্যাকে আড়াল করা যাবে না। দেশ মানে দেশের কৃষক, খেতমজুর, শ্রমিক, ছাত্র যুব মহিলারা। তাদের সমস্যার সমাধান না করে কেন্দ্র এবং রাজ্যের সরকার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছে। জনগণের দুর্দশার সমাধান করতে লাল ঝান্ডা হাতে সব গরিব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
ধানের ন্যায্য সহায়ক মূল্য, সরকারি মান্ডি থেকে সহজ পদ্ধতিতে ফসল কেনার সুব্যবস্থা, উন্নত মানের বীজ ও কীটনাশক বিনামূল্যে সরবরাহ, কৃষি ভিত্তিক শিল্প স্থাপন সহ রাসায়নিক সারের কালোবাজারি রোধের দাবি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আহ্বান জানিয়ে এদিন কয়েক হাজার কৃষক জমায়েত হয়েছিলেন বুনিয়াদপুরে পুরানো বাসস্ট্যান্ড প্রাঙ্গণে সারা ভারত কৃষকসভার দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা ১৪তম সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশে। এই সভাতেই সেলিম বলেন, কৃষক ফসল বিক্রি করতে গেলে দাম পাচ্ছেন না, তাঁকে অবৈধ ধলতা (বাড়তি ধান আদায়) দিতে বাধ্য করছে স্থানীয় এজেন্সি সহ সরকারি আধিকারিকরা। মানুষের খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, রেল, ইত্যাদির বন্দোবস্ত করা সরকারের কাজ, সেগুলো তারা করছে না। মোদী সরকার এগুলি বেসরকারিকরণের মধ্য দিয়ে আদানি-আম্বানিদের মুনাফা বৃদ্ধি করতেই ব্যাস্ত। আর এরাজ্যের সরকারের দুর্নীতিতে ছাব্বিশ হাজার শিক্ষকের চাকরি গেছে, গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থা তছনছ হতে বসেছে। অথচ এই সব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে যুদ্ধজিগির তোলা হচ্ছে। সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে ধর্মকে জুড়ে দিয়ে মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন করা হচ্ছে।
এসব কাজে বিজেপি এবং তৃণমূলের সেটিং উল্লেখ করে সেলিম বলেছেন, দুই দলই মন্দির মসজিদ নিয়ে রাজনীতি করছে, পরস্পরকে ইন্ধন দিচ্ছে। কিন্তু মানুষের দুর্দশার সমাধানে কোনও দায়িত্ব পালন করছে না। এরাজ্যে শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতিতে যারা টাকা খেয়েছে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত করল না সিবিআই। দুর্নীতির টাকা শেষ পর্যন্ত কোথায় যেত? কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা কাকুর কণ্ঠস্বরের ব্যাপারে আর কোনও কথা কেন বলছে না? ভাইপোকে কেন আর ডাকা হচ্ছে না? আর জি করের ঘটনার তদন্তে সিবিআই প্রকৃত অপরাধীদের আজও ধরলো না, রাজ্যের পুলিশের কথামতো মোড় ঘুরিয়ে তাদের আড়াল করে দিল। বিজেপি’র ভক্তরা চুপ করে থাকলেও আমরা বামপন্থীরা এই সব অপরাধের বিচার চাই, অন্যায়ের প্রতিবাদ থেকে আমরা পিছিয়ে যাবো না।
তিনি বলেন, এসব ভুলিয়ে রাখতে মানুষকে কয়েকদিন ভিডিও গেমের মতো টিভিতে যুদ্ধের ছবি দেখানো হলো। পাকিস্তানের মদতে যে সন্ত্রাসবাদীরা পহেলগামে হামলা চালিয়েছে, সেনারা তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে, আমরা সন্ত্রাসবাদীদের উপযুক্ত শাস্তি দেখতে চাই। কিন্তু বিশ্বগুরু সাজা মোদীর ফোলানো বেলুন চুপসে দিয়ে হঠাৎ আমেরিকার দাদাগিরি কেন মেনে নেওয়া হলো? আমরা কোনও সাম্রাজ্যবাদী দেশের গোলামি মানব না, ভারতের স্বাধীন বিদেশ নীতি চাই। আমরা পৃথিবীর কোথাও যুদ্ধ চাই না, কারণ যুদ্ধ কোনও সমাধান নয়, যুদ্ধ কেবল সমস্যাই তৈরি করে। এখনও যুদ্ধজিগির তুলে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে দেশের ভিতরে অনৈক্যের সমস্যা তৈরি করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার চলছে। এরাজ্যের বেকার যুবদের কাজ দেওয়ার ক্ষমতা নেই, ভিন রাজ্যে গিয়ে কাজ করতে গিয়ে আক্রান্ত হলেও তৃণমূল সরকার তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। শুধু কৃষক দুর্দশায় নেই, দুর্দশায় আছে কৃষক, শ্রমিক, খেতমজুর, শিক্ষক, কর্মচারী, ছাত্র, যুব সহ সমস্ত মানুষ, আর তাই সবাইকে একত্রিত করে লড়াইতে নামতে হবে। তিনি বলেন, কেন্দ্রের নয়া ফ্যাসিবাদী শাসক এবং রাজ্যে তার দোসর তৃণমূল দুটোকেই সমূলে উৎপাটিত করতে হবে।
সমাবেশে সারা ভারত কৃষকসভার রাজ্য সম্পাদক অমল হালদার বলেন, বামফ্রন্ট সরকার জমিদার জোতদারদের বেআইনি জমি গরিব ভূমিহীন মানুষের মধ্যে বিলি বণ্টন করেছিল বলেই গ্রামের উন্নয়ন হয়েছিল। বর্তমানে তৃণমূলের মদতে দালাল চক্র সেই জমি কেড়ে নিতে আক্রমণ চালাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু কৃষকসভার নেতৃত্বে কৃষকরা সজাগ ও সতর্ক থেকে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করবে। দক্ষিণ দিনাজপুরের কৃষকরা ঐতিহাসিক খাঁপুরের তেভাগা আন্দোলনের লড়াইয়ের ঐতিহ্য বহন করেন। এখন দুই সরকারের মদতে কৃষিতে কর্পোরেট আক্রমণের প্রতিরোধেও তাঁরা ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। তিনি বলেন, মোদীর সরকার কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা করছে। দিল্লিতে কৃষক আন্দোলনের চাপে কৃষকদের দাবি মেনে নিলেও পরবর্তীতে আবার আক্রমণ নামিয়ে আনছে।
প্রকাশ্য সমাবেশে এছাড়াও ভাষণ দেন গণআন্দোলনের নেতা নন্দলাল হাজরা, কৃষক নেতা সকিরদ্দিন আহমেদ। প্রকাশ্য সমাবেশ পরিচালনা করেন কৃষক নেতা অমিত সরকার। এদিন সন্ধ্যায় পতাকা উত্তোলন ও শহীদ বেদীতে মাল্যদানের পর বুনিয়াদপুরের নারায়ণ বিশ্বাস নগরের সুকান্ত সভাকক্ষে কমরেড মহিউদ্দিন আহমেদ এবং কমরেড হরেন ঘোষ মঞ্চে জেলা সম্মেলন শুরু হয়েছে। সম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষণ দিয়েছেন কৃষকসভার রাজ্য সম্পাদক অমল হালদার। সম্মেলন চলবে রবিবার পর্যন্ত।
MD SELIM
যুদ্ধজিগির তুলে কৃষকের সমস্যা আড়াল করা যাবে না: সেলিম
.jpg)
×
Comments :0